অতিমারির দৌরাত্ম্যে দফায় দফায় লকডাউনের জেরে যানবাহন চলাচল সর্বত্রই অনিয়মিত। লোকাল ট্রেনও চলছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতায়াত, ভাড়া নিয়ে নানা ঝামেলা তো রয়েছেই। এই আবহে কল্যাণশঙ্কর মণ্ডলের নিবন্ধটি (‘সাইকেলে এগিয়ে চলুক শহর’, ১১-৮) অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সাইকেলের কথা উঠলেই আজ থেকে ৩৫-৪০ বছর আগের স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন গ্ৰাম ও শহরতলির নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই পাত্রীপক্ষের তরফে পাত্রকে একটি হাতঘড়ি, একটি সাইকেল ও একটি আংটি উপহার দেওয়া হত। কাঁচা বা ইটের রাস্তায় সাইকেলই একমাত্র নির্ভরযোগ্য বাহন ছিল। সাইকেল চালিয়ে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, বাজার, অফিস, স্কুল-কলেজে যাতায়াত ছিল মামুলি ব্যাপার।
লেখক এই নিবন্ধে সাইকেলের যে উপকারিতাগুলির কথা উল্লেখ করেছেন, তা যথার্থ। সাইকেলে যাতায়াত বাড়লে খনিজ তেলের ব্যবহার ও পরিবেশ দূষণ কমবে, শরীরচর্চা হবে, পার্কিং ফি লাগবে না। কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভলপমেন্ট অথরিটি সাইকেল যাতায়াতের আলাদা রাস্তা তৈরির উদ্যোগ করেছে, এটি নিঃসন্দেহে সুখবর। কিন্তু অতিমারির পর দ্রুতগতির নগরজীবনে ধীরগতি ও দৈহিক পরিশ্রমে চালিত এই বাহনের কথা সকলে মনে রাখবেন তো?
হারান চন্দ্র মণ্ডল
ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
গতির ঝুঁকি
সামাজিক দূরত্ব করোনার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। তাই গণ-পরিবহণ এড়িয়ে মানুষ এখন বাইক ও সাইকেলের উপর বেশি নির্ভরশীল। বিনিয়োগ এককালীন আর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ খুব একটা বেশিও নয়। ষাটের দশকে বাবা, পাড়ার কাকা-দাদারা র্যালে, হাম্বার, হারকিউলিস— এ সব সাইকেলই ব্যবহার করতেন, দেখতাম। এখন সেই স্থান নিয়েছে অনেক ছোট, হালকা মডেলের সাইকেল।
ইদানীং সাইকেলের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত মোটর লাগিয়ে গতিবৃদ্ধির প্রবণতা চোখে পড়ছে। যাঁদের প্রতি দিন দূরের বাজারে নিত্যসামগ্রী সরবরাহ করতে হয়, তাঁরা এই ধরনের সাইকেল ব্যবহার করছেন। এর খরচও অনেক, কারণ মোটরের দাম ৩,০০০-৪,০০০ টাকা। সুবিধা এটাই যে, প্যাডেল করতে হয় না। কিন্তু সজাগ থাকতে হয় ব্রেক নিয়ে। সেটি সাধারণ সাইকেলের ব্রেকের মতোই। সামনে হঠাৎ কিছু এসে পড়লে ব্রেক যদি ঠিকমতো না ধরে, বিপদের সম্ভাবনা থেকে যায়।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
চন্দননগর, হুগলি
স্বাস্থ্যযান
শহরের বিভিন্ন রাস্তায় সাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞা, ফাইন এবং পুলিশি নির্যাতনকে কেন্দ্র করে কলকাতা শহরে সাইকেল আন্দোলন চলছে প্রায় ১০ বছর ধরে। যদিও এই করোনা পরিস্থিতিতে, যখন দূরত্ব বজায় রেখে যাতায়াত করা বৃহত্তর সমাজের জন্য একান্ত আবশ্যক, তখনও সাইকেলের ওপর জরিমানা, নিষেধাজ্ঞা এতটুকু শিথিল হয়নি।
পরিবেশের ওপর সাইকেলের প্রভাবের কথা লেখক বলেছেন। কিন্তু একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক তাঁর লেখায় সে ভাবে স্থান পায়নি। রাজ্যে করোনায় মৃত ২,৪০০ ছাড়িয়েছে। বেশির ভাগ মানুষই মারা গিয়েছেন অন্য দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা বা ‘কোমর্বিডিটি’-র কারণে। এর অন্যতম কারণ দূষিত বাতাস। কয়লা, কাঠ, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহার, বিশেষ করে শহরে। যেখানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত দূষণমাত্রা ১০, ভারত সরকার নির্ধারিত মাত্রা ৪০, সেখানে করোনা-পূর্ববর্তী সময় কলকাতার গড় দূষণ ছিল ৮০-র কাছাকাছি।
এই দূষণের কারণে কলকাতার ৭০ শতাংশ মানুষ অ্যাজ়মা, ব্রঙ্কাইটিস জাতীয় অসুখে ভুগছেন। হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, নিউমোনিয়া, ক্যানসার, নানা ধরনের রোগের সংযোগ রয়েছে দূষণের সঙ্গে। প্রকৃতিতে কোটি কোটি ভাইরাস আছে। কোনটা যে কখন মাথাচাড়া দেবে, কেউ জানে না। বাঁচার একমাত্র উপায়, প্রকৃতিদত্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পুষ্টিসাধন। কলকাতা বা অন্যান্য শহরের স্বাস্থ্য যদি ফেরাতে হয়, তা হলে পেট্রল-ডিজ়েল চালিত যানবাহনের ব্যবহার কমাতেই হবে।
স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, প্যারিস বা লন্ডনের মতো বড় শহর সাইকেলকে গ্রহণ করেছে। আমাদেরও ওই পথে যেতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব।
অনুপ কুমার তোকদার
কলকাতা-৫৯
এবং নারীমুক্তি
কলকাতায় গত কয়েক বছরে সাইকেল আন্দোলন গড়ে উঠেছে। অনেকেই জানেন না, এই সাইকেল আন্দোলনের সঙ্গে নারী আন্দোলনের এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ১০০ বছর আগে ব্রিটেনের লেস্টার শহরে সাইকেল নিয়ে ঘুরেছিলেন অ্যালিস হকিন্স। পাতলুন-পরা এক মহিলার সাইকেল চালানো দেখে তখন যুগপৎ বিস্মিত ও বিরক্ত হয়েছিলেন অধিকাংশ শহরবাসী।
মহিলাদের ভোটাধিকার চেয়ে যাঁরা আন্দোলন করছিলেন, সেই ‘সাফ্রাগেট’-দের অন্যতম নেত্রী ছিলেন অ্যালিস। তখন থেকেই সাইকেল আন্দোলন জড়িয়ে গেল নারী আন্দোলনের সঙ্গে। মেয়েদের একা অনেক দূর চলে যাওয়ার স্বাধীনতা যেমন দিল সাইকেল, তেমনই মেয়েদের পোশাকেও বদল আনল। ক্রমে সাইকেল স্বাধীনচেতা মেয়েদের পছন্দের যান থেকে হয়ে উঠল মেয়েদের স্বাধীনতার প্রতীক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মেয়েরা সাদরে গ্রহণ করল সাইকেলকে। ১৮৯৪ সালে অ্যানি লন্ডনডেরি বস্টন থেকে শুরু করে গোটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ফেললেন। তিনি ছিলেন তিন সন্তানের মা। কাগজে ব্যঙ্গচিত্র বেরোল, মহিলারা স্বামী-সন্তানদের ছেড়ে সাইকেল চালিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে।
কিন্তু হাজার নিন্দেমন্দতেও মেয়েরা সাইকেল চালানো থামাল না, বরং জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল সাইকেলের। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেত্রী সুসান বি অ্যান্টনি লিখেছেন (১৮৯৬), ‘‘নারীমুক্তির জন্য সাইকেল যা করেছে, বিশ্বের আর কোনও কিছুই অত করেনি। যখনই কোনও মেয়েকে সাইকেলে যেতে দেখি, খুব আনন্দ হয়। সিটে বসার মুহূর্ত থেকেই মেয়েটির মধ্যে স্বনির্ভরতা, স্বাধীনতার একটা অনুভূতি তৈরি হয়। যখন সে সাইকেল চালিয়ে যায়, তা যেন অপ্রতিহত নারীত্বের একটা ছবি।’’
ভারতে অবশ্য সাইকেল প্রচলনের গোড়া থেকেই ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের সাইকেল জায়গা পেয়েছিল বাজারে। প্রথম লেডিজ় মডেল এল ১৯২০ সালে, ইন্ডিয়ান লেডিজ় রোডস্টার। সে সব সাইকেল অবশ্য কেবল অভিজাত পরিবারের মেয়েরাই ব্যবহার করত।
১৯৩৭ সালে তৈরি হয় সাইকেলওয়ালি নামে একটা ছবি। স্বাধীনতার পর পর ভারতে সাইকেল তৈরি শুরু হল। দেশি কোম্পানিগুলোও মেয়েদের সাইকেল বানিয়েছে সমান তালে। মেয়েদের সাইকেল চালানোকে কখনও বাঁকা চোখে দেখা হয়নি। আর এখন তো মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফ থেকেই। একঝাঁক কিশোরী সাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, এ যেন সত্যিই অপ্রতিহত নারীত্বের ছবি।
অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায়
গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর
সাইকেলের রাস্তা
2 প্রায় সব বড় রাস্তার দু’ধারেই গাড়ি রাখার জন্য দশ ফুট করে জায়গা ব্যবহার করা হয়। অনেক জায়গায় সরকারের তার জন্য বাড়তি কোনও আয়ও হয় না। এই জায়গাটুকুতে সাইকেল চলার ব্যবস্থা হলে অনেকটাই সুবিধা হবে। এ ছাড়াও বড় রাস্তার মোড় পারাপার ও ছোট গলিতে চলাচলেরও সুবিধে হবে। পরিবেশ বাঁচলে, জ্বালানি সাশ্রয় হলে দেশেরও উন্নয়ন হবে।
আশিস ভট্টাচার্য
বারুইপুর পশ্চিম, দক্ষিণ ২৪ পরগনা