Jadavpur University

গভীর অসুখ

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনুশাসন থাকবে, নিয়মানুবর্তিতা থাকবে, কঠোর শৃঙ্খলা থাকবে— এটা অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। এই না-থাকাটাই গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:১৭
Share:

—প্রতীকী ছবি।

পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যতম গর্বের বিশ্ববিদ্যালয় আজ মুখ লুকোতে চাইছে। প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হবে, কে দায়ী এই অবস্থার জন্য? সম্পাদকীয় ‘বন্ধ হোক যথেচ্ছাচার’ (১৭-৮) এবং সুকান্ত চৌধুরীর ‘রাহুগ্রাসের পরিণতি’ (১৮-৮) সম্পর্কে এই পত্রের অবতারণা। আজ কর্তৃপক্ষ থেকে শিক্ষককুল, বর্তমান থেকে প্রাক্তন ছাত্রসমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বুদ্ধিজীবী মণ্ডল, সর্বোপরি রাজ্য প্রশাসন ও আচার্য হিসাবে রাজ্যপাল— কেউই তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, দায় না নিয়ে তাঁরা আজ একে অপরের দিকে দোষারোপের আঙুল তুলতে ব্যস্ত। সন্তানহারা পিতার আকুতিও তাঁদের বিবেক জাগ্রত করতে পারছে না।

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনুশাসন থাকবে, নিয়মানুবর্তিতা থাকবে, কঠোর শৃঙ্খলা থাকবে— এটা অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। এই না-থাকাটাই গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। অথচ, যাদবপুরে শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অনুশাসন প্রণয়নের জন্য কর্তৃপক্ষের অসহায়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ব্যাধি কত গভীর। অবাক লাগে যখন শুনি, হস্টেল সুপার হস্টেলে ঢুকতে ভয় পান। ব্যাপারটা এতটাই অস্বাভাবিক এবং হাস্যকর যে, প্রথম বার শুনে বুঝতে সময় লাগে যে ঠিক শুনলাম কি না। কর্তৃপক্ষের অসহায়তা ও উদাসীনতা ঘটনার বিবরণে পরতে পরতে প্রতিভাত ছাত্রটির মৃত্যু দেখিয়ে দিল এত নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের অব্যবস্থা।

এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও টিভিতে দেখছিলাম, একটি ছাত্র সিসিটিভি বসানোর বিরোধিতা করছে। তাতে নাকি তাদের ব্যক্তিগত পরিসরে উঁকি দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কবে থেকে ব্যক্তিগত হয়ে গেল! ওই মুষ্টিমেয় ছাত্রদের মতামতই বা জানতে চাওয়া হচ্ছে কেন? ছাত্রদের নিরাপত্তার স্বার্থে কর্তৃপক্ষের যত দূর যাওয়া উচিত মনে হবে, তত দূর যেতে কোনও দ্বিধা রাখা উচিত নয়। মুক্তচিন্তার দোহাই দিয়ে বিশৃঙ্খলার পরিবেশ কায়েম রাখতে যারা উদ্‌গ্রীব, তাদের প্রতি কোনও রকম সহানুভূতি আরও ক্ষতি ডেকে আনবে। স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার না করা গেলে তা স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হয়।

Advertisement

সুকান্তবাবু ‘হোয়াটঅ্যাবাউটরি-র ঢঙে বলছি না’ বলেও যা বলেছেন, সেটা না বললেই ভাল হত। পুরনো দুঃখজনক ঘটনা তুলে আনলে এই মুহূর্তের অসভ্যতা, নোংরামি লঘু হয়ে যেতে পারে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। এই সুযোগে রাজনৈতিক দলগুলো ঘোলা জলে মাছ ধরতে চেষ্টা করছে। সন্তানহারা পিতা-মাতার দুঃখমোচন নয়, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য এই সুযোগে যদি কিছু রাজনৈতিক লাভ তোলা যায়। সমস্ত দলই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল করছে। কিন্তু এত দিন কেন সবাই চোখ বুজে ছিল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। এটা বোধ হয় একটা মিথে পরিণত হয়েছে যে, শক্তপোক্ত হতে গেলে জীবনের শুরুতে কিছু অত্যাচার সইতে হয়। ছাত্রসমাজকেই প্রমাণ করতে হবে, এর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই, এটা অলীক কল্পনামাত্র।

সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি

ভুল পথে

‘রাহুগ্রাসের পরিণতি’ শীর্ষক সুকান্ত চৌধুরীর প্রবন্ধটি শিক্ষাঙ্গনে র‌্যাগিং-এর তাণ্ডব দমনের জ্বলন্ত হাতিয়ার। যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অলঙ্কার ও অহঙ্কার হল সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আজ অনেকেই ভুল পথের পথিক। তারা নানা অন্যায় অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়ছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনকে চরম বিড়ম্বনার মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নামীদামি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চ মেধাযুক্ত ছাত্রছাত্রীরাই পড়তে যায়। দুর্ভাগ্য আমাদের, তারাই আবার দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘র‌্যাগিং’ শব্দটি শুধু দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রতিশব্দ নয়, বর্তমানে প্রায় খুনের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে, যা খুবই দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয়। ছাত্রমৃত্যুতে অভিযুক্তের তালিকায় নাম উঠে আসে অপর ছাত্রের। এক ছাত্র র‌্যাগিং করে আনন্দ পায়, আর এক ছাত্রকে অত্যাচার সহ্য করতে হয়, কখনও তাকে মরতেও হয়। হায়! আমরা গর্ব করে বলি যাদবপুরের মতো আন্তর্জাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল বুদ্ধিমানদের পীঠস্থান। সেই স্থান কেন দুষ্কর্মের আঁতুড়ঘর হবে? কেন শিক্ষাঙ্গনে রক্তের দাগ থাকবে? হস্টেল কেন হবে হত্যাপুরী? কত মা-বাবা অতি কষ্টে বড় করে তোলেন তাঁদের আদরের সন্তানকে। সেই সন্তানকে নিয়ে বহু আশাদীপ জ্বালিয়ে রাখেন তাঁরা তাঁদের মনের কোণে। শুধু মা-বাবা তো নন, ছাত্রছাত্রীরাও মনে মনে কত স্বপ্নজাল বোনে। র‌্যাগিংয়ে এক মুহূর্তে সেই স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। র‌্যাগিংকে কেন্দ্র করে এর আগেও আলোড়ন হয়েছে, র‌্যাগিং বন্ধে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করাও হয়েছে। কিন্তু কোনও ফল পাওয়া যায়নি।

আর একটি বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবার সময় এসেছে। শিক্ষাঙ্গনে বা হস্টেলে প্রাক্তনীদের বিনা প্রয়োজনে আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়া দরকার। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যদি তথাকথিত রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়, তা হলে অনেক সমস্যার সমাধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই করে ফেলবেন। রাজনীতির মাঙ্গলিক দিকটি আজ ক্রমশ দলীয় স্বার্থপরতার চাদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কোনও অন্যায়কে দলীয় সংগঠনগুলি একযোগে ‘অন্যায়’ বলে প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠতে পারে না। তার নিদর্শন চোখের সামনেই উঠে এল। বিদ্যাপীঠে হাসিমুখে এক দল ছাত্র আসে, আর এক দল ছাত্র হাসিমুখে বিদায় নেয়— চিরাচরিত এই ধারা প্রবাহিত হোক।

পরিশেষে প্রবন্ধকারের শেষ বাক্য দিয়ে শেষ করি— “আজ দুর্গতির দিনে যাদবপুরই এগিয়ে আসুক বিদ্যামন্দির থেকে এই অপদেবতাকে দূর করতে।”

সত্যকিঙ্কর প্রতিহার, যমুনা দেশড়া, বাঁকুড়া

অপূরণীয়

‘রাহুগ্রাসের পরিণতি’ শীর্ষক প্রবন্ধটির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করছি। যাদবপুরের এই মর্মান্তিক ছাত্রমৃত্যুর দায় কেবলমাত্র ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক বা প্রশাসকদের উপরে চাপিয়ে দিলে সমস্যার গভীরে গিয়ে তাকে বোঝবার জায়গায় একটা বড়সড় ফাঁক থেকে যাবে। ‘এলিট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ বা ‘মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র’— যা-ই বলি না কেন, যাদবপুর কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। তা বৃহত্তর সমাজেরই একটি অংশ। এই প্রসঙ্গে, সুকান্তবাবু সঠিক ভাবেই নিরন্তর ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক এবং সামাজিক হিংসার উদাহরণগুলি তুলে ধরেছেন। এই প্রাণঘাতী র‌্যাগিং সেই হিংসারই আর একটি প্রকাশভঙ্গি মাত্র। এর দায় আমাদের সবার। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। কয়েক জন ছাত্র গ্রেফতারও হয়েছে।

কিন্তু র‌্যাগিং একটি সংগঠিত হিংসার ঘটনা। তাই গ্রেফতার হওয়া গুটিকয় ছাত্রই দোষী, এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। সংবাদমাধ্যম থেকে যেটুকু জেনেছি, তাতে এদের বেশির ভাগই গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়তে এসেছিল দেশের এই প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে। কোন পরিস্থিতিতে বা কাদের প্ররোচনায় তারা এমন হিংস্র হয়ে উঠল, তাও বোধ হয় তদন্তের আওতায় আসা দরকার। মৃত ছাত্রটি এবং তার পরিবারের জন্য কোনও সান্ত্বনাই যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যতে আর কোনও শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গ যাতে না হয়, সে জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরেই সচেতনতা জরুরি। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এখন থেকে র‌্যাগিং নিয়ে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নেবেন। আর একটি অনুরোধ, যে ছাত্রগুলি গ্রেফতার হয়েছে, তাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব যেন আমরা না দেখাই। অপরাধ প্রমাণিত হলে তারা আইনমাফিক শাস্তি পাবে। এতগুলি মেধাবী ছাত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে গেলে তাও তো সমাজের অপূরণীয় ক্ষতিই!

কুহেলী চক্রবর্তী, অ্যান্ড্রুজ় পল্লি, বীরভূম

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement