‘মায়াময়’ (কলকাতার কড়চা, ৪-১) অনেক স্মৃতি উস্কে দিল। ১৯৬১ সাল, নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র নাটকটির তখন সবেমাত্র কয়েকটি অভিনয় হয়েছে। এমনই একটা সময়ে আমরা কয়েক জন অজিতদার (অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে আড্ডা জমিয়েছি। অজিতদা ঘোষণা করলেন, পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কেয়া (চক্রবর্তী) কিছু দিনের জন্য ছুটি চেয়েছে। আমি আঁতকে উঠলাম— তা হলে আমাদের শো-এর কী হবে? অজিতদা বললেন, “কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না। একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।” অজিতদা যতটা নিশ্চিন্তে কথাটা বললেন, আমরা অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। এর কিছু দিন পরে রিহার্সালে অজিতদার হাত ধরে এসে পৌঁছলেন মায়াদি, মানে মায়া ঘোষ। তাঁর মহলা দেখে আমরা খুবই উল্লসিত হয়ে উঠলাম। শুনলাম, খুব গরিব ঘরের মেয়ে মায়াদি। কিছু দিন পরে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা অজিতদা, আমাদের দল (নান্দীকার) মায়াদিকে অভিনয়ের জন্য কত টাকা দেয়?” অজিতদা শান্ত স্বরে বললেন, “ওই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীকে আমরা শো প্রতি ৮০ টাকা দিতে পারি। আমাদের দল বড় হলে প্রত্যেক কর্মীকেই ৮০ টাকা করে দিতে পারলে ভাল লাগবে, টাকাটা নিতে মায়ারও খারাপ লাগবে না।”
এক বার বাঁকুড়ায় কংসাবতী রিজ়ার্ভ প্রজেক্টের কাছে শো। খুব শীত। নাটকে একটা জায়গায় মায়াদির আমাকে চড় মারার একটা দৃশ্য ছিল। শো-এর আগে মায়াদিকে বললাম, ভীষণ শীত করছে, আপনি চড়টা একটু আস্তে মারবেন। মায়াদি ‘ঠিক আছে’ বলায় আশ্বস্ত হয়ে স্টেজে ঢুকে পড়লাম। নির্দিষ্ট জায়গা আসতেই মায়াদি বেশ জোরে চড় কষালেন। অভিনয় শেষ হতে আমার গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “কিছু মনে করিস না, অভিনয় করার সময় আর কিছুই খেয়াল থাকে না।”
সুরঞ্জন রায়, নয়ডা
শিল্পের স্বাদ
‘অভিনয়’ নামক শিল্পকর্মটি এমনই আশ্চর্যজনক, এতটাই জটিল যে, যত বয়স বাড়ছে কেমন এক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছি। এর মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দও আছে। চার পাশে যখন দেখি অতীব সাধারণ মানের অভিনয় নিয়ে লোকজনকে উচ্ছ্বাস করতে, তখন ভারাক্রান্ত লাগে, আবার খুশি হই, আশ্বস্তও হই এই ভেবে যে, উন্নত বা ভাল যা কিছু, তার চর্চা এতটাই নিম্নগামী যে, মধ্যমানের জয়জয়কারই তো স্বাভাবিক। বিশ্বাস করতে ভালবাসি এখনও একটা অংশের দর্শক আছেন, যাঁরা এত সহজে ঠকেন না। তাঁরা আজও জাগ্রত, সতর্ক। মাঝেমাঝে ভুলে যাই, এখনও এই শহরে বাস করেন মায়া ঘোষ। সবার চোখের আড়ালে থেকে যেমন সুবাস ছড়ায় নাম-না-জানা ফুল।
নান্দীকার-অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, থিয়েটার ওয়ার্কশপ-বিভাস চক্রবর্তী, থিয়েটার ওয়ার্কশপ-অশোক মুখোপাধ্যায়— এই গুরুত্বপূর্ণ পর্বগুলির মধ্যে বেশ কিছু প্রযোজনায় মায়া ঘোষের অসামান্য অভিনয়ের স্মৃতি আমাদের অনেকের কাছে ইতিহাস। কখনও একটু ঝাপসাও, কারণ যে বয়সে সেগুলি দেখেছিলাম, তখন সবটা মনে রাখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বেলা-অবেলার গল্প আর বেড়া-র স্মৃতি (থিয়েটার ওয়ার্কশপ প্রযোজনা/নির্দেশক অশোক মুখোপাধ্যায়) এখনও সজীব। এই দু’টি নাটকে তাঁর অভিনয় যে মাত্রায় পৌঁছত, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমার কৌতুক বোধ হয় তাঁদের কথা ভেবে, যাঁরা সত্যিকারের উৎকৃষ্ট অভিনয় কী হতে পারে, তার স্বাদটা না বুঝে টেলিভিশনে ধারাবাহিকের অভিনয়টাকেই মাপকাঠি হিসেবে বিচার করেন। মঞ্চে মায়া ঘোষের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা একটা অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। বেলা-অবেলা-য় নিম্ন-মধ্যবিত্ত বামপন্থী আন্দোলনে দীক্ষিত হওয়া অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অভিনয়ের অ-আ শেখা মায়া ঘোষ তো শুধু অভিনয় করতেন না। ওঁর বিশ্বাস, নিরন্তর সর্বগ্রাসী মন, ওঁর অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে সৃষ্টি হত চরিত্রগুলো। তার সঙ্গে যুক্ত হত কঠোর অনুশীলন ও শিল্পবোধের আস্তরণ, যা একটি চরিত্রকে করে তুলত বহুস্তরীয় এবং গভীর। অগস্ট উইলসনের লেখা নাটক ফেন্সেস-এর বঙ্গানুবাদ বেড়া নাটকে মায়া ঘোষ এক জন আফ্রো-আমেরিকান নারী— তাঁর হাঁটাচলা, কথা বলা, স্বরক্ষেপণ, সমস্ত এক তারে বাঁধা। বাংলায় কথা বলা সত্ত্বেও চরিত্রটি যে বাঙালি নয়, ভারতীয়ও নয়, এটা এত স্পষ্ট বোঝা যেত যে, মনে হত, বাংলা নাটক দেখছি তো?
