মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম ধর্মগুরুদের কাছে আবেদন রেখেছেন, আসন্ন ইদ উপলক্ষে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নমাজ পড়ার জন্য। তার আগেই অবশ্য এ বার রেড রোডে ইদের নমাজ না পড়ার সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীকে ধর্মীয় নেতারা জানিয়ে দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্ত শুধু রেড রোডেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমাদের সকলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোনও জায়গায় বা মসজিদে এক সঙ্গে অনেকে নমাজ পড়ব না। মক্কা-মদিনায় যদি জনসমাগম না হয়, এমনকি হজ করাও বন্ধ হয়ে যায়, আমরা কি তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি না? শুধু ইমাম, মুয়াজ্জিনদের উপর ছেড়ে দিলেই চলবে না, এটা জনচেতনার বিষয়, যা আসে শিক্ষা থেকে। আজও স্কুলে যাওয়ার চাইতে মৌলানা ও মৌলবির কাছে আরবি শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় অনেক মুসলিম পরিবারে। অথচ, হজরত মহম্মদ শিক্ষার জন্য আরব দেশ থেকে সুদূর চিন দেশে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে, চিন দেশে ওই সময় ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষার কোনও পীঠস্থান ছিল না। কিন্তু ভারতে মুসলিমদের এক বড় অংশ আধুনিক শিক্ষার থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে বরাবর। মহম্মদ বলেছেন, “পণ্ডিতের কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়ে আল্লার নিকট অধিক প্রিয়।” কিন্তু সেই বাণী থেকে কোনও শিক্ষা আমরা অর্জন করতে পারিনি। একটা কথা বলা প্রয়োজন, দিনে পাঁচ বার নমাজ পড়া যেমন অবশ্যকর্তব্য, ইদের নমাজের ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। রোজা আত্মসংযম শেখায়। এক মাস রোজা পালনের পরে আসে ইদ। ইদ খুশির উৎসব— জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার উৎসব। অতিমারির সময়, গত বছরের মতো এ বারেও সংযম দেখিয়ে, কোভিডবিধি মেনে ইদের নমাজ পড়লে সেটাই হবে ইদের সার্থকতা।
একরামুল বারি, কলকাতা-১৬
নয়া বামপন্থা
বাড়ির শীর্ণ কাজের মেয়েটি যখন হেসে বলেছিল, “আমরা সবাই দিদিকে ভোট দেব”, তখন মমতার জয়ে বিশ্বাস আসেনি। যখন নয়াপট্টিতে, ২৮ নম্বর ওয়ার্ড অফিসে পাঁচ টাকার ডিম-ভাতের পঙ্ক্তিভোজনে শুনেছিলাম, “দিদি বলেই পারল”, তখনও মনে হয়নি উনি ভোটের লড়াই জিততে পারবেন বলে। কারণ, আশপাশের জগৎ আচ্ছন্ন, আবিল করে রেখেছিল বিজেপির বড় বড় প্রতিশ্রুতির বিজ্ঞাপন, বচনবাগীশদের হিন্দি-ছোঁয়া বাংলা বাক্যের প্রবাহ, এবং দলনায়ক নরেন্দ্র মোদীর টিটকারি— ‘দিদি, ও দিদি’, যার সৃষ্টি বেয়াড়া অহঙ্কার থেকে, যার সৃষ্টি আবার অপরিমিত টাকার ঔরসেও। এ এমনই উচ্চগ্রামের প্রচার, যা সাধারণ যুক্তিবোধ গুলিয়ে দেয়। সেই জন্য স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন, এত আসন যে পাবেন, ভাবেননি।
কী করে হল এমন? নরেন্দ্র মোদী ছাড়াও বাংলায় প্রচারে সময় দিয়েছিলেন অমিত শাহ, রাজনাথ সিংহ, স্মৃতি ইরানি, জে পি নড্ডা, কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং যোগী আদিত্যনাথ। এঁরা অপরিশীলিত ভাষায় ক্রমাগত আক্রমণ করে চললেন মমতাকে। বোঝানোর চেষ্টা করে গেলেন, তাঁরাই গড়বেন ‘সোনার বাংলা’, যেখানে কলেজের সামনে ঘুরে বেড়াবে ‘অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড’। সেই উচ্চারণের অন্ধ অনুকরণ করতে শুরু করলেন বাংলার বিজেপির নেতানেত্রীরাও। মোদীর অনুকরণেই আকাশে দু’হাত ছুড়ে এঁরা স্লোগান তুললেন, ‘জয় শ্রীরাম’। এঁদের বক্তব্যে প্রকাশিত হল একনায়কের মনোভাব, নিম্নবর্গের মানুষজনের মনোজগৎ সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা, সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মহিলাদের হেনস্থা করার দর্শন।
‘বন্দে মাতরম্’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘জয় হিন্দ’— এই সব স্লোগান বাঙালির সংস্কৃতি, আবেগে মিশে আছে, এমনকি ১৯৭১-এর স্লোগান ‘জয় বাংলা’-ও। কারণ এই প্রতিটি স্লোগানের নেপথ্যে রয়েছে গৌরবময় আন্দোলন, যার পরতে-পরতে বাঙালির ঘাম-রক্ত। তারই উল্টো পিঠে ‘জয় শ্রীরাম’ এক নিরালম্ব শিকড়হীন স্লোগান, যার সঙ্গে বাঙালির নাড়ির কোনও যোগ নেই। তবু তাকে চাপানো হচ্ছে বাঙালির ঘাড়ে! এই স্লোগানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই বামপন্থা!
বাংলার যে সব মানুষের শিরায়-ধমনিতে বয়ে চলেছে চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকের যুগান্তকারী গণ-আন্দোলনের শিক্ষা, তাঁরা অচিরেই বুঝে গেলেন যে, ওই দল তো ভোটের সঙ্গে শিক্ষা-চিন্তা-আচার-আচরণ-ব্যবহার-খাদ্য, সর্বোপরি মন, সব কিছুর দখল নিতে আসছে, যা দক্ষিণপন্থী একনায়কেরাই করে থাকে। তারা শত ফুলের বিকাশ চায় না, চায় একই রকম বিষাক্ত লতার ফলন।
যে বাঙালি অহংবোধে আঘাত লেগেছিল বলে বোমা বানিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল, ১৯০৫-এর বাংলা ভাগ রুখে দিয়েছিল, সেই বাঙালি কী ভাবে মেনে নেবে এই পরাধীনতা? তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিল— আমি কার সঙ্গে মেলামেশা করব তুমি ঠিক করে দেবে? কী খাব বলে দেবে তুমি? তুমি আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছ অবৈজ্ঞানিক কিছু বাক্যবন্ধ! এই দেবী চৌধুরানির দেশের এক মহিলাকে তোমরা সপ্তরথী মিলে আক্রমণ করে চলেছ? আমরা এই আক্রমণ মানি না।
বাঙালির এই মন তৈরি করে দিয়েছিল দক্ষিণপন্থী বিজেপির নেতানেত্রীরাই। এটাই এই ভোটের বামপন্থী চেতনা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে অগ্নিসংযোগ করেছেন মাত্র। যা বুঝে সিপিআই (এম এল)-এর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য স্লোগান তুলেছিলেন, ‘নো ভোট টু বিজেপি’। তিনি পাশে পেয়েছেন এমন বহু বামপন্থীকে, যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন বলেই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন।
এরই পাশাপাশি সিপিএম-এর বক্তৃতায় শোনা গেল, তৃণমূল তথা মমতা ভয়ঙ্কর দোষী। বচনের একেবারে শেষ পর্বে বলা হল, “ভাই বিজেপি তুমিও কিন্তু সুবিধের নও।” এই বোধের সঙ্গে সাধারণের উপলব্ধি এবং বামপন্থী চেতনার দূরত্ব অনেক। অতএব সাধারণ মানুষ দূরে সরে গিয়ে সেই নেতার পাশে দাঁড়ালেন, যিনি তাঁদেরই মতো আটপৌরে ভাষায় কথা বলেন, যাঁকে তাঁদের বাড়িতে কলাপাতায় খেয়ে খবরের কাগজে ছবি তোলাতে হয় না। ফলে সনাতন বামপন্থী দলগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। অর্থাৎ, এই সময়ের বাংলার নবোদিত বামপন্থাই পরাস্ত করেছে নরেন্দ্র মোদীকে।
অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৯১
মনের সমীক্ষা
আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সমীক্ষা হতে দেখি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, সামাজিক সমীক্ষা, নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমীক্ষা ইত্যাদি। এ সব সমীক্ষা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। কিন্তু গত এক বছরের অধিক সময় ধরে অতিমারি, এবং তজ্জনিত লকডাউনের ফলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যে অভূতপূর্ব পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে, তাতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য কেমন আছে— সে বিষয়ে কোনও সমীক্ষা হয়েছে বলে এখনও পর্যন্ত জানা নেই। জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সমীক্ষা হওয়া খুব জরুরি।
গৌতম পাত্র, চন্দননগর, হুগলি
বোধোদয়
দেরিতে হলেও বোধোদয় হয়েছে রাজ্য সরকারের। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পিএম কিসান’ প্রকল্পে সায় দিয়ে কৃষকদের নথি যাচাইয়ের কাজ দ্রুত সেরে ফেলেছে। রাজ্য সরকারের ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্প তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর, এই অজুহাতে আগে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে সম্মত হয়নি রাজ্য। এখন অংশগ্ৰহণের সিদ্ধান্ত যথার্থ। প্রকৃত রাজধর্মে সাধারণ মানুষের কল্যাণই মুখ্য হওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় সরকারের যত জনমুখী প্রকল্প আছে, তার সব ক’টিতেই রাজ্য সরকারের অংশগ্রহণ করা উচিত। কেন্দ্রীয় সরকারেরও উচিত বৈরিতার মনোভাব না দেখিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ানো। মানুষের কল্যাণই সরকারের লক্ষ্য, আত্মপ্রচার নিজেকে ছোট করে দেয়।
অসিত কুমার নায়ক, কলকাতা-১৫২