রোমিলা থাপর তাঁর সাক্ষাৎকারে (‘ক্রমাগত স্মরণ করাতে হবে’, ১৫-৮) বলেছেন, “...পুরনো-পরিচিত জাতীয়তাবাদকে কী ভাবে নতুন করে ফিরিয়ে আনা যায়, তা একটা অতি গুরুতর চিন্তার বিষয়।” সত্যি চিন্তার বিষয়। কারণ, এ তো টাইম মেশিনে ফিরে যেতে হবে। তাতেই বা কতটা সাফল্য আসবে? প্রথমত, চরিত্র ও আঙ্গিক বিচারে বর্তমান প্রজন্মের অনেকটাই মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। দুই, জাতি-ধারণা একটা আধুনিক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অদূর ভবিষ্যতে বন্দি থাকতে পারে না। তিন, রাষ্ট্রের একক নাগরিক আজ বিশ্ব-নাগরিক। সুতরাং, পুরনো-পরিচিত জাতীয়তাবাদ নৃতত্ত্ববিদ্যার গবেষণার বিষয় হবে। আবার, পুঁজিবাদ তার স্বার্থে ফ্যাসিবাদের মোড়কে ইতিহাস বিকৃত করবে। দুটো পথই চলবে।
প্রশ্ন হল, ইতিহাসে কোনটা সত্য, আর সেই সত্য বর্তমানের কষ্টিপাথরের অভিজ্ঞতায় বিচার করার পদ্ধতি কী হবে? সেই সত্যটা বোঝাবই বোঝাব, না বুঝলে গজাল মেরে ঢোকাব বললে, যা বামপন্থীদের ক্ষেত্রে হচ্ছে, তা দক্ষিণপন্থীদের ক্ষেত্রেও হবে। ইতিহাস-নির্ভর, কিন্তু নতুন বিচারপদ্ধতি চাইছে দেশ, সমাজ, জাতিরাষ্ট্র। স্বাধীন ভারতে ১৯৯০-এর দশকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-যোগাযোগের বিশাল প্রয়োগে ধর্ম-বর্ণ-জাত-ভাষা ইত্যাদির মধ্যে এবং কায়িক শ্রম ও বৌদ্ধিক শ্রমের মধ্যে ফারাক গুলিয়ে গিয়েছে। এখানে এক সুবিধা আছে, এই সাম্প্রতিক ইতিহাসের সত্যতা সহজে বিকৃত করা যাবে না। এই বিষয়ে গবেষণা থেকে আপাত সত্যনির্ভর ইতিহাস অনেকেই বিশ্বাস করবেন। পুঁজি ও ধর্ম— কী করে একে অপরকে সাহায্য করে চলেছে, সেই প্রতিপক্ষের রণকৌশল জানতেই হবে।
রোমিলা অভিযোগ করেছেন, অনুদার সংখ্যাগুরুবাদের আদর্শের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ নেই। ঠিক কথা। কারণ, অনুদার সংখ্যাগুরুবাদ এক ভ্রান্ত আদর্শবাদ তৈরি করছে, যেখানে অর্থনীতি থেকে ‘নীতি’ শব্দকে বার করে দেওয়া হচ্ছে। স্বল্পকালীন আর্থিক কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মূল সঙ্কটকে পাশ কাটিয়ে এক অলীক দেশ নির্মাণ করা হচ্ছে, যা সহজে বিশ্বাস করাচ্ছে সংখ্যাগুরুবাদ। এই কিছু সময়ের জন্য অনেক মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার কাজ এখন চলবে।
রোমিলা চেয়েছেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষায় ডিসিপ্লিন, নাগরিক সমাজের ‘সিভিক সেন্স’ ইত্যাদির পুনর্জাগরণ। খুব মুশকিল। কারণ, সেখানে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনাকে গুলিয়ে দিচ্ছে মুনাফাসর্বস্ব প্রচারমাধ্যম। রাষ্ট্রীয় মদতে ও পারস্পরিক সহযোগিতায় সে প্রচারমাধ্যমকে আর গণমাধ্যম বলা যাচ্ছে না। এই প্রচারমাধ্যম তৈরি করছে উত্তর-সত্য বা পোস্ট-ট্রুথ। এই সত্য সঠিক, এমনটা দাবি করা যায় না, আবার বিকৃত বলাও যাবে না।
এই ‘পোস্ট-ট্রুথ’এ এক আশ্চর্য মোহ আছে। সেই মোহে মনুষ্যত্ব, আন্তর্জাতিকতাবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা, পরিবেশভাবনা যদি না থাকে, তবে সেই পোস্ট-ট্রুথ আত্মঘাতী। এটা বুঝতে গেলে চাই এক ইতিহাসবোধ, যেখানে ঠিক ‘উল্টো দিকের ইতিহাস’ শুধু লক্ষ্য ও মোক্ষ হবে না। নিজের বর্তমান অবস্থার উপর ভিত্তি করে এক আদর্শবাদ গড়ে উঠলে অবশ্যই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হবে। এখানেও অসুবিধা আছে। সেটা হল খণ্ডিত বা বহুমাত্রিক অস্তিত্ব, জাতিসত্তা। আশা করেছিলাম এই বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদের মূল্যবান পরামর্শ।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি
সমন্বয়ের সূত্র চাই
রোমিলা থাপরের সাক্ষাৎকার প্রত্যাশামতোই তাঁর সুদৃঢ় ও স্বচ্ছ মতামতে সমৃদ্ধ। তবুও কয়েকটি প্রশ্ন এমন ভাবে উঠে আসে যে, বক্তব্যটি পুরোপুরি গ্রহণ করতে কিছু অসুবিধা হচ্ছে। উনি বলছেন, “অনেকের একত্রে আসার ইচ্ছাই হল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ মানেই একটি ‘ইনক্লুসিভ’ বা সমন্বয়ী আদর্শ।” ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটির অর্থ কি সকলের কাছে খুব পরিষ্কার? সমন্বয়ের আদর্শ বা সূত্র ঠিক কী? একই সূত্রে জীবন বাঁধতে গেলে প্রথমেই ভাবতে হবে, সেই সূত্রটি সরল ও সকলের বোধগম্য কি না। ধর্মের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাজন বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে নিজ নিজ জাতিসত্তা আবিষ্কার হয়তো একটা অর্জিত সংস্কার, কিছুটা আরোপিতও বটে। স্বাধীন ‘নেশন’ বা ‘জাতিরাষ্ট্র’ উনি বলেছেন সাম্প্রতিক ঘটনা। যে হেতু প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে ‘পথপ্রদর্শক’ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ রয়েছে, তাই এই বিষয়ে তাঁর ভাবনা একটু স্মরণ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, রাষ্ট্র হল সংগঠিত স্বার্থপরতাকে আদর্শে পরিণত করা (‘দি আইডিয়ালাজ়িং অব অর্গানাইজ়ড সেলফিশনেস’)। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রের ভিতরেই রয়েছে ভয়ঙ্কর অন্তর্বিরোধী শূন্যতা, কারণ ‘স্বার্থের দুন্দুভি সেখানে নিনাদিত।’ ‘ন্যাশনালিজম্’ প্রবন্ধে স্বাধীনতার চেষ্টাকেও সম্পূর্ণ পৃথক এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তাকে মনে করতেন সামাজিক দাসত্বের চোরাবালির উপরে রাজনৈতিক ভোজবাজি তৈরির চেষ্টা (“টু বিল্ড আ পলিটিক্যাল মিরাকল আপন দ্য কুইকস্যান্ড অব সোশ্যাল স্লেভারি”)। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাসের ভিত যখন টলে উঠল, তখন বললেন— ‘নেশন’-ই যে সভ্যতার আদর্শ, তার চরম পরীক্ষা এখনও হয়নি। ‘ন্যাশনালিজ়ম’-কে সোজাসুজি বলেছেন এক মস্ত বিপদ— ‘আ গ্রেট মিনেস।’
সাক্ষাৎকারের একটা জায়গায় রোমিলা বলছেন “...আমরা কিন্তু এখন আর কোনও শাসকের শাসনের অধীন সমাজ নয়, আমরা একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক।” তাই কি? আমি মনে করি এই কথাগুলির ভিতরে অনেক ফাঁক রয়ে গিয়েছে। একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ কোনও দিনই সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পারে না, কারণ তার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে শাসক, লাগাম তার হাতে থাকে, সে হিসাব করে ছাড় দেয়। ভারতের দিকে তাকালে ব্যাপারটা বোঝা যায়। এখানে মানুষ কী খাবে বা খাবে না, কী পরবে, কী লিখবে বা লিখবে না, সবটাই শাসক নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। না মানলে তার কণ্ঠরোধ, হত্যা বা দেশদ্রোহী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র সদম্ভে প্রচার করে যাবে যে, সবাই স্বাধীন। নোম চমস্কি বলেছেন, “যদি ইতিহাস লিখতেই হয়, ইতিহাসের চরিত্র বা ঘটনা নিয়েই লিখতে হবে, পুরাণ বা লোককাহিনিকে ইতিহাস বলে দাবি করা যাবে না।” কিন্তু সরকারি স্তাবক তথাকথিত ইতিহাসবিদদের তো অভাব নেই।
এই প্রসঙ্গে আরও এক বার মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নামের অর্কেস্ট্রার প্রারম্ভিক সঙ্গীত বেশ কিছু দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। হিন্দুসভ্যতা প্রাচীনকালে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কত উন্নত ছিল, সেটা প্রমাণ করার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। পৌরাণিক কল্পকাহিনি-ভিত্তিক অবাস্তব সব হাস্যকর দাবি আনা হচ্ছে প্রচারের তীব্র আলোর সামনে। বছর ছয়েক আগে মুম্বইতে আয়োজিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১০২তম সম্মেলনে সদম্ভে আলোচিত হয়েছে যে, বৈদিক যুগে চল্লিশটি ইঞ্জিনযুক্ত দু’শো ফুট লম্বা বিমান ছিল, যা ছুটতে পারত শুধু সামনেই নয়, পাশাপাশি এবং পিছনেও। এটি নাকি সাত হাজার বছর আগে মহর্ষি ভরদ্বাজের আবিষ্কার। এই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছিল বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর তদন্ত। কিন্তু এর পরও দমানো যাচ্ছে না, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দু ভারতের অলীক ইতিহাস রচনায় মেতে উঠেছেন। এদের প্রতিহত করে প্রকৃত ইতিহাস রচনা করার জন্য কত জন রোমিলা থাপর, ইরফান হাবিব বা রামচন্দ্র গুহের প্রয়োজন হবে, জানি না।
অনিলেশ গোস্বামী
শ্রীরামপুর, হুগলি
মানসিংহ
‘পাবনায় স্বদেশি আন্দোলনের উৎস ছিল শক্তিমন্দির’ (রবিবাসরীয়, ১৫-৮) নিবন্ধে সুব্রত রায়চৌধুরী মানসিংহের কালনির্ণয়ে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, “পঞ্চদশ শতকের কাছাকাছি মানসিংহ এখানে ছাউনি বসিয়েছিলেন।” মানসিংহ ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে বর্তমান ছিলেন (১৫৫০-১৬১৪)।
তুষারকান্তি চৌধুরী
উত্তরপাড়া, হুগলি