২০১০ সাল। আমি তখন কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা। হঠাৎ কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক থেকে একটি চিঠিতে জানতে পারলাম, সরকার একটি বড় মাপের গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী। আমাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারি রাজস্বব্যবস্থা এবং অন্যান্য নীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণী গবেষণা হবে সেখানে। খুশি হওয়া এবং অবাক হওয়ার পালা শেষ হল। আমার সহকর্মী জ্যোৎস্না জালান আর আমি মিলে একটি খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করলাম। সরকারি আমলাদের সঙ্গে কথোপকথন শুরু হল।
জানতে পারলাম, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই এটা সম্ভব হচ্ছে। আমলাকেন্দ্রিক কিছু জট ছাড়ানোর তাগিদে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এক বার দেখা করার প্রয়োজন হল। দেখা করার সময়ও পেলাম, তাঁর দিল্লির বাসভবনে। সময়: রাত বারোটা।
গিয়ে দেখি অনেকে বসে আছেন। শুনলাম, সারা দিন কাজকর্ম সেরে তিনি রাত দশটা থেকে সরকারি কাজে সাক্ষাতের জন্য অনেককে সময় দেন। যে কথাটি প্রায় ছ’মাস ধরে আমলারা বুঝছিলেন না, তিনি মিনিট পনেরোয় বুঝে গেলেন এবং এক মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হল সেন্টার ফর ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইন পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি।
তবে সেখানে ওই রাত্রিবেলায় তাঁর সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম, তিনি রাত দুটোর সময়ে প্রায় শিশুর মতো আহার করেন। এবং প্রতি দিন নিয়মিত ভাবে আহারের পর ডায়েরি লেখেন— সে দিন কী ঘটল, সে-সম্পর্কে। অত রাতে বিশ্রামের সুযোগ হলেও নিয়ম করে একেবারে সকালের দিকে অফিসে যান। এ-ও শোনা গেল যে, তিনি কত সহজে কতখানি পথ ভ্রমণ করে এসেও ওই রাত বারোটায় লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন।
কিছু বছর পরে, তখন আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে কাজ করছি, প্রণববাবু তাঁর প্রথম কাজের জায়গা, দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি কলেজে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সেখানে সে দিন মহোৎসব। রাষ্ট্রপতির কলেজ বলে কথা। প্রচুর ভিআইপি-র সমাগম। মন্ত্রী, সাংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রমুখ। আমার সঙ্গে ওঁর কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ আর হয়নি। প্রয়োজন হয়নি। প্রিন্সিপালের ঘরে দু’টি চেয়ারের একটিতে মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং অন্যটিতে মাননীয় রাজ্যপাল। বাকি সবাই দর্শক আসনে। আমিও ছিলাম।
প্রণববাবু এলেন, বললেন, রাজ্যপাল তাঁর পাশে। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেলেন। কর্মকর্তাদের বললেন তাঁর পাশে আর একটি চেয়ার দিতে— অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য, সুগত মারজিতের জন্য নয়। কিন্তু এ যুগে এ রকমটা সচরাচর হয় কি?
রাজনীতির তাবড় তাবড় মানুষকে দেখেছি। অনেকেই মাঝেমধ্যে সৌজন্য হারিয়ে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে আরও এক জনের কথা বলতে হয়। এ রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে নমস্কার জানিয়েছিলেন এবং আমি চেয়ারে না-বসা অবধি বসেননি। শিক্ষকদের সম্মান দেওয়াটা অন্য একটা যুগকে নির্দেশ করে। প্রণববাবু সেই অন্য যুগের মানুষ ছিলেন।
সুগত মারজিৎ, কলকাতা-২৯
বৈচিত্রে জোর
যে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের সভাপতিত্ব করতেন, ইন্দিরা হত্যাকাণ্ডের পর তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে উন্নীত না করে, দল থেকেই অপসারিত করা হয়েছিল! ২০০৪ এবং ২০০৯ সালেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তবুও বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকে তাঁর দক্ষ পরিচালনা, বিশাল ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রণব মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে সেই প্রচলিত কথার সত্যতার বার্তাই বহন করে— ‘‘দ্য বেস্ট প্রাইম মিনিস্টার ইন্ডিয়া নেভার হ্যাড।’’
ভারতীয় রাষ্ট্রপতিরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘রাবার স্ট্যাম্প’-এর ভূমিকা না নিয়ে প্রণববাবু সোজা কথা সোজা ভাবেই উচ্চারণ করেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারকে অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন বার বার। রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর গৌরবময় ইনিংস সমাপ্ত করার পরও প্রণববাবু জাতির বিবেকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। নাগপুরে আরএসএস-এর মঞ্চে তাঁর ভারতকেন্দ্রিক আলোকিত বক্তব্যটি অবিস্মরণীয়। তিনি ভারতের জাতিগত-ভাষাগত বৈচিত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভারতরত্ন প্রাপ্তির পর প্রণববাবু টুইট-এ বলেন, তাঁর সম্মান বস্তুত সেই লক্ষ লক্ষ মানুষেরও সম্মান, যাঁরা প্রতি দিন ভারতকে বৈচিত্রপূর্ণ, বহুত্ববাদী, সংবেদনশীল এবং উদার এক দেশের আদর্শে গড়ে তুলছেন। তিনি নাগরিক, এই ছিল তাঁর সর্বোচ্চ পরিচয়। নম্র, দায়িত্ববোধসম্পন্ন এই মানুষটির চিন্তাধারা থেকে এই দেশের সত্যিই অনেক কিছু শেখার আছে।
কাজল চট্টোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
বাংলার জন্য
সেটা ১৯৯৩ সাল। আমি তখন সেচ ও জলপথ দফতর, মহাকরণে কর্মরত। এক দিন তদানীন্তন মুখ্য বাস্তুকার নির্মল ভট্টাচার্য বললেন, আমি এক বছরের মধ্যে অবসর নেব, তার মধ্যে সুবর্ণরেখা ব্যারেজটা করে ফেলতে চাই। কিছুতেই দিল্লি থেকে এই প্রজেক্টের জন্য পরিবেশ দফতরের অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে এটা করিয়ে আনতে হবে। বিহার আর ওড়িশা এই প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। আমরা শুরুই করতে পারলাম না। তাঁর কথামতো, আমি রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন-এর তরফ থেকে গেলাম দিল্লি। নির্মলবাবুও গেলেন সঙ্গে।
প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন বাণিজ্যমন্ত্রী। আমাদের অনুরোধে তিনি এক দিন পর বিকেল সাড়ে চারটেয় সময় দিলেন। সুবর্ণরেখা ব্যারেজ প্রকল্পের অবস্থার কথা শুনলেন, আমাদের স্মারকলিপির উপরে বিস্তৃত নোট লিখে দিলেন, যাতে প্রস্তাব দ্রুত পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র পায়। সত্যিই খুব অল্প দিনের মধ্যে ছাড়পত্র মিলল। অত উচ্চপদে থেকেও যে সৌজন্যবোধ, বাংলার জন্য যে আবেগ-উৎসাহ ও আন্তরিকতা তিনি দেখিয়েছিলেন, তা তাঁর পক্ষেই সম্ভব।
মনোজ চক্রবর্তী, প্রাক্তন সভাপতি, রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন
ছুটি কেন
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করল। বরেণ্য ব্যক্তিদের প্রয়াণে ছুটি কাটানো শোকপালনের একটা রীতি। অবাক লাগে, যে মানুষটি ছিলেন আদ্যন্ত কাজের, কাজ ছাড়া যিনি অসহায় বোধ করতেন, তাঁর প্রয়াণে কর্মহীন হয়ে থাকব কেন! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণববাবুর সঙ্গে তাঁর শেষ ফোনালাপের কথা লিখেছেন, যেখানে প্রণববাবু আক্ষেপ করেছেন, কাজ নেই, তাই তাঁর ভাল লাগছে না। তার পরও রাজ্য তাঁরই প্রয়াণের পরের দিনটি কাটাল কর্মহীন হয়ে।
অরিত্র মুখোপাধ্যায়, চাতরা, শ্রীরামপুর
কর্তব্যের বোধ
দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পর প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সে দিন তিনি বলেছিলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক মানুষদের কর্তব্য ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে। তিনি বলেন, ‘‘বাঙালি রাষ্ট্রপতি বলে হয়তো বাঙালিরা আমার কাছে অনেক কিছু আশা করছেন। বস্তুত আমি সাংবিধানিক প্রধান, সেটি রক্ষা করাই আমার প্রধান এবং একমাত্র কর্তব্য।’’ নিষ্ঠা ও সঙ্কল্প মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তিনি তার দৃষ্টান্ত।
বিশ্বজিৎ বসু, কলকাতা-৭৪
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।