—প্রতীকী চিত্র।
মোহিত রায়ের ‘পুজোয় চাই নতুন ভাবনা’ (১১-১০) প্রবন্ধে উল্লিখিত ভাবনায় প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই শরিক হবেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখক যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে, আগে মহালয়ার দিন থেকে শুরু হয়ে পুজোর মণ্ডপ শেষ হত সপ্তমীর সকালে। এর ফলে রাস্তা, খেলার মাঠ বা বিদ্যালয় সংলগ্ন অঞ্চল দখল করে যে পুজোর আয়োজন, তাতে খুব বেশি হলে ১২-১৪ দিন অসুবিধার সম্মুখীন হতেন এলাকার মানুষ। সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য মণ্ডপের পাশেই আয়োজকেরা কিছুটা জায়গা রেখে দিতেন। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মণ্ডপে প্রতিমা রাখার দিন যেমন বেড়েছে, তেমনই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মণ্ডপের পরিসর, রাস্তা জুড়ে আলো ও মেলা, এবং বাড়ির দরজা-জানলা আটকে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। অনেক জায়গাতেই মণ্ডপ দিয়ে ব্যাঙ্ক বা বিভিন্ন অফিসের যাতায়াতের পথ এমন ভাবে আটকে দেওয়া হয় যে, দৈনন্দিন প্রয়োজনে যাতায়াতে অসুবিধা হয়। এই দুর্ভোগ চলতে থাকে মাসাধিক কাল। রাজ্য সরকার পুজো-কমিটিগুলোকে আর্থিক সাহায্য করে রাজনৈতিক লাভ করে, কিন্তু মানুষের দুর্ভোগের দায় নেয় না।
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্কের ১০২ তলা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং অবিশ্বাস্য গতিতে মাত্র ১ বছর ৪৫ দিনে শেষ করার নেপথ্যে প্রধান কারণ ছিল, কোনও ভাবেই মহানগরের প্রধান রাজপথ বন্ধ করা যাবে না, এবং অফিস ও দোকানপাটের সামনে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। পুজোর বেলায় যেন উল্টোটাই সত্যি। এই ‘সংস্কৃতি’ রাতারাতি বদলে যাবে, এই দুরাশা না করাই ভাল। রাজনৈতিক কারণেই কোনও বিরোধী দল এই নিয়ে সরব হবে না। এই অনৈতিক পরিস্থিতি মেনে নিতে তাই বাধ্য সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য সমস্ত পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
বিস্মৃত কর্তব্য
প্রাক্-পুজো পর্বে পারিপার্শ্বিক তথা পরিবেশের উপর যে অকথ্য আক্রমণ চলে, মোহিত রায় তা স্পষ্ট বলেছেন। প্রতি বছর এই দুঃসহ পরিস্থিতি নীরবে-মুখ বুজে সহ্য করাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে, একক ভাবে প্রতিবাদ করবেন? বরং অসন্তোষ নীরবে সয়ে যাওয়াটাই এখন রেওয়াজ। তাতে বিপদের সম্ভবনা কম।
এমনটা কি ছিল বরাবর? না কি থিমপুজো এসে দিন সাতেকের পুজো আয়োজনকে দু’-তিন মাসে টেনে নিয়ে গেছে? স্পনসরদের আধিক্য এবং অজানা-উৎস থেকে অর্থের আমদানি ব্যতিরেকে এমন মহাসমারোহে পুজো করা যে অসম্ভব, তা-ও আন্দাজ করা যায়। দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত মন্দির বা বুর্জ খলিফার ধাঁচে মণ্ডপ করার জন্য প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে যায় তিন-চার মাস পূর্বেই। জনসাধারণের চরম ভোগান্তি, সে দিকে কর্ণপাত কে করবেন? আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরম বা নাকানি-চোবানি খাওয়া বর্ষায় সেলেব্রিটিদের আগমনে খুঁটিপুজোর জৌলুস বাড়ে বিজ্ঞাপনের বহরে, প্রচারে। আর খুঁটিপুজো শেষেই লরি ভর্তি বাঁশ নির্দিষ্ট অঞ্চলে জমা হতে থাকে। প্যান্ডেলকে প্রাধান্য দিতে ধীরে ধীরে পাড়ার মূল রাস্তায় কোপ পড়ে। সব বাহনকেই ঘুরপথে যেতে হয়। নির্মীয়মাণ মণ্ডপের কাছাকাছি অফিস ঘরে সান্ধ্য-আড্ডা জমে ওঠে। প্যান্ডেল নির্মাণ যজ্ঞে, থিমপুজোর অঙ্গসজ্জায় আগত শ্রমিকদের থাকা-খাওয়া, শৌচাগারের ব্যবস্থাও করতে হবে বইকি! পাড়ার পার্ক বা ঝিলের ধারে সবেধন নীলমণি মাঠটির দখল হারান এলাকার মানুষ। শিশুদের বিকেলের খেলা, প্রাতর্ভ্রমণকারীদের নিয়মিত কয়েক পাক দেওয়ার অভ্যাস, সব ত্যাগ করতে হবে পুজো প্যান্ডেল তৈরির জন্য।
মানতেই হয়, আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা শিক্ষক-ছাত্ররা তাঁদের সৃষ্টিশীল ভাবনাগুলো থিমের মাধ্যমে সুন্দর ভাবে তুলে আনছেন। থিমের দৌলতে আমাদের চিরচেনা মৃন্ময়ী কেমন অচেনা হয়ে ধরা দেন, তা-ও অনস্বীকার্য। বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি বলে আমাদের গর্ব হয়। কিন্তু, বিধি-নিষেধ বহির্ভূত দু’-তিন মাসের অত্যাচারের হাত থেকে জনগণকে রেহাই দেওয়া, যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরিবেশ বিধিকে মান্যতা দেওয়াও যে পুজো-উদ্যোক্তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, তা বিস্মৃত হলে আখেরে সচেতন জনগণের আন্তরিক সমর্থন থাকে না।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
ছাড়পত্র
‘আতঙ্কের উৎসব’ (১৯-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। এক পক্ষ কাল জুড়ে শহর ও মফস্সলের নামীদামি পুজো কমিটিগুলির বিপুল আয়োজনে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মানবিক গুণের বর্জনই যেন আজ একমাত্র লক্ষ্য। জৌলুসহীন পুজো দিয়ে মনোরঞ্জন সম্ভব নয়, শিশু নাগরিকরাও এ কথা জানে। কিন্তু প্রত্যাশার পারদ চড়তে চড়তে সব সীমা লঙ্ঘন করেছে। একে রুখবার শক্তি এবং সদিচ্ছা প্রশাসন অথবা সরকার কারও নেই।
অতীতের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর আঙ্গিক বদলে এখন থিমপুজোর রমরমা। বিজ্ঞাপন এবং পুরস্কারের আতিশয্যে মাতৃবন্দনা গৌণ, মুখ্য বিষয় পুজো-কমিটিগুলির মধ্যে চলে প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা। সপ্তমী পুজোর চার দিন আগে থাকতেই রাস্তা জুড়ে মঞ্চ বেঁধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুজো উদ্বোধনে ভিআইপি নেতানেত্রীদের আসার তোড়জোড়। গগনবিদারী ডিজে মাইক, বাঁশের অস্থায়ী ব্যারিকেড খাড়া করে মূল রাস্তায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, সবটাই চলে প্রশাসনিক অনুমোদনে। কারণ, প্রতিটি বিখ্যাত পুজোর উদ্যোক্তাদের দমকল, পুলিশ-সহ প্রতিটি অত্যাবশ্যক বিভাগের ছাড়পত্র লাগে, এবং তারা তা পেয়েও যায়। এই ভাবেই চলে আসছে বিগত কয়েক দশকের বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। প্রাণসংশয় হয়েছে যে রোগীর, তাঁকেও অপেক্ষা করতে হয় ভিড় হালকা হওয়ার জন্য। অপেক্ষা প্রাণ কেড়েও নেয়। যে পরিবার তার কাছের মানুষটিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে, তাদের কাছে এই উৎসব আতঙ্কের। এই মোচ্ছবের আয়োজনের বিপরীতে রয়েছে অসুস্থ মানুষের যন্ত্রণা।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
বিজয়ার রূপ
এক সময়ে আপনজনদের চিঠির মাধ্যমেই বিজয়ার শুভেচ্ছা এবং প্রণাম নিবেদন করা হত। পাড়ায় চিঠি বিলি করা পিয়ন এলেই ছুটে যেতাম। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত, বিজয়ার চিঠি কে কতগুলো পেয়েছি। আজ মুঠোফোনের দৌলতে নবমীর রাত্রি বারোটার পর থেকেই সমাজমাধ্যম ভরে যায় বিজয়ার শুভেচ্ছা বার্তায়। কোথাও বিসর্জনের ছবি, কোথাও বা সিঁদুর খেলার ছবি, অথবা মা দুর্গাকে মিষ্টিমুখ করানোর ছবি, সঙ্গে বিভিন্ন আঙ্গিকে লেখা শুভেচ্ছা। হাতে-লেখা চিঠিতে আলাদা মাধুর্য থাকে, এবং তা পাঠ করলে দূরের মানুষটিও কাছে বসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে বলে অনুভূত হয়। মোবাইলের মেসেজ পড়ে তা হয় কি?
তিন দশক আগে পর্যন্ত দশমীর দিন স্থানীয় ক্লাব অথবা বনেদি বাড়িগুলিতে চোখে পড়ত, পাটকাঠিকে কলমের রূপ দিয়ে, আলতা দিয়ে কলাপাতা অথবা তালপাতায় তিন বার ‘শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা সহায়’ লিখে পুকুরে ভাসানো হচ্ছে। তার পরেই এক গেলাস করে সিদ্ধি জল ও নারকেলের তৈরি সন্দেশ দিয়ে মিষ্টিমুখ। এখন গ্রামে গৃহস্থের বাড়ি নারকেল গাছ কোথায় যে, নারকেলের মিষ্টি তৈরি হবে? এখন দোকান থেকে রংবেরঙের সন্দেশ এনে অভ্যাগতদের দেওয়া হয়। অবশ্য মিষ্টিতে পরিবর্তন এলেও গুরুজনদের প্রণাম এবং ছোটদের আশীর্বাদ প্রদানের ধারা এখনও একই ভাবে বয়ে চলেছে।
শ্রীমন্ত পাঁজা, গঙ্গাধরপুর, হাওড়া