—প্রতীকী ছবি।
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পরিবেশপাঠের হাল’ (১০-৬) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, পরিবেশ রক্ষার মৌলিক বিষয়গুলি না জানাই কি আমাদের নির্দ্বিধায় পরিবেশ ধ্বংসের পথে চালনা করছে। তা না হলে নির্বিচারে গাছ কাটা,পুকুর বুজিয়ে বহুতল গড়া, বাতাসে নিরন্তর কালো ধোঁয়া ছেড়ে যাওয়ার সাহস আমরা পেলাম কোথা থেকে? আমাদের সাধারণ বুদ্ধি কেন আমাদের নিজেদের সম্পদগুলো সংরক্ষণ করার, এমনকি নিজের খরচ বাঁচানোর কথাও ভাবাল না?
আজ সবচেয়ে বড় সমস্যা জলবায়ু সঙ্কট, যার মূলে রয়েছে মানুষের সচেতনতার তীব্র অভাব। ভারতীয় সংবিধানে বলা হয়েছে, বনভূমি, জলসম্পদ, বন্যপ্রাণী ইত্যাদি যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা নাগরিকের অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু এই কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কি সজাগ? প্রথমত, আমাদের জানা প্রয়োজন পরিবেশ দূষণের মূল কারণগুলি সম্পর্কে। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক সম্পদের যথোচিত ব্যবহার ও তার সংরক্ষণের উপায় জানা চাই। তৃতীয়ত, কোন কার্যকলাপ থেকে কতখানি দূষণ ছড়াতে পারে তার তুলনামূলক বিচার এবং সেই দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী করা উচিত, এই নিয়ে ব্যাপক চর্চার প্রয়োজন। পাঠ্যবিষয় হিসাবে যাঁরা পরিবেশবিদ্যা নিয়ে পড়ছেন, তাঁদেরও দায়িত্ববান হতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে পরিবেশবিদ্যার একটা বিরাট অংশ বাদ দিয়ে দিয়েছে, যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেমন, বিভিন্ন প্রকৃতিক সম্পদ, বনজ, খনিজ সম্পদ এবং তাদের ব্যবহার ও সংরক্ষণ, জল সংরক্ষণ বাদ দিয়েছে। এমনটা মোটেই কাম্য নয়। এর ফলে পরিবেশবিদ্যার পাঠ যে কতখানি বাস্তবে কাজে লাগবে, সেটাই প্রশ্ন। পরিবেশ সম্পর্কে ছাত্রদের সচেতনতামূলক জ্ঞান থাকা জরুরি। মনে রাখতে হবে, পরিবেশবিদ্যা মানবজীবনেরও অংশ, যাকে কাজে লাগাতে হবে পরিবেশের স্বার্থে। প্রয়োজনে পরিবেশ ধ্বংসকারী সরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে হবে।
উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর, হুগলি
কঠোর বিধি
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায় একটি সময়োপযোগী উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছেন। পাঠ্য হিসাবে পরিবেশবিদ্যা এসেছে বটে, তবে তা পড়ে আমরা কত জন পরিবেশ-সচেতন হয়ে উঠেছি, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। আমরা যারা সন্তানদের পরিবেশপাঠ পড়াচ্ছি, তারাই বা কত জন পরিবেশ-সচেতক হিসাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছি? স্কুল-কলেজের শিক্ষক থেকে সরকারি, বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী থেকে কেরানি— হাতে একটু উদ্বৃত্ত অর্থ এলেই আমরা কিনে ফেলি একটি চার চাকার গাড়ি। বাড়ি করার পর খালি জায়গাটিতে গাছ না বসিয়ে সিমেন্ট দিয়ে মুড়ে ফেলি। যে কাজটি হেঁটে করে ফেলা সম্ভব, সেটার ক্ষেত্রেও মোটরবাইক ব্যবহার করি। রাস্তায় অযথা গাড়ির হর্ন ব্যবহার করি।
অন্য দিকে, এই দেশে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে পারেন না। এঁদের কাছে পরিবেশবিদ্যা কী এবং এর প্রয়োজনীয়তা কোথায়, তা অজ্ঞাত থেকে যায়। অথচ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দাদাদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে তাঁদের হাতে আসে বেশ কিছু উদ্বৃত্ত অর্থ। এই অর্থ তাঁরা ব্যবহার করেন ডিজে বক্স বাজিয়ে, তীব্র গতিতে মোটরবাইক চালিয়ে, জলাশয় বুজিয়ে দোকানঘর বা ক্লাবঘর বানানোর জন্য।
আমার মতে, পরিবেশ রক্ষার জন্য কেবল সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, দরকার আইনানুগ দ্রুত ব্যবস্থা করা। পরিবেশ-আদালতকে আরও বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পরিবেশ-আদালত যেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের ‘প্রাইজ় পোস্টিং’ হিসাবে বিবেচিত না হয়। এ বিষয়ে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলটিরও বিশেষ ভূমিকা আছে। শাসক দল যদি পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়, তা হলে ভয়ে হোক বা ঔচিত্য বোধ থেকেই হোক, পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে আমরা প্রায় সকলেই বিধিগুলো মেনে চলব। কিছু জন তা মানবেন না, তাঁদের জন্য তো পুলিশ-আইন-আদালত আছেই। তাই পরিবেশ বিষয়ে বাস্তবে যথার্থ ফল পেতে দরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে শাসক দলটির পরিবেশবান্ধব মানসিকতা। আমরা এক জন নাগরিক হিসাবে যে কাজটা করতে পারি, তা হল সমাজে এই বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে নিরন্তর প্রশ্ন করে চলা।
প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি
মূল লক্ষ্য
২০০৬-০৭ সাল থেকে স্কুলে এবং ২০১৩-১৪ সাল থেকে কলেজে পরিবেশবিদ্যার পাঠ শুরু হয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম জলবায়ু সঙ্কট, বিশ্ব উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউস এফেক্ট ইত্যাদি গালভারী শব্দের সঙ্গে পরিচিত। বর্তমান পাঠ্যক্রম থেকে বাদ গেছে শক্তির উৎস ও শ্রেণিবিভাগ, সৌরশক্তি ও অন্যান্য নিরবচ্ছিন্ন সম্পদের কথা, পুনর্নবীকরণযোগ্য বা অযোগ্য সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। পরিবেশবিদ্যার পাঠ বোধমূলক নয়, হয়ে যাচ্ছে জ্ঞানমূলক।
জ্ঞানমূলক পাঠ এক জন পড়ুয়ার জ্ঞান বাড়াতে পারে, কিন্তু বোধের সঞ্চার ঘটায় কি? এই সঙ্কট এতটাই তীব্র যে, এর সমাধানে দরকার নাগরিক সচেতনতা ও প্রশাসনের স্বচ্ছ, বৈজ্ঞানিক, নিরপেক্ষ, ব্যক্তি বা রাজনৈতিক স্বার্থমুক্ত হস্তক্ষেপ। যার জন্য দরকার পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা। ২০০৯ সালে ছত্তীসগঢ়ের হাসদেও আরান্ড জঙ্গলে কয়লাখনি প্রকল্প কতখানি ক্ষতিকর, তা বোঝা এবং পরিবেশকর্মী ও সংগঠনের পাশে দাঁড়ানো দরকার। অযথা বিদেশি ষড়যন্ত্রের নামে পরিবেশকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে, বা তাঁদের দ্বারা সংগঠিত আন্দোলনকে ভয় দেখিয়ে, বা হেনস্থা করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজকে দুর্বল না করাই কর্তব্য। তাই পরবর্তী কালে পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের আগে পরিবেশ ও রাজনীতির কোলাকুলি খুবই জরুরি। আমরা যারা কিছুটা অজ্ঞতা আর অনেকটা লোভের জন্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ পরিবেশে বাঁচা ও পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি, তাদের সংঘবদ্ধ ভাবে সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করতে হবে। পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের সেটাই লক্ষ্য হোক।
আম্রপালি বসু, শিক্ষিকা, শ্যামবাজার এ.ভি. বিদ্যালয়
দ্বিচারিতা
একটা দিন সবাই পরিবেশবিদ হয়ে যায়— দিনটি হল ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সে দিন পরিবেশ নিয়ে কত শত লেখায় প্রতিটি পত্রিকা, ম্যাগাজ়িন ছয়লাপ। প্রতি বছর নানা আন্তর্জাতিক সংগঠনের লোকদেখানো মিটিং-এর পর জারি হয় নানা রকম প্রতিশ্রুতি, স্লোগান, নিদান, হুঁশিয়ারি। দেখেশুনে হাসি পায়। যে দেশ পাট উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, সেখানে আজও চটকল বন্ধ হয়। শালপাতার বদলে থার্মোকলের থালা-বাটিতে অনুষ্ঠান বাড়ি ছেয়ে যায়। পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট হয়, গাছ কেটে রাস্তা চওড়া হয়। অথচ, বছরে এক দিন পরিবেশ বাঁচানোর সে কী প্রবল তাগিদ।
এ বছরের পরিবেশ দিবসের থিম ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করো’ (বিট প্লাস্টিক পলিউশন)। প্লাস্টিক দূষণ কমানোর এত পরিকল্পনা, অথচ প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করার কোনও ঘোষণা নেই। ব্যাপারটা এ রকম যে, কোম্পানি নিজের মতো প্লাস্টিক তৈরি করে মুনাফা করবে, কিন্তু বিক্রেতা বা উপভোক্তার কাছে প্লাস্টিক পেলেই তাঁদের জরিমানা করা হবে। প্লাস্টিক দূষণ কমানোর একটাই সমাধান— ২০০০ টাকার নোটের মতো প্লাস্টিক উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করা। এর কোনও দ্বিতীয় সমাধান সূত্র নেই। সবুজ ধ্বংস করে সবুজায়নের নিদান যেমন হাস্যকর প্রলাপ, তেমনই হাস্যকর প্লাস্টিক উৎপাদনকে পথ ছেড়ে দিয়ে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করার অঙ্গীকার।
তন্ময় প্রামাণিক, কৃষ্ণনগর, নদিয়া