kashi viswanath temple

সম্পাদক সমীপেষু: ভক্তি থাক অন্তরে

দশাশ্বমেধ ও তার পাশের ঘাটে একই সঙ্গে একই রকম জাঁকজমক সহকারে উচ্চ নিনাদে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি শুরু হল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:৩৯
Share:

সম্প্রতি আমার কাশী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হল। আমার জীবনে এই প্রথম কাশী যাত্রা। এক সন্ধ্যায় দশাশ্বমেধ ঘাটে আরতি দেখার জন্য উপস্থিত হলাম। ভাল করে দেখার আশায় আমরা একটি মোটরবোট ভাড়া করলাম। ঘাটে থিক থিক করছে দর্শনার্থীর ভিড়, বহু মানুষ নৌকার উপর চেয়ার ভাড়া করে বসে আছেন। কিছু ক্ষণ পর শুরু হল সেই অতি প্রতীক্ষিত গঙ্গা আরতি।

Advertisement

দশাশ্বমেধ ও তার পাশের ঘাটে একই সঙ্গে একই রকম জাঁকজমক সহকারে উচ্চ নিনাদে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি শুরু হল। প্রতিটি ঘাটে সাত জন করে পুরোহিত রত্নদীপ, ধূপ, কর্পূরদান সহযোগে আরতি করছেন। প্রত্যেকটি দীপেরই আয়তন যথেষ্ট বড় এবং দীপগুলি বড় মাপের শিখা সহকারে দেদীপ্যমান। একই সঙ্গে দুই ঘাটে দুই ধরনের মন্ত্রোচ্চারণ ঘটছে। কোথাও নাচ হচ্ছে, তার সঙ্গে গান,অবশ্যই মাইক সহযোগে। পাশের ঘাটে গম্ভীর ধ্বনিতে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে, সঙ্গে আরতি। দুই ঘাটের ধ্বনিতে কোনও সমন্বয় নেই। সেই আরতি দেখে আধ্যাত্মিক ভাবের পরিবর্তে আতঙ্ক জাগল। এ তো শুধু শব্দ আর আলোর প্রতিযোগিতা। এত আলো, এত শব্দ তৈরি করে প্রতি সন্ধ্যায় গঙ্গাতীরে যে দূষণ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে ‘ন্যাচরাল হ্যাবিট্যাট’, অর্থাৎ যারা গঙ্গাতীরে বাস করে, সেই পাখি, প্রাণী, পোকামাকড়দের উৎপীড়ন করা তো হচ্ছেই, মানুষের পক্ষেও তা মোটে স্বাস্থ্যপ্রদ হচ্ছে না। এ ছাড়াও নদীতে চলছে অজস্র মোটরবোট, যা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য প্রতিনিয়ত মিশছে গঙ্গার জলে, গঙ্গার উপরের বাতাসে মিশছে কালো ধোঁয়া। এমন ভাবে চলতে থাকলে কত দিন আর মা গঙ্গা পবিত্র, নির্মল থাকবেন? গঙ্গাকে যদি আমরা মা হিসাবে ভাবি, মায়ের মতো ভালবাসি, তা হলে এই অতিরিক্ত জাঁকজমকের কী প্রয়োজন? মায়ের বন্দনা যাতে মায়ের স্বাস্থ্যহানিকর হয়ে না ওঠে, সে দিকে লক্ষ রাখা একান্ত প্রয়োজন। ভক্তি থাকুক অন্তরে, পাঁচ জনকে দেখানোর মধ্যে নয়।

মিতালী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

কলকাতা-১৩৬

দূষিত চূর্ণী

নদিয়া জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী চূর্ণী। মূলত রানাঘাট মহকুমার লাইফ লাইন হিসাবে পরিচিত চূর্ণী আজ ভেন্টিলেশন-এ। নদীটি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার পদ্মা নদী থেকে উৎপন্ন মাথাভাঙা নদীর একটি শাখা। মাথাভাঙা নদী ভারতে প্রবেশ করে নদিয়া জেলার মাজদিয়ার পাবাখালি থেকে দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে একটি শাখা চূর্ণী নামে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত, অন্য শাখাটি ইছামতী নামে দক্ষিণে বাহিত। চূর্ণী নদী মাজদিয়া, শিবনিবাস, হাঁসখালি, বীরনগর, আড়ংঘাটা, রানাঘাট হয়ে প্রবাহিত হয়ে পায়রাডাঙার কাছে ভাগীরথী নদীতে মিশেছে।

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও চূর্ণী ছিল পরিবহণ বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ। নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছও ছিল, বহু মানুষ তাঁদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন নদী পরিবহণ ও মাছ ধরে। পাওয়া যেত সুস্বাদু কালবাউশ মাছ এবং গলদা, সরপুঁটি; জলে ঘুরে বেড়াত সুদি-কচ্ছপ, কালো ডলফিন (যা গাঙ্গেয় শুশুক নামে পরিচিত)। নদীর দু’পারের গাছগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও দেখা যেত। এখন আর কিছু পাওয়া যায় না। দীর্ঘ কাল চূর্ণীর উপর অত্যাচার চলতে থাকায় নদীটি বর্তমানে বহু সমস্যায় জর্জরিত। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পুরো জীববৈচিত্রই উধাও হয়ে গিয়েছে নদী থেকে। নদী পারে লোক বসিয়ে মোটা টাকা উপার্জন করতে গিয়ে অনেক কাল আগেই নদী পার দখল হয়ে আছে। বাসিন্দাদের মল, মূত্র-সহ যাবতীয় আবর্জনা, খাটালের দূষিত পদার্থ, কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য— সবই নদীতে পড়ছে। সঙ্গে যুক্ত হয় বছরে তিন-চার বার বাংলাদেশের দর্শনার চিনিকলের ছাড়া দূষিত কালো জল। ফলে চূর্ণীর জল এতটাই দূষিত ও বিষাক্ত যে, মাঝে মধ্যেই নদীর মাছ মরে ভেসে ওঠে, নদীতে স্নান করার ফলে অনেকেরই চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।

