মণিপুরের প্রতিবাদ সভা। —ফাইল চিত্র।
‘মণিপুর নিয়ে বেসুরো কথা’ (৬-৯) প্রবন্ধে লেখক মোহিত রায় মণিপুরের হিংসার ঘটনার জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরকরণকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, নাগা-কুকি-মিজ়োদের ‘সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি’ থেকে বার করে এনে মিশনারিরা ধর্মান্তরিত করেছেন। মেইতেইরা সেই ‘সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি’ রক্ষার্থে লড়াই করছে, তার ফলেই এই হিংসা। এ তো হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবারের ব্যাখ্যা। হিন্দু সংখ্যাগুরুদের ‘ভিকটিম’ বা পীড়িত হিসেবে দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হিংসাকে সামাজিক ন্যায্যতা দেওয়াই এদের কাজ। শতাধিক মানুষের মৃত্যু, ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষের উৎখাত হওয়া, ৪ হাজার বাড়ি ও ৩৩০টি ধর্মস্থান জ্বালিয়ে দেওয়া, ৩৫০টি ত্রাণশিবিরে এখনও মানুষের প্রাণ বাঁচাতে কোনও ক্রমে মাথা গুঁজে আশ্রয় নেওয়া— মণিপুরের এই সমস্ত ঘটনা তাদের কাছে ‘সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি’ বাঁচানোর লড়াইয়ের অংশ! মণিপুরে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ মেইতেই সম্প্রদায়ের এবং ২০ শতাংশের কাছাকাছি কুকি-জো জনজাতির। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসে হিন্দু ৪১ শতাংশ, খ্রিস্টানও ৪১ শতাংশ।
মেইতেই সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ খ্রিস্টান। পুড়িয়ে দেওয়া ৩৩০টি ধর্মস্থানের মধ্যে ২৪৯ চার্চই হল মেইতেই সম্প্রদায়ের খ্রিস্টানদের। অর্থাৎ, মেইতেই-কুকি নয়, বরং হিন্দুত্ববাদী বনাম খ্রিস্টান সংখ্যালঘু দ্বন্দ্বটিই বড় হয়ে উঠেছে। আমরা দেখেছি ২০০৮-এ ওড়িশার কন্ধমালে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘাতকেরা, আক্রান্ত হয়েছিল ৬০০টি খ্রিস্টান অধ্যুষিত গ্রাম, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ৫৬০০ বাড়ি, ৫৪ হাজার মানুষ হন ঘরছাড়া, পোড়ানো হয় ২৩২টি গির্জা, সরকারি মতে মৃত ৩৯ জন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। আজকের মণিপুরের সঙ্গে কত মিল। আসলে এটাই হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাতাদের পরিকল্পনার অঙ্গ। অহিন্দু গোষ্ঠী তো বটেই, নিস্তার পাবে না সাম্যবাদী, গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা মানুষেরাও। কোপ নামবে নারীমুক্তির প্রবক্তা, মানবাধিকার কর্মীদের উপরেও। এর পরেও যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাঁরা থাকবেন সমস্ত অধিকারহীন ক্রীতদাসের মতো। বিদ্রোহ করলেই ঠাঁই হবে ত্রাণশিবিরে।
প্রবন্ধকার যে ভাবে মায়ানমার থেকে আগত কুকিদের এই হিংসার জন্য দায়ী করেছেন, অনেকটা সে ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ একাধিক বার কুকি জনজাতির মানুষকে ‘বহিরাগত’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়েছেন। মণিপুরে জাতিদাঙ্গা ও গণহত্যা শুরু হওয়ার বহু আগেই মণিপুর সরকার জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বেআইনি দখলদারি উৎখাত করার নামে বুলডোজ়ার দিয়ে তিনটি ৫০ বছরেরও পুরনো গির্জা গুঁড়িয়ে দেয়। এই ভাবেই হয়তো মণিপুরে সংগঠিত ‘এথনিক ক্লিনজ়িং’ সম্পন্ন হবে। আর এটাই তো হিন্দুত্ববাদের চিরকালীন রাজনৈতিক প্রকল্প।
অজেয় পাঠক, হরিণডাঙা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
এলউইন দায়ী?
মোহিত রায় মণিপুরের দাঙ্গার জন্য স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে মণিপুর-সহ গোটা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা জনজাতিগুলির ব্যাপক হারে ধর্মান্তরকরণকেই মূলত দায়ী করছেন। এর জন্য জওহরলাল নেহরুকেও দায়ী করেছেন। নেহরুই নাকি ১৯৫২ সালে ভারতে আগত অক্সফোর্ড-প্রাক্তনী বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক ভেরিয়ার এলউইনের পরামর্শক্রমে ভারত সরকার দ্বারা নাগাল্যান্ডে হিন্দু সাধুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করান, অথচ খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণের ক্ষেত্রে তেমন কোনও বিধিনিষেধ প্রয়োগ করেননি। শুধু প্রবন্ধকারই নন, মণিপুরের ভয়ঙ্কর দাঙ্গা মেটাতে বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা প্রকট হওয়ার পর থেকে সমাজমাধ্যমের গ্রুপগুলিতে এই মত প্রায়ই চোখে পড়ছে। এই অভিযোগের আদৌ কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না তা জানতে এ বিষয়ে ভেরিয়ার এলউইনের জীবনীকার ও বিশিষ্ট ইতিহাসবেত্তা রামচন্দ্র গুহের একটি সাম্প্রতিক নিবন্ধ ‘ডিফেমিং দ্য ডেড’ পড়া দরকার। তিনি লিখেছেন, এলউইনের কাজের পরিধি কেবল অরুণাচলেই সীমাবদ্ধ ছিল। নাগাল্যান্ডের নীতি স্থির করার কোনও জায়গাতেই ছিলেন না তিনি। স্বাধীনতার পর নাগাদের আন্দোলনের জন্য ভারতের মূলভূমি থেকে নাগাল্যান্ডে অবাধ যাতায়াতে বাধা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ‘নেহরু-এলউইন চুক্তি’ বলে কখনও কিছু ছিল না। খ্রিস্টান মিশনারিরা বরং ১৮৭০-এর দশক থেকেই নাগাল্যান্ডের পাহাড়ে সক্রিয় ছিল, অর্থাৎ নেহরু বা এলউইনের জন্মের বহু আগেই। এলউইন নিজে সব ধরনের মিশনারিদের অবিশ্বাস করতেন, এমনকি নাগাল্যান্ডের ব্যাপটিস্টদের বলতেন ‘খ্রিস্টানদের আরএসএস’। তিনি চাইতেন জনজাতিরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও আচার বজায় রাখুন, তাঁরা যেন হিন্দু বা খ্রিস্টান না হন।
রামচন্দ্র গুহের উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে প্রবন্ধকারের বক্তব্য এবং বিজেপির আইটি সেল ও সমজাতীয় গোষ্ঠীগুলির নেহরু ও এলউইনকে জড়িয়ে গল্পের গরু মুখ থুবড়ে পড়ছে। মণিপুরের নারকীয় পরিস্থিতিতে বিপন্ন হাজার হাজার মানুষের উদ্ধারের পথের সন্ধান দিতে যখন দলীয় রাজনীতি ব্যর্থ, তখন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতরাও আপাত-নিরপেক্ষতার আড়াল থেকে দলীয় উদ্দেশ্য সাধনে ইতিহাসকে বিকৃত করছেন।
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-২৯
বিদ্বেষ গরল
মোহিত রায়ের প্রবন্ধটি সত্যকে সবার সামনে উন্মোচন করেছে। ১৯৪৭ সালে মণিপুর স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৯৪৯ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিংহ ভারত অন্তর্ভুক্তির সম্মতিপত্রে সই করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এটি ছিল কেন্দ্রশাসিত রাজ্য। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায় ১৯৭২ সালে।
ভারতে অর্ন্তভুক্তির দিন থেকে সেখানে বসবাসকারী জনজাতিদের মধ্যে বিদ্বেষের বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে। দিনে দিনে সেটি মন্থনের ফলে আজ রাজ্যটি একটি গরল সমুদ্রে পরিণত। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৭ শতাংশ মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ জনজাতিভুক্ত ছিলেন। অথচ ১৯৫১ সালের জনগণনায় তাঁদের সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ায় তাঁদের প্রতি যথেষ্ট অন্যায়-অবিচার হয়েছে। অবিচার হয়েছে মূলত পাশাপাশি কুকি, নাগা ও অন্যান্য জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ ৪৭ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও, তাঁরা পাহাড়ঘেরা মণিপুরের প্রায় ৯০ শতাংশ জমির মালিকানা ভোগ করেন। অন্য দিকে, অধিক জনসংখ্যার মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ মাত্র ১০ শতাংশ জমির মধ্যে সীমাবদ্ধ আছেন। তাঁদের যে-হেতু জোর করে সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত করা হয়েছে, তাই জনজাতিদের জমি কেনার অধিকার তাঁদের নেই। অথচ জনজাতির লোকেরা সমতলে জমি কেনার অধিকার ভোগ করেন। ২০১৩ সাল থেকে মেইতেইরা তাঁদের জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে গণ্য করার আবেদন ভারতের তথা রাজ্যের বিচার বিভাগের কাছে রেখেছেন। অবশেষে আদালতের রায়ে মেইতেইরা জনজাতি হিসাবে গণ্য হওয়ার পথে এগিয়ে গেলে প্রবল আন্দোলন শুরু করলেন মূলত কুকি, সঙ্গে অন্যান্য জনজাতির মানুষেরা। তা ক্রমে গৃহযুদ্ধের রূপ নিল।
ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা ভারতের গরিব মানুষের সেবার নামে তাঁদের ধর্মান্তরিত করার কাজ করে এসেছেন। তাঁরা বেছে নিয়েছেন আমাদের দেশের তফসিলি জাতি ও জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষকে। তলে তলে আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। এই ভাবে গোটা মিজ়োরাম খ্রিস্টান হয়ে গেছে। মণিপুরে হিন্দুর সংখ্যা দিন দিন কমছে এবং উত্তরোত্তর খ্রিস্টানের সংখ্যা বাড়ছে। লোভ দেখিয়ে এই ধর্মান্তরিত করার কাজ বন্ধ করা দরকার। মণিপুরবাসী দীর্ঘস্থায়ী, শান্তিপূর্ণ সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছেন।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর