বিশ্বজিৎ রায়ের ‘আমাদের টনক নড়েছে কি’ (১৫-৩) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়লাম। লেখাটির উদ্দেশ্য মনে হল দু’টি। প্রথমত, বাংলা ভাষাকে আরও সহজবোধ্য করা, যা অতি সাধারণেরও বোধগম্য হয়। দ্বিতীয়ত, সরকারি কাজে আরও বেশি করে বাংলার ব্যবহার ও অবশ্যই তা যেন সকলের বোধগম্য হয়। বর্তমানে অবশ্য সরকারি কাজে যথেষ্ট বাংলা ভাষার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সর্বসাধারণের বোধগম্য হয় না। ইদানীং বাংলা ভাষা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বেশ বড় ধাক্কা খাওয়ার কারণ অবশ্যই সবার হাতে হাতে মোবাইলের যথেচ্ছ ব্যবহার। এতে পূর্বের মতো চিঠি লেখার অভ্যাস লুপ্ত হওয়ায় বাংলায় সুসংবদ্ধ লেখা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
অতীতে বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-প্যারীচাঁদ, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষাকে সাধারণের ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের চতুর্দিকে চোখ-কান খোলা রাখলে বাংলা ভাষা প্রয়োগের যে কদর্য রূপ ধরা পড়ে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। রাস্তার দু’পাশে দোকানের নাম ও দ্রব্যাদির বর্ণনার বানান ত্রুটিপূর্ণ। সরকারি বিজ্ঞপ্তিগুলিতে অসংলগ্ন বাংলা ও বানান ভুল। টেলিভিশনে তথাকথিত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের নিম্নমানের শব্দ প্রয়োগ কিংবা অপ্রাসঙ্গিক কথা, যা আমরা শুনতে বাধ্য হই।
লেখক প্রশ্ন তুলেছেন— এক জন বাঙালি নাগরিক যিনি কেবল বাংলাই জানেন, তিনি কি খুব সহজে নিজে-নিজেই পশ্চিমবঙ্গের এটিএম থেকে বাংলা ভাষার নির্দেশ পড়ে টাকা তুলতে পারবেন? তা বোধ করি পারবেন। ইদানীং মানুষকে এতটা বোকা ভাবা মনে হয় ঠিক নয়। এখন খেয়াল করলেই দেখা যায় স্বল্পশিক্ষিত মানুষের হাতেও মোবাইল। এবং এটা সম্পর্কে তাঁরা বেশ ভাল ভাবেই ওয়াকিবহাল। তবে বাংলা ভাষাকে সর্বজনীন করতে হলে মনে হয় ভাষাটির বানান আরও সহজ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন এতগুলি বর্ণের মধ্যে যেগুলি সহজেই বাদ দেওয়া যায়, তা শীঘ্রই কার্যকর করা। যেমন, এত ণত্ববিধি-ষত্ববিধির বেড়াজাল মুক্ত করে, একটি করে ন, স, ই, উ রাখা। এটা অবশ্যই বাংলা ভাষাবিদরা আরও ভাল বুঝবেন। এতে অবাঞ্ছিত বানান সমস্যা থেকে বাংলা ভাষা মুক্ত হতে পারবে। বস্তুত, বাংলা বর্ণমালা বহুকাল ধরে একই রয়ে গিয়েছে, যা বর্তমানে সংস্কার করা প্রয়োজন। ভাষার জটিলতা মুক্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। নইলে দোকানের নাম ‘আশীর্বাদ’ এর স্থলে ‘আশির্বাদ’ দেখতে হবে। আর এ সবেই আমরা অভ্যস্ত হতে থাকব।
তপন কুমার দাস
কলকাতা-১২২
সক্রিয়তা চাই
বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বজিৎ রায়ের প্রবন্ধটি সামনে রেখে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। ভাষা টিকে থাকে ব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সচেতন ভাবে তাকে সমৃদ্ধ করার উপর। এখন কাজের ভাষা হিসাবে বাংলার অনুপস্থিতির পিছনে বাঙালির উদাসীনতা কতখানি, আর কতটা বিশেষ পরিস্থিতি, তা ভাবতে হবে। রামমোহনের কাল থেকে এক দল বড় মাপের মানুষের প্রয়াসেই বাংলা তার অঙ্গসজ্জায় গৌরব অর্জন করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জনের উৎস হিসাবে কাজ করেছে।
কিন্তু, দ্বিধাবিভক্ত এ পার বাংলায় প্রাক্স্বাধীন জাতীয়তাবাদী মননের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অথচ, কেজো বাংলারও দুর্বলতা রয়েছে। এর একটি কারণ শাসনকেন্দ্র কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরে যাওয়া— বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় টান পড়ে। হাজার দেড়েক মাতৃভাষাসমৃদ্ধ ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, কেন্দ্রীয় শাসকের দরবারে বাঙালি ও বাংলার বিশেষ ভূমিকাও কটাক্ষের শিকার। নতুন ভাষিক পরিস্থিতি সাধারণকে বাধ্য করছে অন্য ভাষা অনুশীলনে, বা একাধিক ভাষায় কোড সুইচিং-এ। কারণ, শিক্ষা-সহ নানা ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা এবং রাষ্ট্রের ত্রিভাষা নীতিতে ‘ইংরেজি ঔপনিবেশিকতার নিদর্শন’ এবং ‘হিন্দি স্বদেশি’ বলে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার সাংবিধানিক আয়োজন— রাষ্ট্রের উদ্যোগ নতুন ভাষা চর্চার পরিসর তৈরি করছে। ভিন্নভাষীর আনাগোনা বাড়ছে, রাজ্য রাজনীতির স্লোগানে আর্যীকরণ হচ্ছে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ইংরেজি, এবং রাজ্য ও কেন্দ্রের প্রধান ভাষার (যেমন, বাংলা ও হিন্দি) বাধ্যবাধকতা কেজো জীবনেও একটা জায়গা করে নিচ্ছে ফল্গুর মতো। ‘দ্বিভাষিক কথোপকথন’ রীতি গড়ে উঠছে। আমাদের ভাষাভিত্তিক রাজ্য হওয়ায় সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্র যেমন হিন্দি ব্যবহারের ফতোয়া জারি করছে, তেমনই বাংলাও হোক— তা কতখানি কাম্য, সেটিও প্রশ্নের। অর্থাৎ, বর্তমানে এক নতুন বহুভাষিক পরিমণ্ডলে রয়েছি আমরা। এ কথা ঠিক, নিজের ভাষাকে কেজো ভাষা করতে পারলেই ভাষা টিকে থাকে। এ ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সবার সচেতন ও কার্যকর ভূমিকা জরুরি। আবার, ভাষার আলালি রূপ প্রযুক্তি ও সমাজমাধ্যমের প্রভাবে নতুন রূপ নিয়েছে। এ সব খেয়াল রেখেই টনক নড়াতে হবে।
মহীদাস ভট্টাচার্য
কলকাতা-৮৪
দায়ী বাঙালিই
বিশ্বজিৎ রায়ের প্রবন্ধটি পড়ে আমার তিন দশক আগের একটি ঘটনা মনে পড়ল। দোলের দিন বসন্তোৎসব অনুষ্ঠান। সঞ্চালক এবং ঘোষক আমাদের এলাকার এক বাংলার মাস্টারমশাই। অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি মাইক মুখের কাছে নিয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, “ওহে, শব্দ-প্রক্ষেপণ যন্ত্র, ১ ২ ৩ ৪...।” উপস্থিত দর্শকবৃন্দের একটু সময় লেগেছিল অনুধাবন করতে। তার পর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন তাঁরা।
আসল কথা, কথ্য ভাষা সহজ-সাবলীল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সরকারি নির্দেশাবলির বাংলা অনুবাদ যাঁরা করেন, তাঁরা এ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবলে আমজনতা উপকৃত হবেন। ব্যবহারিক বাংলা বুঝতে গেলে যদি মাথা খাটানোর প্রয়োজন হয়, তা হলে বেগার খাটতে যাবেন কেন মানুষ? কাজ চালানোর মতো বাংলা জেনে অবাঙালিরা দিব্যি কাজ করে খাচ্ছেন, আর ‘বাংলিশ’ ভাষায় বাঙালি জ়েন-ওয়াই বাক্যের মাঝে পাঁচ-দশটা ‘বাট’, ‘কেন কি’ জুড়ে অদ্ভুত বাংলায় আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ ভারতের উদাহরণ দেওয়াই শ্রেয়। প্রয়োজনীয় কথা চালানোর জন্যও তাঁরা তামিল, তেলুগু ব্যতীত ভিন্ন ভাষার ধার ধারেন না। ও দিকে চিকিৎসার কারণে গিয়ে আনাজ বিক্রেতার সঙ্গেও হিন্দিতে কথা বলা যায়নি, এ অভিজ্ঞতা অনেকের আছে।
না, এতে প্রাদেশিকতার কোনও চিহ্ন নেই। বরং, স্বদেশি ভাষার প্রতি অমোঘ টান প্রত্যক্ষ করা যায়, যা আমরা বাঙালিরা হারিয়ে ফেলেছি। বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রথম ধাপ। রোজ এক পাতা করে অভিধান পাঠ ভাষাজ্ঞানকে উন্নত করে, সে শিক্ষা ক’জন অভিভাবক তাঁর সন্তানদের দিয়ে থাকেন? “প্রাচীন বাঙালী নিছক জ্ঞানের চর্চা করে নাই, বুদ্ধির অস্ত্রে শান দেয় নাই, এ কথাও সত্য নহে।।...কিন্তু আসল কথা হইতেছে, বাঙালী তাহার এই বুদ্ধির দীপ্তিকে সৃষ্টিকার্যে নিয়োজিত করে নাই। যেখানে জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করিয়া নবতর গভীরতর জীবনসৃষ্টির আহ্বান সেখানে, অর্থাৎ শিল্প ও সাহিত্য-সাধনায়, ধর্ম ও অধ্যাত্ম-সাধনায় সে মননের উপর নির্ভর করে নাই, বুদ্ধি ও যুক্তির নৌকায় ভর করে নাই। বরং সেখানে সে আশ্রয় করিয়াছে তাহার সহজ প্রাণশক্তি, হৃদয়াবেগ ও ইন্দিয়ালুতাকে, এবং ইহাদেরই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হইয়া সে যাহা সৃষ্টি করিয়াছে তাহা বুদ্ধিকে তত উদ্রিক্ত করে না যতটা স্পর্শ করে হৃদয়কে, প্রাণকে” (বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়)। তা হলে আমাদের কথ্যভাষার সহজিয়া ভাব, লেখ্য ভাষার দুর্বোধ্যতা মিলেমিশে যে জগাখিচুড়ি মার্কা হালের বাংলার উদ্ভব, তার জন্য দায়ী বাঙালি নিজেই।
বাঙালির ইংরেজি ভাষা প্রীতির কারণে, সমাজে কদর পাওয়ার জন্য বাংলাকে হেয় করার প্রবণতাও দায়ী টনক না নড়ার জন্য। আমরা তো নিজেদের ভাষাটাও বলতে শিখিনি। আমাদের টনক নড়বে কী ভাবে?
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি
কলকাতা-১২৫