নিরন্তর এক অজ্ঞাত প্রতিযোগিতা আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ফাইল চিত্র।
‘নিজেই দৃশ্য, নিজেই দর্শক’ (২১-১) শীর্ষক শ্রীদীপের লেখাটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী। এখন ছবি তোলার কত সুযোগ আমাদের হাতের মুঠোয়। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে খাবার খেতে খেতে নানা রকম ভঙ্গিতে আমরা ভাল-মন্দ অসংখ্য ছবি তুলতে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। নিজের ছবি নিজেই তুলছি, আর যা খুশি একটা কিছু লিখে সেই ছবি পোস্ট করছি সমাজমাধ্যমে। কিছু ক্ষণ অন্তর দেখছি, কত জন লাইক করল। তাতেই আমাদের পরিতৃপ্তি। স্থান, কাল, পাত্র কিছুই বিচার করছি না। প্রয়াত থেকে সদ্যোজাত, সকলের ছবিই তুলছি। এখন খুব সহজেই জানতে পারি, কে কোথায় বেড়াতে গেল, বা কার বাড়ি নিমন্ত্রণে গেল।
পুরনো এক ঘটনার কথা বলি। এক দিন আমার কাকা এসে বললেন, দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়া হবে। মধ্যবিত্ত পরিবারে খুশির হাওয়া বয়ে গেল। রোজ রাতে আলোচনায় বসা হত, সঙ্গে কী কী নেওয়া হবে, কে কী পোশাক পরবে। অনেক রাতে ঘুম আসত না চোখে। কাকাকে আমরা খুব ভয় পেতাম। ভয়-সংশয় ভেঙে বড়দা এক দিন একটা ইচ্ছের কথা বলেই ফেলল কাকাকে। কাকাও রাজি হয়ে গেলেন। সত্যিই তো, দার্জিলিং বেড়ানোর স্মৃতি তো ছবিতে ধরে রাখতে হবে। রাতে কাকা যখন আমাদের সামনে কোড্যাক ক্যামেরার বাক্স খুলে দেখাচ্ছেন, তখন আমরা উত্তেজনায় কাঁপছি। কী ভাবে ব্যবহার করা হবে? কী করে ছবি দেখতে পাব? একটা ছোট কালো শিশির মতো জিনিস, ওই হল ফিল্ম। ব্যাটারি লাগানোর জায়গায় ব্যাটারি লাগানোর পদ্ধতি কী? সব জানার পর কী আনন্দ, আমরা নিজেরাই এখন ছবি তুলতে পারব! ফিল্মে সব ছবি তোলা হলে তার পর ছবি পাব। এর পর আরও উত্তেজনা— সব ছবি তোলা হল, অন্ধকার ঘরে ক্যামেরা থেকে ফিল্ম অতি সাবধানে খুলে ওয়াশ করতে দেওয়া হল। আলো লাগলে ছবি নষ্ট হয়ে যাবে। সাত দিন দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা— কেমন ছবি হল? লাইট ঠিক হল কি না? গ্রুপ ফটো থেকে কেউ বাদ চলে গেল না তো? অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে হাতে পাওয়া খামে-ভরা সাদা-কালো ছবি আর নেগেটিভ। ভাবাই যায় না সে সব অভিজ্ঞতা।
আর আজ আমরা ছবি তুলছি, ভাল না লাগলে মুছে ফেলছি, আবার ছবি তুলছি। সর্বদা ব্যস্ত হয়ে পড়ছি, এই বুঝি আমি পিছিয়ে পড়লাম অন্য জনের চেয়ে। কিসের প্রতিযোগিতা জানি না। কিন্তু নিরন্তর এক অজ্ঞাত প্রতিযোগিতা আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই মুহূর্তের জন্যও হাতছাড়া করি না এই মুঠোফোন।
তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি
পড়ার অভ্যাস
আরও একটি বইমেলা চলে গেল, আবারও প্রশ্ন উঠল বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে। ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো’। অনেকেই মনে করেন, বই পড়াটা আজ একটি ক্লান্তিকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও বলা হয়, বই আমাদের ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে, কারণ বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়, প্রতিটি চরিত্রে নতুন কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও আগামী প্রজন্ম ঠিক কতটা বইমুখী হতে পারছে, আমরা কতটা তাদের বইমুখী করতে পারছি, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
হয়তো কর্মব্যস্ততা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার জন্যই বই পড়ার ইচ্ছের শিকড় কিছুটা মাটি থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন আর কাউকে জন্মদিনে বই উপহার দিতে সচরাচর দেখি না। বই উপহার দেন, এমন মানুষের সংখ্যা এখন খুবই কম। পাঠ্য বই, সহায়িকা বই এ সবের পরে আর গল্পের বই বা উপন্যাস পড়ার সময় নাকি থাকে না! অথচ, হাজার ব্যস্ততার মাঝেও সময় বার করে মুঠোফোন নিয়ে বসে থাকার সময় ঠিকই পাওয়া যায়।
একটি বই এক জন অভিভাবকের ভূমিকা যেমন পালন করে, তেমনই বন্ধুরও। আজকাল কিশোর-তরুণদের মধ্যে বিষণ্ণতা বাড়ছে। তারা কোনও বিষয়ে মনোযোগী হতে পারছে না। ভার্চুয়াল জগতে অধিক বিচরণের ফলে ‘স্ট্রেস’ অনেক বেড়ে যায়, কমে যায় উৎপাদনশীলতা। মানসিক চাপ কমানোর জন্য আমাদের উচিত তাদের সামনে বইকে তুলে ধরা। তাতে কল্পনাশক্তি, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তিও বাড়ে। ছুটির দিনে একটি ভাল বই সন্তানের সামনে এনে ধরতে হবে অভিভাবকদের। স্কুলেও অন্তত একটি পিরিয়ড লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দ রাখা দরকার। অনেক বিদ্যালয়েই এই নিয়ম আছে। যে সব জায়গায় নেই, সেখানেও পড়ার বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়াকে আবশ্যক করতে হবে।
সৃজিতা ধর, হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
সংবাদের মুক্তি
‘মুক্তি কোথায়’ (৮-২) সম্পাদকীয় মনে করিয়েছে, ভারতে সাংবাদিক নিগ্রহের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু সিদ্দিক কাপ্পানের আটাশ মাস কারাবাস অতীতের সব দৃষ্টান্তকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সাংবাদিকের প্রতিবেদন সরকারকে অস্বস্তিতে ফেললে সাংবাদিকের উপর সরকারের রোষবর্ষণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ সরকার কেরলের এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করে কেবল তাঁর প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার আগেই শুধু নয়, সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাংবাদিক ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথেই।
সিদ্দিক কাপ্পানের গন্তব্য হাথরসে গণধর্ষিতা তরুণীর ‘দলিত’ পরিচয় যে ভাবে তার ভাগ্য নির্দিষ্ট করেছিল, ঠিক সে ভাবেই যেন সাংবাদিকের ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয় তাঁরও স্থান নির্দিষ্ট করেছিল জেলে। হাথরসের ঘটনার উপর যখন সারা দেশের চোখ নিবদ্ধ, তখন কাপ্পানের হয়রানি যে দেশের সব সাংবাদিক এবং বিরোধীকে ভয় দেখিয়ে সত্যসন্ধান থেকে বিরত করার কৌশল, তা বুঝতে কারও কোনও অসুবিধা হয়নি। কাপ্পান জামিনে মুক্তি পেলেও, সাংবাদিকতার মুক্তি কই?
অশোক দত্ত, উলুবেড়িয়া, হাওড়া
সুখাদ্যের আড়াল
‘বাসনার বাসা’ সম্পাদকীয়টির (২৯-১) বিষয়বস্তু ভোজন রসিকদের মনে দোলা দেবেই! বিশ্বের সেরা রেস্তরাঁ বলে সমাদৃত ডেনমার্কের ‘নোমা’-র অভিনব খাবারগুলির উল্লেখ অবশ্যই হৃদয়গ্রাহী। তবে গোটা বিশ্বের রেস্তরাঁ ব্যবসায় মন্দা চলছে, অর্থনৈতিক কারণে এই রেস্তরাঁটিও বন্ধ হতে চলেছে। আজ আমরা দেখছি, এক দিকে উচ্চ মানের খাবার প্রস্তুত করার জন্য যে শ্রম বা নিষ্ঠার প্রয়োজন, তার সঠিক মূল্য দেওয়া যাচ্ছে না, অন্য দিকে খদ্দেরদের স্বার্থে মূল্য বাড়াতেও মালিকরা রাজি হচ্ছেন না। আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন নিচু তলার কর্মচারীরা, যাঁদের নিরলস পরিশ্রমে ওই সুস্বাদু খাদ্যগুলি পরিবেশিত হচ্ছে। পৃথিবীর সর্বত্র সব ধরনের কাজের লোক, বিশেষত রন্ধনপটু মানুষ মেলে না, সে কারণেই পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। যথাযথ ভাবে উল্লিখিত হয়েছে, কোনও দেশে যখন আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা দীর্ঘস্থায়ী উৎসব সংগঠিত হয়, তখন প্রচুর পরিযায়ী শ্রমিকদের আনতে হয় এবং তাঁদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক এজেন্টরা যতটা সম্ভব কম দেওয়ার চেষ্টা করেন, যাতে নিজেদের লভ্যাংশে খামতি না থাকে।
এখন কলকাতায়, এমনকি শহরতলিতেও অ্যাপ-এর মাধ্যমে খাবারদাবার, মাসকাবারি জিনিসপত্র, আনাজপাতি, মাছ-মাংস বাড়িতে বসে ক্রয় করার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। ব্যবস্থাটি অবশ্যই সুবিধাজনক। কিন্তু যাঁরা এ সব বহন করেন, তাঁদের পারিশ্রমিক যথেষ্ট নয়। আবার দেরি করে পৌঁছলে জিনিসের মূল্য ক্রেতা ফেরত পান, কিন্তু তা বাহকের মজুরি থেকে উসুল করে নেওয়া হয়। বাহকরা যেমন বিদ্যুৎ গতিতে বাইক বাহনে যাতায়াত করেন, তাতে যে কোনও সময়ে তাঁদের দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এঁদের অবস্থা পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকেও খারাপ। সুখাদ্য আমাদের রসনা তৃপ্তি করে ঠিকই, কিন্তু যাঁরা তার কারিগর বা বাহক, তাঁদের নিয়েও এ বার ভাবার সময় এসেছে।
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি