ভারতের অধিকাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বসবাস করেন। ফাইল চিত্র।
‘সংরক্ষণ হোক আর্থিক ভিত্তিতেই’ (১৬-১১) প্রবন্ধের প্রতিবাদ না করে পারলাম না। ভারতের অধিকাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বসবাস করেন। তার মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের অন্তত অর্ধেক দলিত ও আদিবাসী মানুষ, দারিদ্রসীমার নীচে রয়েছেন। তাঁরা বংশ-পরম্পরায় চাষি, কামার-কুমোর, জেলে, মুচি, মেথর প্রমুখ। বহু প্রান্তিক জনজাতির মধ্যে এখনও শিক্ষার আলো প্রবেশ করেনি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এঁরা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। এঁরা সংরক্ষণের আওতায় আসবেন না তো কারা আসবেন? লেখক এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, অনগ্রসর শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সরকারি চাকরি পেলে তাঁরা তাঁদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, এই প্রবণতাটা উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিছু কম নয়। লেখক বলেছেন, ভোট পাওয়ার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলি দরাজ হাতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। কথাটা ঠিক নয়। আর্ত, পীড়িত, অসহায় দরিদ্র— যাঁরা শিক্ষায় সামাজিক ভাবে এখনও পিছিয়ে, তাঁদের জন্য সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। কারণ এই নিচু জাতের মানুষেরা আর্থিক দিক থেকেও অনেক পিছিয়ে। উচ্চবর্ণের আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষদের ১০% সংরক্ষণের আওতায় আসাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি নিম্নবর্ণের মানুষের জন্যও সংরক্ষণ থাকুক।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
নীতি ও প্রয়োগ
সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামাজিক ন্যায় ও আর্থিক মানোন্নয়নকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তারই সুফল হিসাবে স্বাধীন দেশে সমাজে অন্যদের থেকে তুলনামূলক ভাবে আর্থিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষরা স্বাবলম্বী হয়ে শিক্ষা ও সচেতনতার যৌথ সুফল পাচ্ছেন। তার পাশাপাশি নিদারুণ দারিদ্রের নাগপাশ কেটে আত্মবিশ্বাসী নাগরিক হয়ে তাঁরা দেশ ও দশের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম শরিক হতে পেরে গর্ববোধ করেন।
তবে সংরক্ষণের সুফল সুচারু ভাবে কাজে লাগাতে কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনকেও হয়তো বিশদে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে ব্যতিক্রমী ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। সরকারি চাকরিতে প্রাপ্ত সুবিধা গড়পড়তা বেসরকারি চাকরির থেকে বেশি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সংরক্ষণের কারণে চাকরি পাওয়া ব্যক্তির সামাজিক ও আর্থিক মানোন্নয়ন হয়। তিনি স্বচ্ছন্দে তাঁর পরিবারের জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান নিশ্চিত করতে পারেন। সেই সঙ্গে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দ্বিধাহীন ভাবে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে পারেন। সন্তানদের দিতে পারেন সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চিত আশ্বাস। তবে সমাজের বাকি অংশের কাছে সংরক্ষণের সুবিধা সমান ভাবে পৌঁছে দিতে একটা বিকল্প ভাবনা ভাবা যেতেই পারে।
ধরা যাক, সংরক্ষণের কারণে প্রতি বছর সারা দেশে গড়ে ৫০ হাজার মানুষ সরকারি চাকরি পান। তাঁদের উপর নির্ভরশীল তাঁর পরিবারের সদস্য বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংরক্ষণের তালিকা থেকে বাদ দিলে একটু হলেও প্রতিযোগিতা কমবে এবং সমাজের বাকি মানুষদের কাছে আর্থ-সামাজিক উন্নতির সুফল পাওয়ার সুযোগ অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সংরক্ষণের সুবিধা পেলেও একই তালিকাভুক্ত মানুষের মধ্যে কেউ কেউ ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা দিতে পারবেন, আবার সংরক্ষণের তালিকায় থেকেও আর্থিক ক্ষমতা না থাকায় অন্য অনেকে সন্তানদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করতে পারবেন না। ফলে সংরক্ষণের তালিকাভুক্ত হয়েও এক জন হবেন রাজকর্মচারী, অন্য জন হবেন পূর্বপুরুষের পেশা অনুসরণ করে— ইটভাটার শ্রমিক অথবা জনমজুর।
তবে এই নীতি রূপায়ণের চিন্তাভাবনা করা সহজ হলেও বাস্তবায়িত করা মোটেও সহজ নয়। এর জন্য সরকারি ভাবে পদক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে, আমজনতাকেও ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নের কথা ভেবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে হবে। অন্যথায় সংরক্ষণের সুফল সকলের কাছে পৌঁছবে না।
দেবজিৎ রায়, দশঘরা, হুগলি
খুড়োর কল
অমল মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি প্রণিধানযোগ্য। সংরক্ষণ বলতে মূলত কর্মসংস্থান ভিত্তিক সংরক্ষণকেই বোঝানো হয়ে থাকে। তবে যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত করে দেওয়া হচ্ছে, বেশি মুনাফার লক্ষ্যে কর্মী সঙ্কোচন অব্যাহত, সেখানে সংরক্ষণকে বলা যেতে পারে এক প্রকার ‘খুড়োর কল’। বস্তুত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি-জনজাতি এবং এ জাতীয় আরও কিছু ক্ষেত্রকে বেছে নেওয়ার যে পদ্ধতি, যা সংবিধান স্বীকৃতও বটে, সেখানে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য সব সময় পূরণ হয় না। এখানেও দেখা যায় সংরক্ষিত বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উচ্চবিত্তরাই মূলত এই সুযোগ সর্বাধিক নিতে সক্ষম হন। নীচের তলার মানুষরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীচের তলাতেই পড়ে থাকেন।
তা ছাড়া আর্থিক দিক থেকে অগ্রসর বা অনগ্রসর কারা, তা নির্ধারণ করা যত সহজ, প্রকৃত তফসিলি জাতি-জনজাতির ক্ষেত্রে ততটা সহজ নয়। কেন না অর্থের জোরে ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’-ও কখনও কখনও তফসিলি জাতি-জনজাতি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির তালিকার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ভিত্তিই সর্বাগ্রগণ্য হওয়া উচিত। এ দেশে জাতপাতের ভেদাভেদ বা বিদ্বেষের একটা কারণ এখানেও নিহিত রয়েছে, যা কোনও ভাবেই কাম্য নয়।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
বৈষম্য কমবে?
অন্যায় সুযোগ দিলে তা ফেরানো খুব মুশকিল। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? সরকার চাইলেও সংরক্ষণ তুলতে পারবে না। বরং প্রতি বছরই নতুন নতুন জাতি সংরক্ষণের আওতায় ঢুকছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, ৫০ শতাংশের উপরেও সংরক্ষণ আনা যেতে পারে। জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের তুলনায় আর্থিক সামর্থ্যের ভিত্তিতে সংরক্ষণ আনাটা অনেক যুক্তিসম্মত। কিন্তু জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে বংশানুক্রমে সংরক্ষণের আওতায় থাকা সমস্ত সুযোগসুবিধা পেয়ে যাওয়াটা বৈষম্য কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দেয়। এতে মেধারও অপচয় হয়। কাজেই সরকারের উচিত প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সংরক্ষণের তালিকার পুনরালোচনা করা। যাঁরা সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে সরকারি চাকরি পেয়ে যাবেন, তাঁদের সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দিয়ে নতুনদের সুযোগ দেওয়া উচিত। এবং এই সংরক্ষণ জাতিভিত্তিক না হয়ে অবশ্যই আর্থিক সামর্থ্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। আর্থিক সামর্থ্য নির্ধারণের জন্য অবশ্যই কিছু শর্তাবলি থাকবে। যেমন, মা কিংবা বাবা সরকারি চাকুরে হলে সন্তান অবশ্যই সংরক্ষণের সুযোগ পাবে না। আয়কর সীমার ঊর্ধ্বে থাকলে বা পাকা বাড়ি, গাড়ি, এসি এক সঙ্গে থাকলে তাঁরা অবশ্যই সংরক্ষণের বাইরে থাকবেন। আবার, সন্তান দুইয়ের অধিক হলে পরিবারটি সংরক্ষণের সুবিধা পাবে না। একই ভাবে, সংরক্ষণ ছাড়াও সরকার অনেক রকম সুবিধা নাগরিকদের প্রদান করে। কিন্তু নারীপুরুষ নির্বিশেষে বিনাশর্তে মাসে মাসে অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়াটা শুধুমাত্র করদাতাদের প্রতি অবমাননাই নয়, সরকারি টাকার অপচয়। সেই টাকায় সরকার অনেকের কর্মসংস্থান করতে পারত, রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল-সহ পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করতে পারত। এতে কর্মসংস্থানও হত, সামগ্রিক উন্নয়নের হাত ধরে আরও বিনিয়োগ, শিল্প, কল-কারখানা তৈরির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেত। কিন্তু সরকার খেলা, মেলা আর খয়রাতির রাস্তা গ্রহণ করে সেই সম্ভাবনা সমূলে নষ্ট করছে।
কৌশিক সরকার, রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া