Reservation

সম্পাদক সমীপেষু: যথেষ্ট সময়?

রাজনৈতিক দলের কথা এখানে উহ্যই থাক। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির মধ্যে তিন জনের পর্যবেক্ষণের পর দরিদ্র উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ চালু করা হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৫৬
Share:

অমলকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, সংরক্ষণের ৭২ বছর পরেও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না (‘সংরক্ষণ হোক আর্থিক ভিত্তিতেই’, ১৬-১১)। সংরক্ষণ সৃষ্টির মূল কারণ ছিল, তথাকথিত নিম্নবর্ণের প্রতি তথাকথিত উচ্চবর্ণের ঘৃণা ও নিপীড়নের প্রতিকার করা। আজ যে নিম্নবর্ণের এক ব্যক্তি উচ্চবর্ণের এক জনের সঙ্গে একই টেবিলে বসে খেতে পারছেন, কখনও বা দুই শ্রেণির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হচ্ছে, অর্থাৎ জাতিভেদের কদর্যতা কিছুটা হলেও কমেছে, এটা কিন্তু সংরক্ষণের জন্যই সম্ভব হয়েছে। বলা যায়, সামাজিক ন্যায় কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাজার হাজার বছরের নিষ্পেষণজনিত স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য এত অল্প সময় (৭২ বছর) মোটেও যথেষ্ট হতে পারে না।

Advertisement

প্রবন্ধকার বলেছেন, অনগ্রসর শ্রেণির কেউ চাকরি পেলে তাঁর পরিবার আদৌ উপকৃত হয় না, কারণ ওই কৃতী সন্তানেরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এটা সম্পূর্ণ পারিবারিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। সংরক্ষণকে এর জন্য কোনও ভাবেই দায়ী করা যায় না। চাষির ছেলে চিরকাল চাষবাস করবেন, ব্রাহ্মণের সন্তান চিরকাল পূজার্চনা করবেন, বৈশ্যপুত্র চিরকাল ব্যবসা করবেন, আর শূদ্রের সন্তান চিরকাল সকলের সেবা করে যাবেন— এমনটাই যদি হয় তবে তো আমরা আবার সেই অন্ধকার যুগে পৌঁছে যাব।

রাজনৈতিক দলের কথা এখানে উহ্যই থাক। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির মধ্যে তিন জনের পর্যবেক্ষণের পর দরিদ্র উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ চালু করা হয়েছে। তাঁদের রায়ের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে বলি, এতে অনগ্রসর শ্রেণির কেউ অখুশি হননি, কারণ পিছিয়ে পড়াদের সামনে এগিয়ে আনতে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আরও এক বার প্রমাণিত হল। বরং উচ্চবর্ণের অনেকেই পশ্চাৎপদ শ্রেণির সংরক্ষণ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে অপর দুই বিচারপতির পর্যবেক্ষণ যে কম তাৎপর্যপূর্ণ, এ কথা বলা যায় না। ভারতের প্রতিটি নাগরিক যে দিন নামের শেষে বর্ণ-ধর্ম সূচক পদবি লেখা বন্ধ করবেন, সে দিনই জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত হবে। কেবলমাত্র তখনই ‘আর্থিক ভিত্তিতে সংরক্ষণ’ ফলপ্রসূ হতে পারে।

Advertisement

অনুপ রায়, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা

আর্থিক ভিত্তি

অমলকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, অনগ্রসর শ্রেণির পরিবারের ছেলে-মেয়েরা সরকারি চাকরি পেলে তাঁরা তাঁদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আমার অভিজ্ঞতা, কোনও কোনও পরিবারের প্রতিটি সদস্যই সরকারি চাকরির সুবিধা পেলেও, অন্য অনেক পরিবারেরই এক জন সদস্যও সরকারি চাকরি পাননি। ভারতে এমন পরিবারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। চাকরি পাওয়ার পরে অনেক তফসিলি ছেলে-মেয়েই তাঁদের পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। পূর্বপুরুষদের পেশা ছেড়েছেন তাঁরা। এমনকি নিজেদের সেই আগের জীবনযাত্রার কথা বলতেও লজ্জা বোধ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা এমন সব পদবি গ্রহণ করেছেন, যা দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁরা কোন বর্ণের। নিজের বংশপরিচয় দিতে তাঁদের এত লজ্জা কেন? এ ভাবে কেবল সংরক্ষণের সুবিধাটুকু নিয়ে মূল জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তফসিলি জাতি ও জনজাতির অবস্থার সার্বিক উন্নতি সম্ভব হবেকী ভাবে?

মোদী সরকার গত লোকসভা নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল উচ্চবর্ণের মানুষদের (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশনস বা ইডব্লিউএস) জন্য সরকারি চাকরি, শিক্ষা ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই অনুযায়ী, সংসদে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ হয়। মোদী সরকারের সেই সিদ্ধান্তে এই বার সিলমোহর দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এখন উচ্চবর্ণের ছেলে-মেয়েরাও দরিদ্র পরিবারের হলে সরকারি চাকরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের সুবিধা পেতে পারবেন। তিন জন বিচারপতি— দীনেশ মাহেশ্বরী, বেলা ত্রিবেদী এবং জে বি পারদিওয়ালা পৃথক ভাবে রায় ঘোষণা করে বলেছেন, ১০ শতাংশ ‘ইডব্লিউএস’ কোটা সংবিধানের মূল কাঠামোর পক্ষে বিপজ্জনক নয়। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে সাম্যের অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হল।

আমাদের দেশের সংবিধান প্রণেতারা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দল সংরক্ষণ নিয়ে এত দিন কেবলমাত্র রাজনীতিই করে এসেছে। তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ভোট পেতে সংবিধানের ধারা বার বার সংশোধন করে সংরক্ষণ অনেক সহজ ও সুবিধাজনক করে তোলা হয়েছে। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বিস্মৃত হয়েছে। এখন সুপ্রিম কোর্টই আমাদের ভরসা।

১৯৯৩ সালের ইন্দ্র সাহনি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল— শুধুমাত্র সামাজিক ভাবে অনগ্রসরদের ক্ষেত্রে ১৬(৪) ধারা প্রযোজ্য হবে। এ বারের সুপ্রিম কোর্টের রায়টিতে রয়েছে— জেনারেল ক্যাটেগরির অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশ। এতে উপকৃত হবেন এমন এক শ্রেণির মানুষ, যাঁদের কথা এত দিন কেউ শোনেননি। তাই এই রায় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। সংরক্ষণ যদি দিতেই হয়, তবে তা আর্থিক ভিত্তিতেই দেওয়া প্রয়োজন।

প্রদ্যুৎ সিংহ, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

যোগ্য-অযোগ্য

সংরক্ষণের অকার্যকারিতা এবং সংরক্ষিত সমাজের ‘ক্রিমি লেয়ার’ সম্পর্কে অমলকুমার মুখোপাধ্যায় যা বলেছেন, তা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু তিনি যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন আছে। কৃষক পরিবারে জমি ভাগাভাগি হওয়ার পর একটা সময় জমি এত ছোট হয়ে যায় যে, সব সন্তানের জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে তাঁদের নিয়ে আসা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ভাবে জাতপাত বজায় রেখে অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণ বিশেষ কোনও তাৎপর্য বহন করে না। ‘ব্রাহ্মণ সন্তান’ এই পরিচয় নিয়ে পরাধীন ভারত থেকে স্বাধীন ভারতের ষাট-সত্তর বছর পর্যন্ত যে সুবিধা সামাজিক ভাবে মিলত বা এখনও মেলে, তা কি তথাকথিত নিম্নবর্গীয়রা পাবেন? মামা-কাকা এবং উচ্চপদস্থ আত্মীয়ের পরিচয়ে ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা যে সুবিধে পান, তা কি কৃষক-শ্রমিকের সন্তান পাবেন? জমিদার শ্রেণি কয়েক শতক ধরে যে সমাজকাঠামো নির্মাণ করেছিল, সেখানে কৃষককে যে নিপীড়িত জীবনে নামানো হয়েছিল, তার কি অবস্থান্তর পুরোপুরি ঘটে গিয়েছে? প্রায় অশিক্ষিত হয়েও পদবির জোরে পূজার্চনার অধিকার ভারতীয় সংস্কৃতিতে সংরক্ষণ নয় কি?

তৃতীয়ত, সংরক্ষণ হয়েছে ‘সাবকাস্ট’ ভিত্তিতে। পদবি অনেকটাই পেশাভিত্তিক আরোপিত বিষয়। সে ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ‘সাবকাস্ট’-এ যে পদবি আছে, তাঁরা কত জন শ্রমিক বা কৃষকের কাজ করেন? চতুর্থত, জনসংখ্যার শতাংশের অনুপাতে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য সব রকম পেশায় জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাতের চাইতে বহু গুণ বেশি প্রতিনিধিত্ব করেন কেন? যদি মনে করা হয় যে যোগ্যতাই তাঁদের নির্বাচনের কারণ, তবে প্রশ্ন— স্বাস্থ্য-শিক্ষা-অর্থনীতি সর্বত্র এত দুর্নীতি কেন? স্বাধীনতার পরে যাঁরা শাসনক্ষমতায় ছিলেন, উচ্চপদস্থ আমলা থেকে চিকিৎসক বা শিক্ষক, সকলেই প্রায় উচ্চবর্ণের। তা হলে আজ দেশের এই অবস্থা কেন?

পরিশেষে, যে দেশে গণেশকে দুধ খাওয়ান উচ্চশিক্ষিত মন্ত্রী, যেখানে মন্দির-মসজিদ-রথ নিয়ে রাজনীতি হয়, বিজ্ঞান, যুক্তিবোধ পিছনে পড়ে থাকে এবং ধর্মীয় আবেগ, গোঁড়ামি, বিদ্বেষ রাজনৈতিক দায়িত্বে ছড়িয়ে যায়, সেখানে যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রাসঙ্গিকতা কি আর থাকে?

স্বপন মণ্ডল, কলকাতা-৯৯

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement