অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ধারালো হচ্ছে চাঁদের কাস্তে’ (৪-৩) শীর্ষক প্রবন্ধটি এই সময়ের উপর সুলিখিত। গত লোকসভা নির্বাচনের পরে বিজেপির উত্থানের পিছনে ছিল তৃণমূল দলের প্রতি মানুষের অনাস্থা, কারণ প্রবীণদের ভোট দিতে মানুষ চাননি। সেটা বামপন্থীরা বুঝতে পারেন। তাই গত কয়েকটা নির্বাচনে তরুণ রক্তকে ঢালাও ভাবে ভোটের ময়দানে নিয়ে আসে। কিন্তু শাসকের ঝড়ে তারা উড়ে চলে গেলেও, এখনও পর্যন্ত সেই নীতিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বামেরা। আমরা দেখছি কী ভাবে সামান্য হলেও বিরোধী জমি তারা ফিরে পাচ্ছে।
বিজেপির ভবিষ্যৎ কী? আসলে একটা দল মাঠে মারামারি বা সামান্য আন্দোলন (যার মধ্যে বিষয় ছিল কম, গোলমালের প্রবণতা ছিল বেশি) করে বেশি দিন মানুষের চোখে শাসক দলের বিকল্প হয়ে থাকতে পারে না। বিজেপির পক্ষে যে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পড়ে থেকে লম্বা আন্দোলন সম্ভব, সে কথা এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না, কারণ নেতার অভাবে তারা ভুগছে। প্রয়োজন ছিল এমন নেতা, যিনি বিরোধী আন্দোলনের কারিগর হতে পারতেন। অন্য দিকে, পর পর নানা প্রশ্নে আন্দোলন করেছেন বামপন্থীরা, সে স্কুল খোলার বিষয় হোক বা আনিস খানের মৃত্যু। এতে তাঁদের প্রতি মানুষের বিশ্বাস সামান্য হলেও ফিরেছে। শুধু সাংবাদিক সম্মেলন করে, আর দিল্লি থেকে নেতা নিয়ে এসে যে বিরোধী রাজনীতি হয় না, তা যত শীঘ্র বিজেপি বুঝবে, তত গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল।
অভিজিৎ চক্রবর্তী
বালি, হাওড়া
দমনই নীতি
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় খুব প্রাঞ্জল ভাষায় রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ও শাসকের চিরাচরিত শাসনপদ্ধতির উপর আলোকপাত করেছেন। এ কথা ঠিক যে, শাসক পক্ষের একাধিপত্য স্থাপিত হলে ফ্যাসিবাদের জন্ম প্রায় সুনিশ্চিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিংবা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয় না। বিপ্রতীপে জনমত, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে ওঠে বটে, কিন্তু সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রশক্তি প্রাণপণ চেষ্টা চালায় বিরুদ্ধ মতাদর্শকে দমন করার। প্রবন্ধে সম্প্রতি আনিস খানের রহস্যমৃত্যু উল্লিখিত হয়েছে, সেই সঙ্গে বিরোধী পক্ষের আন্দোলনের বিষয়টিও উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন হল, শাসক-বিরোধী তরজার নিরিখে এতে নতুনত্ব কী রয়েছে? বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় আসার পূর্বে ভিখারি পাসোয়ানের মৃত্যু রহস্যের সমাধান অধরাই থেকেছে। তাই চাপানউতোর চলতে থাকবেই। আজকের বিরোধীরা শাসকপক্ষে গেলে রাতারাতি সব কিছু আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। হয়তো এটাই সেই সব শাসকের চরিত্র, যারা বিরোধিতা অপছন্দ করেন।
প্রবন্ধকার নির্বাচনে শাসক দলের একাধিপত্য প্রদর্শনে পেশিশক্তি প্রয়োগের কথা বলেছেন। কিন্তু কোথাও এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে, এক শাসক বিদায় নিলে অপর শাসক নিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠবেন? আজকের শাসক আগামী দিনে বিরোধী হবেন, বিরোধীরা হবেন শাসক। বিদায় নেবে না শাসনপদ্ধতি। যেখানে প্রতিবাদ প্রতিরোধ একেবারেই বরদাস্ত করা হয় না।
রাজা বাগচি
গুপ্তিপাড়া, হুগলি
গণতন্ত্রের খোলস
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই পত্রের অবতারণা। এই নয় যে, মাত্র গত এক দশক ধরে আমরা ক্ষমতার আস্ফালন দেখছি। ভারতীয় রাজনীতির সুগভীর অন্তঃস্থলে যে সামন্ততান্ত্রিক ভাবনায় জারিত ক্ষমতার জাদুকাঠিটি লুকিয়ে আছে, প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতে কোনও শাসক দলই দ্বিধা করেনি। তফাত হল, আগে যার ব্যবহার ছিল সীমিত, এখন তা ব্যবহৃত হচ্ছে অহরহ, বেআব্রু ভাবে। ক্ষমতার সঙ্গে পীড়নের যে আত্মীয়সুলভ বন্ধন, তা উপলব্ধি করা যায় যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলে বলীয়ান দুঃসাহসীরা কোনও এক আন্দোলনরত প্রতিবাদকারীকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকাশ্য রাজপথে খুন করতে দ্বিধা বোধ করে না। অথবা, গভীর রাতে কারও বাড়িতে হানা দিয়ে প্রতিবাদীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদত না থাকলে আইনরক্ষকদের পক্ষে বিরোধী নেতাদের খুনের মামলায় জর্জরিত করে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করাও সম্ভব নয়। নির্বিচার মিথ্যাভাষণে তারা আদালতের পরিবেশকে কলুষিত করে। এ দেশের অন্তঃসারশূন্য গণতন্ত্র যে আধিপত্যবাদীদের সোপানে পরিণত হয়েছে, এটা বুঝতে জটিল কোনও গবেষণার প্রয়োজন নেই।
সারসত্য শাসকরা বুঝে গিয়েছেন— জনগণকে দ্বন্দ্বহীন ‘জনপিণ্ড’-এ পরিণত করো, অথবা নাগরিক সত্তা থেকে তাকে রূপান্তরিত করো ‘প্রজা’ সত্তায়। এই চক্র থেকে কে দেখাবে মুক্তির আলো?
পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৩৪
শাসকের চরিত্র
অনেক দিনের জড়তা কাটিয়ে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ডেউচা-পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্প, ও আনিস খানের মৃত্যুর বিরোধিতায় পথে নেমেছে। এতে শাসকের অস্বস্তি হওয়ায় বিস্ময়ের কিছু নেই। যে কোনও আন্দোলন শাসকের পথ কণ্টকাকীর্ণ করে। শাসক কঠোর হতে বাধ্য হন। এমন আন্দোলন শিল্পের বিরোধী, তবু তা মানুষের জীবনে অপরিহার্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সঠিক বলেছেন, “আমাকে কেউ যেন আন্দোলন না শেখায়।” প্রকৃতপক্ষে, তাঁর পুরো বিরোধী রাজনৈতিক জীবন আন্দোলন সমৃদ্ধ। তাই অন্যরাও ক্রমে ক্রমে আন্দোলন শিখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস বলছে, যে নেতা আন্দোলন করতে করতে শাসক হয়েছেন, তিনিই আবার বিরোধী আন্দোলনের মুখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। শাসকের আসনে লোক পাল্টায় কিন্তু শাসকের চরিত্র একই থাকে। রাজ্য সরকারের বিরোধী হয়ে যায় ‘উন্নয়ন-বিরোধী’ আর ভারত সরকারের বিরোধিতা করলে সে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ও ‘পাকিস্তানের বন্ধু’। তাই হয়তো মানুষ ‘চাঁদের কাস্তে’-তে প্রত্যাবর্তন করছেন ধীরে ধীরে।
তপন কুমার দাস
কলকাতা-১২২
অকারণে ওষুধ
সুগত মারজিৎ তাঁর ‘সুখী জীবনের মাসুল?’ (২৮-২) প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন যে, সামান্য অসুখে একগাদা ওষুধের প্রয়োগ মানুষকে দুর্বল করে দেয়। আগে সর্দিকাশি থেকে রেহাই পেতে তুলসী, বাসক পাতা, মধু, এই সব ব্যবহার করা হত। জ্বর হলে কপালে জলপটি ও মাথায় বাতাস করে প্রাথমিক ভাবে তা কমিয়ে, উষ্ণ জলে গা মুছিয়ে দেওয়া হত। দিন দুয়েক পর ভাল না হলে তবে মানুষ শরণাপন্ন হতেন চিকিৎসকের। একান্ত বাধ্য না হলে কোনও চিকিৎসকই অ্যান্টিবায়োটিক্স প্রয়োগ করতেন না। সামান্য কেটে গেলে গাঁদাফুলের পাতা, বা রসুন থেঁতো করে ক্ষতস্থানে লাগানো হত। ব্যথায় আকন্দের পাতা গরম করে সেঁক দেওয়া হত। মচকে গেলে দেওয়া হত চুন-হলুদের প্রলেপ। কোষ্ঠকাঠিন্যে বেল সেদ্ধ, আবার বেশি পেট খারাপ হলে বেল পোড়া বা গাঁদাল পাতার ঝোল। আজ বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার ব্যবসাবৃদ্ধির তাগিদে মুড়িমুড়কির মতো প্রয়োগ হয় ওষুধ। মানুষ হয়তো চটজলদি রেহাই পান কষ্ট থেকে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফল মারাত্মক।
অশোক দাশ
রিষড়া, হুগলি