এ তো গেল সরাসরি নদী-দূষণ, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থাকা কতিপয় মৎস্যজীবীদের দ্বারা নদীবক্ষে অবৈধ ভাবে বাঁধাল নির্মাণ করে মাছ ধরা। এর ফলে এক দিকে যেমন নদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, পাশাপাশি বাঁধালের জায়গাতেই মাছের আনাগোনা হলে নদীর অন্যত্র মাছের বিচরণ সে ভাবে থাকে না। ফলে অন্য মৎস্যজীবীরা, যাঁরা বাঁধাল দিতে পারেন না, সারা দিন মাছ ধরার চেষ্টা করেও খুব সামান্য মাছ পেয়েই তাঁদের চলতে হয়। এ ছাড়া মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য নদীকে আরও ভেন্টিলেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইটভাটার জন্য যথেচ্ছ ভাবে যেখান-সেখান থেকে নদীর মাটি কেটে নেওয়ার ফলে নদীর স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া কালীনারায়ণপুরে একই স্থানে চূর্ণীর উপর রেলব্রিজ ও ফুটব্রিজের অবস্থান নদীকে এক ফালি খালে পরিণত করেছে।

নদীর এই রুগ্ণ অবস্থা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে মহকুমাশাসক, জেলাশাসক, রাজ্যের সেচ দফতর, এমনকি কেন্দ্রের জলসম্পদ দফতরে পরিবেশকর্মীরা বহু চিঠি দিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এসে নদীর বেহাল অবস্থা দেখানোও হয়েছে। কিন্তু রাজা আসে, রাজা চলে যায়। আর নদী একবুক পলি নিয়ে হতাশ নয়নে চাতকের মতো চেয়ে থাকে, কবে সে নাব্যতা ফিরে পাবে।

পরেশনাথ কর্মকার

রানাঘাট, নদিয়া

অচেনা প্রকৃতি

ক’দিন আগে বাসন্তীর এক প্রবীণ মানুষ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো! একের পর এক ঝড়-বৃষ্টি হয়েই চলেছে! ডিসেম্বরেও ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ! এমন অবস্থা আমি তো জন্ম ইস্তক দেখিনি। চাষবাস গেল, বাড়িঘরের অবস্থাও তথৈবচ। মহাজনের দেনা কী করে শুধব, কী করে বাঁচব কে জানে! কথাগুলো খুব সত্যি। শুধু সুন্দরবন নয়, প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোনও দেশই। সম্প্রতি পর পর দু’দিনে আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় টর্নেডোর ভয়ঙ্কর তাণ্ডব হয়ে গেল, যা কেন্টাকির ইতিহাসে সবচেয়ে বিধ্বংসী ঝড় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। মুহূর্তে ধূলিসাৎ হল মোমবাতি কারখানা, নার্সিংহোম-সহ অসংখ্য ঘরবাড়ি। ২০২১-এ এমন আরও টর্নেডো ও মারাত্মক ঝড়ের খবর মিলেছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ থেকে।

হয়তো ফেলে আসা ২০২১ সালটা বিপদসঙ্কেত বয়ে এনেছে আমাদের জন্য। ব্রাজিলের অসহনীয় গরমের বলি হয়েছেন কয়েকশো মানুষ। আমাজ়নের জঙ্গলের দাবানলে শেষ হয়ে গিয়েছে কত যে ছোটখাটো জীব, কেউ জানে না। আমেরিকায় প্রবল বর্ষণে ভেসে গিয়েছে জনপদ, চিনে হয়েছে অস্বাভাবিক বন্যা। আমাদের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও দক্ষিণের সব ক’টি জেলাই বন্যার কবলে পড়ায় গৃহহীন হয়েছিলেন পাঁচ লক্ষ মানুষ। এখনও সুন্দরবনের বহু মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে ত্রাণ-শিবিরে অথবা কোনও উঁচু জায়গায় ত্রিপল খাটিয়ে আছেন। উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গাতেই স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতটুকুও হয়নি।

আবহাওয়া দফতর চট করে এ সব ঘটনাকে অ-স্বাভাবিক বলতে রাজি হবে না। কিন্তু বরফাবৃত সাইবেরিয়ায় তাপমাত্রা যদি ৩৮
ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছয়, তবে তাকে স্বাভাবিক বলা বেশ শক্ত। প্রকৃতির এই অ-স্বাভাবিকতাই ভয়ের কারণ। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে রাষ্ট্রপুঞ্জের ২৬তম জলবায়ু মহা-সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতা, সরকারি ও অ-সরকারি সংগঠনের প্রায় ৪০০০০ অংশগ্রহণকারীর আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছিল ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’। সকলেই একমত, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেঁধে রাখতে হবে। এ জন্য কেউ কেউ তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর সময় ঠিক করেছেন কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার। কিন্তু আমাদের এই বসুন্ধরা মানবসমাজকে তত দিন বেঁচে থাকার সময় দেবে তো! এই প্রকৃতিকে যে বড় অচেনা মনে হচ্ছে।

সঞ্জিতকুমার সাহা

কলকাতা-৮২

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement