— ফাইল চিত্র।
‘সপ্তকাণ্ড নির্বাচন’ (১৯-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারতে গণতন্ত্রের দায়িত্ব সকলের। ভারত বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, উন্নয়নশীল ও সমাজকল্যাণমুখী দেশ। অনেক সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা ও সঙ্কট রয়েছে, অনেক মূল্যবান ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। তবু ভারত তার অমূল্য গণতন্ত্র বজায় রেখেছে ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বিশ্ব রাজনীতিতে এ এক দুর্দান্ত সাফল্য। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এই গণতন্ত্রের সহনশীল সাফল্যের ঐতিহ্য রাখতেই হবে। তাকে আরও উজ্জ্বল করতে হবে।
কিন্তু শুকনো প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতি নিরর্থক। ‘ভোট-কথা: নজরে হিংসা, কালো টাকা, ভুয়ো তথ্য’ (১৭-৩) প্রতিবেদন মনে করিয়ে দিল কী কী করতে হবে। এ বার ভোট দেবেন ৯৭ কোটির বেশি লোক। নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য, ভোট শান্তিপূর্ণ করার চেষ্টা করা হবে, কড়া হাতে হিংসা, কালো টাকা, ভুয়ো তথ্যের মোকাবিলা করা হবে। তালিকায় অনেক কর্তব্যের মধ্যে নির্বাচনে চারটি ‘এম’ আটকানোর উপরে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তবে অন্তত দু’টি বিষয়ে ‘জোর’-এর তেমন লক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘মাসল’ বা পেশিশক্তি (ভোটে জোরজবরদস্তি), এবং ‘মানি’ বা অর্থশক্তি (টাকা ছড়িয়ে ভোট ‘কেনা’র চেষ্টা)। ইতিমধ্যে রাজ্যে শাসক দলের নির্বাচনী প্রচারে উঠে এসেছে ‘জবরদস্তি’ বিষয়ে নানা পদ্ধতির উল্লেখ। টাকাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, দু’ভাবে ছড়ানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ বিচারালয় নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, এই বন্ডের সমগ্র টাকা আটকে রাখার দরকার ছিল। তা হয়নি।
এই রাজ্যে দুর্নীতির টাকার পাহাড় সবাই দেখেছি সংবাদমাধ্যমে। অর্থাৎ, প্রচুর ‘অর্থশক্তি’ ব্যয় করা হচ্ছে ভোট কিনতে। এ সব কাগজে-কলমে হয়তো অবৈধ নয়। কিন্তু সামাজিক সাম্য, নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের দণ্ডে বড্ড দৃষ্টিকটু। ভুয়ো তথ্যও রোখা যায়নি— রাজনৈতিক প্রচারে যে যার মতো করে তথ্য আগেও দিয়েছে, এ বারও দেবে। বিরোধীকে লক্ষ্য করে কদর্য উক্তিও থামেনি। এ সব যদি চলতেই থাকে, তা হলে নির্বাচনী বিধির যৌক্তিকতা দুর্বল হয়ে যায়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে প্রচুর ভুয়ো তথ্য ঘোরাফেরা করবে। তা ছাড়া ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’ বা আদর্শ আচরণবিধি বজায় রাখার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ‘আপনি আচরি ধর্ম’ নীতি পালন করতে পারে। প্রথম থেকে কড়া হাতে পরিস্থিতির রাশ নিতে হবে। ভারতের গণতন্ত্রের সামনে আর এক অগ্নিপরীক্ষা।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
চাই দৃঢ়তা
১৬ মার্চ আসন্ন অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষিত হল। শুরু হয়ে গেল নির্বাচন প্রক্রিয়া। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বললেন, তাঁদের চারটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এ বারে— পেশিশক্তি, অর্থশক্তি, আচরণবিধি ভঙ্গের প্রবণতা এবং ভুয়ো তথ্যের প্রচার। এগুলোর মোকাবিলা খুব সহজ নয়। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কমিশনও সব ক্ষেত্রে কঠোর হয় না। পেশিশক্তির মোকাবিলা সবচেয়ে কঠিন কাজ। অর্থশক্তি পেশিশক্তিকে ত্বরান্বিত করে। পেশিশক্তির মোকাবিলা সব সময় পেশিশক্তি দিয়েও হয় না। হলেও সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। এক দিকে সর্বত্র অনলাইনে কাজ করার প্রশংসা করা হচ্ছে, অথচ ভোটদান প্রক্রিয়াকে ‘অফলাইন’-এর বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাড়িতে বসে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিলে পেশিশক্তির আস্ফালনকে অনেকখানি প্রতিহত করা সম্ভব হত।
অর্থশক্তির তাণ্ডবকে জেনেশুনে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না কি? ধনকুবের গোষ্ঠীর সঙ্গে বড় রাজনৈতিক দলগুলির যে অনৈতিক আর্থিক যোগাযোগ, তা জানা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা যেন নীরব দর্শকের। হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ধনকুবেরের কাছ থেকে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে ঢুকছে অবাধে। ক্ষমতাসীন বেশি পাচ্ছে, বিরোধীরা কম। স্টেট ব্যাঙ্ক তার কিছুটা হলেও প্রকাশ করেছে। কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তো এখনও প্রকাশিত হল না। উদ্যোগপতিরা যেখানে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভেট দেয়, সেখানে গণতন্ত্রের আর থাকে কী! এখানে সরকারের মুখ্য নিয়ামক এখন আর সাধারণ ভোটদাতারা নন, মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী। তাঁরা আবদার করলে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম কমলেও ভারতে বেড়ে যায়; ওষুধের উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারমূল্য অনেক গুণ বেড়ে যায়; মোটা টাকার অনাদায়ি ঋণ মকুব হয়ে যায়। তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা-চিকিৎসা হয়ে যায় মহার্ঘ, সরকারি সম্পদের মালিকানা চলে যায় বেসরকারি হাতে। আর সাধারণ মানুষ তাঁদের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি দাবি করে আন্দোলন করলে তা পূরণ হয় না, উল্টে রাষ্ট্র তার দাঁত-নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকারীদের উপর।
নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙার প্রবণতা সর্বত্র। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগও গৃহীত হয়, কিন্তু তার পর কী হয়, তা অভিযোগকারী কিংবা অভিযুক্তরা জানতে পারেন কি? আমি গত বিধানসভা নির্বাচনপর্বে দুটো অভিযোগ করেছিলাম। অভিযোগগুলি ছিল— প্রথমত, কোভিড-১৯ টিকাকরণের শংসাপত্র যা সে সময়কার ভোটপর্বে বেরিয়েছিল, বিতরিত হয়েছিল, তাতে ভারত সরকারের অশোক স্তম্ভের জায়গায় মোদীজির ছবি ছিল। দ্বিতীয়ত, বুথের ভিতর সিসিটিভি ক্যামেরা-সহ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসকে প্রার্থীদের প্রতীক হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জনৈক প্রার্থী সিসিটিভি ক্যামেরাকে তাঁর প্রতীক হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন। এটা কি নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙার মধ্যে পড়ে না? অভিযোগ দু’টির পরিণতি কী হল, জানা নেই।
আর ভুয়ো তথ্যের প্রচার? জানি না এই প্রচার-স্রোতের অপর নাম ভোট রাজনীতি কি না! ভোট সমীক্ষা চলছে নানা ঢঙে, নানা আবরণে। বঙ্গ সমীক্ষা, ভারত সমীক্ষা। কাগজে-কাগজে, চ্যানেলে-চ্যানেলে। অমুকে এগিয়ে, তমুকে পিছিয়ে। আর ভুয়ো প্রতিশ্রুতিও তো এর মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। চাকরির প্রতিশ্রুতি, ভোটারদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা হওয়ার প্রতিশ্রুতির মতো হাজারো প্রতিশ্রুতি (যার অপর নাম নাকি ‘জুমলা’) দেখছি ভোট উৎসবের এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠছে। যাঁরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট আদায় করেন, তাঁদের শাস্তির কোনও বিধান আছে বলে তো মনে হয় না। তা ছাড়া শুধু ভুয়ো তথ্যের প্রচার কেন, যে কোনও তথ্যের ব্যাপক প্রচারও অর্থ-নির্ভর। ভোটদাতাদের সেই স্রোতে ভাসিয়ে রাখার বাধাহীন প্রতিযোগিতা চলে। তারও চাই সুনিয়ন্ত্রণ।
এ সব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় দৃঢ়তা দরকার। দেখতে হবে, কমিশনের দৃঢ়তা যেন রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত না হয়।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
ঘেঁটুপুজো
ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ পুজোর রীতি রয়েছে। কথিত আছে, ঋতু পরিবর্তনের সময় খোস, চুলকানির মতো রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ঘেঁটু ঠাকুরের পুজোর সূচনা হয়। এ জন্য বেশ কিছু জায়গায় ঘেঁটুকে চর্মরোগের দেবতা বলা হয়। পুজোর দিন সকাল থেকে ঘেঁটুফুল সংগ্রহ করে ঘেঁটু সাজানোর প্রস্তুতি চলে। পাল্কিতে, ধামায়, বাক্সে, ঝুড়ির ভিতরে ও বাইরে ঘেঁটু ফুল দিয়ে ঠাকুরের মূর্তি সাজায়। হাতে হারিকেন, লম্ফ বা লন্ঠন নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক দল ঘেঁটু গান গাইতে থাকে। ছোটবেলায় ফাল্গুন সংক্রান্তির সন্ধ্যার অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম। সন্ধের পর থেকে একের পর এক ঘেঁটুর দল আসত, গান করত। বর্তমানে এই লোকসংস্কৃতি হয়তো অল্প কিছু জায়গায় এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে। একেবারে হারিয়ে যায়নি।
অপূর্বলাল নস্কর, ভান্ডারদহ, হাওড়া