প্রতিবাদ।
তূর্য বাইনের ‘শিক্ষকের সৎ ও অসৎ’ (৪-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটি মনে পড়িয়ে দিল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা-র প্রবেশদ্বারে উৎকীর্ণ বিখ্যাত উক্তিকে, “কোনও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। এ ভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত দালান-কোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এ ছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হল একটি জাতির অবলুপ্তি।” এখানে ‘শিক্ষার্থী’র জায়গায় ‘শিক্ষক-পদপ্রার্থী’ রাখলেই আমাদের সঙ্কট বোঝা যাবে।
প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে বাঁকুড়ার এক প্রাথমিক শিক্ষকের বৃত্তান্ত, যিনি নাকি প্রাথমিক পর্যায়ের বাংলা, অঙ্ক পারছেন না। অনৈতিক নিয়োগ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কী শোচনীয় মানের ব্যক্তিদের উপর জাতির কাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক ক্ষতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল পরবর্তী কালের ক্ষতি ও দুর্ভোগের পরিমাণ। এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতেও হয়তো অনেক বেশি ক্ষতি বর্তাবে উত্তর প্রজন্মের উপরে।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
বৈধ নয়
ধর্না মঞ্চের অদূরে কার্নিভাল হবে, তাই ‘নিরাপত্তার জন্য’ ধর্নায় বসার অনুমতি দেয়নি রাজ্য সরকার। আন্দোলনকারীরা কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হলে বিচারপতি রাজশেখর মান্থা জানিয়েছিলেন যে, যোগ্য প্রার্থীরা রাস্তায় চাকরি ভিক্ষা করবেন এবং পুলিশ পুজোর দোহাই দিয়ে আন্দোলন করতে দেবে না, এটা হতে পারে না। আসলে পুজোর সময়ে রাজ্যের যোগ্য প্রার্থীদের চাকরির জন্য হাহাকার সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে যাবে, তা রাজ্য সরকার চায়নি। ইতিমধ্যেই মন্ত্রী থেকে আধিকারিক, বেশ কয়েক জন চাকরি বিক্রির অভিযোগে হাজতবাস করছেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হল বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর একটি মন্তব্য। তিনি বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী নাকি কারও চাকরি খাওয়ার পক্ষপাতী নন। তাই, অবৈধ চাকরিকেও বৈধতা দিতে তিনি নতুন পদ সৃষ্টি করতে বলেছেন। অযোগ্য প্রার্থীর অনৈতিক নিয়োগকে কী করে বৈধতা দিতে পারে সরকার? আশঙ্কা হয়, দলের নেতারা ‘চাকরি বিক্রি’র অর্থ ফিরিয়ে দিতে নারাজ, বা ফেরানো অসম্ভব, তাই এই চাতুরির ব্যবস্থা। মহামান্য আদালতের কাছে বিনীত নিবেদন, যে বা যারা চাকরি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রত্যেককেই কঠোর সাজা দিয়ে সমাজের কাছে যেন একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় যে, আগামী দিনে যাঁরা অনুরূপ কাজ করবেন, তাঁদেরও একই অবস্থা হবে।
তপন কুমার ঘোষ, শ্রীরামপুর, হুগলি
দর্শনের টিকিট
‘সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ ধীরে ধীরে ‘অর্থজনীন দুর্গোৎসব’-এ পরিণত হয়ে যাচ্ছে না তো? শারদোৎসবের আনন্দের দিনগুলো দিন দিন যেন মন-খারাপের দিন হয়ে উঠছে। বাঙালির সর্বজনীন দুর্গোৎসবকে গত বছর ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক উৎসবের স্বীকৃতি দিয়েছে, যা গর্বের বিষয়। কিন্তু আক্ষেপ, কিছু কিছু পুজো-উদ্যোক্তাদের তৎপরতায় সর্বজনীন দিন দিন হয়ে উঠছে অর্থজনীন। বেশ কিছু পুজোমণ্ডপে দেখা যায়, পুজো কমিটির সদস্যরা প্রতিমা দর্শনের জন্য পুজো প্যান্ডেলে ভিআইপি গেট তৈরি করেন, এবং ওই গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হলে দর্শনার্থীদের টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয়। উদ্যোক্তাদের যুক্তি, দর্শনার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিমা দর্শনের কথা মাথায় রেখে এই ব্যবস্থা। বিনা অর্থে বিশেষ ভাবে সক্ষম, বা বৃদ্ধ মানুষদের জন্য বিশেষ প্রবেশ দ্বার ব্যবহৃত হলে অবশ্যই তা মানবিকতার পরিচয়। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে কাউকে ‘ভিআইপি’ সুবিধে দেওয়া কখনওই শুভ লক্ষণ নয়।
দুর্গাপুজোর চার দিন কষ্ট করে লাইন দিয়ে প্রতিমা দর্শনের অনুভূতিটাই তো আলাদা। ‘স্বাচ্ছন্দ্য’ দিতে গিয়ে তার উপর আঘাত হানা কেন? হয়তো এমন এক দিন আসবে যে দিন টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ না করলে কোনও দর্শনার্থীকেই প্রতিমা দর্শনের জন্য মণ্ডপে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অবিলম্বে এই দূষিত সংস্কৃতি প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথ রায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
স্মৃতির পুজো
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘বাড়িতে হাজির দুর্গাপ্রতিমা’ (১-১০) পড়ে মনের মধ্যে কত দৃশ্যপট ভেসে উঠল। পঞ্চাশ বছরেরও আগে শীর্ষেন্দুবাবুর লেখা প্রথম পড়েছিলাম পুব বাংলার গ্রামে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাওয়া বেতার জগৎ শারদ সংখ্যার এক উপন্যাসে। তাঁর ‘পাতালঘর’ বড় গল্পটিও বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রেক্ষিতে লেখা। কিন্তু এই প্রবন্ধটির প্রতি আত্মিক টান অনুভব করলাম। উৎসবের উন্মাদনা, থিমের ব্যবহার, প্যান্ডেলের বৈচিত্র, আলোকসজ্জা নিশ্চয়ই আকর্ষণ করে, নইলে এই পরিণত বয়সেও কেন লাইন দিয়ে কলেজ স্ট্রিট, লেবুতলা পার্ক, শ্রীভূমিতে সবার রঙে রং মেশাতে যাই?
কিন্তু ওই যে লেখকের বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমা আনার পরে ঠাকুরমার নির্দেশে বাড়িতেই প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আয়োজনের ব্যবস্থাপনায় ছোটদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত, যে পুজো চলেছিল কালান্তক দেশভাগ পর্যন্ত, তা যেন স্মৃতির সুতোর এক টানে ষাটের দশকের পুব বাংলার আমাদের ছোটবেলার প্রাচীন চকমিলানো জমিদার বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপের একচালা দুর্গাপ্রতিমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। তখন দু’শো বছরেরও বেশি পুরনো আমাদের, রায়চৌধুরীদের এই দুর্গাপুজো ছিল গ্রামের একমাত্র পুজো। তা নিয়ে গ্রামে উৎসাহ আনন্দের অবধি থাকে না। পুজোর দু’মাস আগে বাবা কাছারিঘরের বাইরের চওড়া চাতালে গ্রামবাসীদের নিয়ে বসতেন। তিনি অর্ধেক খরচ দিতেন, বাকি অর্ধেক গ্রামবাসীরা মিলে দিতেন। উৎসব শুরু হত মহালয়ার ভোরে আধো অন্ধকারে। আমাদের দোতলার লম্বা বারান্দায় গ্রামের লোকেরা এসে টানা শতরঞ্চিতে বসে টেবিলের উপর রাখা মারফি রেডিয়োতে ‘বীরেন ভদ্দর’-এর চণ্ডীপাঠ শুনতেন। প্রাইমারি স্কুল থেকে এসে আমরা ভাইবোনেরা বদ্দে বৈরাগীর ঠাকুর গড়া দেখতাম। খড়ের কাঠামোয় একমাটি, দোমাটি, ছাঁচে প্রতিমার মুখ, খড়ির সাদা রং টানা, তার পর বিভিন্ন রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠত একচালা দুর্গাপ্রতিমা। পঞ্চমীতে গর্জন তেল টানার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃপ্রতিমা একেবারে ঝলমল করে উঠত। ষষ্ঠীতে মায়ের বোধনের আগে থেকেই আমাদের দক্ষিণের ‘সিংহদরজা’, পুবের কাছারিঘর দিয়ে ভিতরে আসার দরজা, সব হাট করে খুলে দেওয়া হত। মায়ের চক্ষুদান, প্রাণপ্রতিষ্ঠার সময় মা, ঠাকুরমা, গ্রামের সমবেত মহিলা-পুরুষের শঙ্খ, উলুধ্বনি, কাঁসরঘণ্টা, ঢাকের বাদ্যি, ধূপধুনোয় চণ্ডীমণ্ডপ, সামনের উঠোন একেবারে ভরে যেত। নতুন জামা, অষ্টমীতে বিশাল কাঠের বারকোশে ঘিয়ে-ভাজা লুচির ভোগের গন্ধ, স্নান করে কাচা জামা পরে আলতো হাতে একশো আটটা পদ্মের কুঁড়ি ফোটানো, এ ক’দিন পড়া নেই, তাই খেলাধুলো, আনন্দের ঘড়া ষোলো আনা পূর্ণ হয়ে যেত। অষ্টমী-নবমী দু’রাত স্টেজ বেঁধে যাত্রাপালা, পুরো গ্রাম যেন ভেঙে পড়ত বাড়ির অঙ্গনে। বিজয়া দশমীর সকালে যাত্রামঙ্গল পড়ে আমরা যখন মাতৃপ্রতিমা প্রদক্ষিণ করতাম, আমার মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভয়াবহতায় আমরা চিরতরে এ-পার বাংলায় চলে আসি। আমার বাবার শিক্ষকগুরু জ্যাঠামশায়, আমাদের সেজো ঠাকুরদামশায় বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তাই বাংলাদেশ সরকার আমাদের বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছে। খবর পেয়েছি, গ্রামবাসীরা এখনও বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে প্রতি বছর দুর্গাপুজো করেন।
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১