২০২০ সাল অনেক কিছু কেড়ে নিল। কেবল সংখ্যার উপর নির্ভর করে বলতে পারব না, সুসময় এসে গেল। কেবল এটা ভেবে সুখী হতে পারি, এখনও এই শহরে বাস করেন মায়া ঘোষ, চিত্রা সেন, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, ছন্দা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ— শুধুমাত্র থিয়েটারকে ভালবেসে, তার জন্য নানা ভাবে আত্মত্যাগ করে আজও তাঁরা কর্মক্ষম, সজীব, স্বতন্ত্র।
কৌশিক সেন, কলকাতা-৯৯
কী পেয়েছেন?
‘মায়াময়’ সূত্রে কয়েকটি কথা। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় স্কুলের নাটকে প্রথম অভিনয় মায়া ঘোষের, পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে। নান্দীকারের নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র নাটকে কেয়া চক্রবর্তীর পরিবর্ত হিসেবে তাঁর মঞ্চাভিনয় (১৯৬১) প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
থিয়েটার অন্তপ্রাণ এই মানুষটি প্রবল দারিদ্রের মুখোমুখি হয়েও উপার্জনের অন্য কোনও পথের সন্ধান করেননি। অর্থের জন্যে অফিস ক্লাবের নাটকে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি বাংলা মঞ্চে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে অনেক ইতিহাসের সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর অভিনয়সমৃদ্ধ মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, চাক ভাঙা মধু, রাহুমুক্ত, বেলা-অবেলার গল্প, বেড়া, ঘরে ফেরা কিংবা সীতায়ন-এর স্মৃতি এখনও অনেকের মনে ভাস্বর হয়ে আছে।
তবু মনে হয়, এত কিছু করেও বাংলা থিয়েটার থেকে কী পেলেন এই প্রতিভাময়ী? কিছু দিন আগে একটি বাংলা সিরিয়ালে তাঁকে অভিনয় করতে দেখে মনটা বিষাদাক্রান্ত হয়েছিল। একটা অজানা অপরাধবোধও তাড়া করে ফিরেছিল। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের দর্শকেরা বিস্মৃতি ছাড়া কোন উপহার দিয়েছেন তাঁকে! রঙ্গমঞ্চের আলোকবৃত্তের বাইরে এসে হারিয়ে যান তাঁর মতো কত না প্রতিভা! শেষ জীবনে গীতা দে-র মতো অভিনেত্রীকে দেখেছি অর্থের জন্যে মফস্সলের এক ম্লান আয়োজনে অভিনয় করতে। জীবনের উপান্তে রবীন মজুমদার সামান্য একটু কাজের জন্যে এর-ওর শরণাপন্ন হয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একমাত্র সত্যজিৎ রায় তাঁর হীরক রাজার দেশে ছবিতে রবীন মজুমদারকে ছোট্ট একটা সুযোগ দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন জাগে, থিয়েটার এই সব নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীদের কী দেয়? এক সময় কয়েকটি নাট্যদল মিলে ‘নাট্য সংহতি’ সংস্থা গড়ে দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। প্রয়োজনের তুলনায় তা সামান্যই। থিয়েটারের জন্যে যাঁরা তাঁদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন, তাঁদের জন্যে আমাদের কি কোনও দায় নেই? বরেণ্য অভিনেত্রী মায়া ঘোষের ৭৮তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন সংবাদে নিরুত্তর কিছু প্রশ্নের ভিড় এসে জমল মনে। অনুষ্ঠান আয়োজকদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি।
সুশীল সাহা, হৃদয়পুর, উত্তর ২৪ পরগনা
কণ্ঠশিল্পী
সুধীর চক্রবর্তী চলে গেলেন। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, মানুষকে কেমন করে অনুধাবন করতে হয়। বাংলা গান বিষয়ে তাঁর বই ও বক্তৃতা জনাদৃত হয়েছে। যদিও চাপা পড়ে গিয়েছে কণ্ঠশিল্পী সুধীর চক্রবর্তীর কথা। আমার পরম সৌভাগ্য, তাঁর মধ্যবয়সে খালি গলায় গাওয়া প্রায় ৪০টি গানের রেকর্ডিং তিনি আমাকে দিয়ে গিয়েছেন। তা থেকে নির্বাচিত কয়েকটি বাজিয়ে তিনি তাদের সাঙ্গীতিক স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, যার টানে কলকাতা থেকে বহরমপুরে এসেছিলেন শ্রীকান্ত আচার্য ও অর্ণা শীল। সে এক অনির্বচনীয় সন্ধ্যা।
কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।