বিভাস চক্রবর্তীর প্রবন্ধ ‘বাঙালিয়ানার নাটককার’ (২৪-১১) সূত্রে কিছু কথা। মনোজ মিত্র নিছক কৌতুকরসের শিল্পী বা নাট্যকার নন, নিষ্ঠুর বাস্তবের বীভৎসতা, প্রতিহিংসাময় জ্বালাময়ী বিষয়কেও প্রাণদান করেছেন। এক সময় তিনি বলেছিলেন, “আমি এই মুহূর্তে একটা বিষয়কেই অধিকার দিয়ে লিখতে চাই, সেটা হল দীন মানুষ দুর্বল মানুষ অবহেলিত এবং পর্যুদস্ত মানুষ তার হীনতা তার দুর্বলতা তার ভয় দ্বিধা সংশয় কাটিয়ে মানুষের মতো উঠে দাঁড়াচ্ছে।” শাণিত ব্যঙ্গ, প্রবল সহৃদয়তা তাঁর নাটককে গভীর শিল্পরূপ দান করেছে। মঞ্চ ও পর্দায় তাঁর অজস্র অভিনয়ও বিস্ময়কর। চাকভাঙা মধু, সাজানো বাগান-এর পাশাপাশি লিখেছিলেন মেষ ও রাক্ষস, নরক গুলজার, নীলকণ্ঠের বিষ-এর মতো মঞ্চসফল নাটকও।
মেষ ও রাক্ষস-এ নাট্য প্রয়োগের রূপকথা ও ফ্যান্টাসির প্রয়োগকলা চমৎকার। নরক গুলজার-এ রঙ্গব্যঙ্গ ও সংলাপের মাধ্যমে তিনি দেবচরিত্রের মোড়কে আধুনিক সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। সংসার পরিত্যক্ত নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ জীবনের অসহায় অন্তরমথিত বেদনার চিত্র অঙ্কিত পরবাস-এ। অলকানন্দার পুত্রকন্যা-র অলকানন্দা মহীয়সী নারীচরিত্র হিসাবে আধুনিক বাংলা নাটকে আজও উজ্জ্বল। দম্পতি-ও উইট নির্ভর হাস্যরসাত্মক মনোজ্ঞ নাটক। গ্রামের মাটি থেকে তুলে আনা সরস ও অকৃত্রিম জীবনচিত্রের অতুলনীয় নজির কিনু কাহারের থেটার। মানবতার গভীর প্রত্যয়ে ঋদ্ধ নৈশভোজ, দেবী সর্পমস্তা, অবসন্ন প্রজাপতি, যা নেই ভারতে প্রভৃতি নাটক। মনোজ মিত্র অনাচার, তঞ্চকতাকে বিদ্ধ করেছিলেন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে, ছড়িয়ে ছিলেন কান্নায় ভেজা কৌতুকের অজস্র ফুলকি। সেই সঙ্গে নাটক ও চলচ্চিত্রাভিনয়ে সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস। সাজানো বাগান-এর বাঞ্ছা, মৃত্যুর চোখে জল-এর বঙ্কিম, শত্রু সিনেমার নিশিকান্ত সাহাকে ভোলা যাবে না কোনও দিন।
সুদেব মাল, তিসা, হুগলি
গঙ্গাদূষণ
সম্পাদকীয় ‘কলুষিত’ (২২-১১) পড়ে জানা গেল ভারতের কেন্দ্রীয় পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার (ভিইসিসি) গঙ্গাদূষণ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেছে। অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন, নমামি গঙ্গে-র মতো একটি প্রকল্প সত্ত্বেও গঙ্গার এমন দুরবস্থা ঘটল কেন। একটি বিজ্ঞান পত্রিকা থেকে জানতে পারছি, গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ৯৭টি বড় শহর থেকে রোজ ২৯৫৩ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য জল গঙ্গার জলে মেশে যার খুব কম অংশই শোধিত হয়। এই বর্জ্য জলের ৭০-৮০% ঘর গেরস্তালি থেকে আসে, বাকিটা কলকারখানাজাত। শহরগুলি থেকে প্রতি দিন কঠিন বর্জ্যের ৬৪৪০ কোটি টনের ৫৫% সরাসরি মিশছে গঙ্গায়। এই নদীর প্রবাহপথে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত পাঁচটি শহর থেকে এক বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক মিশছে গঙ্গায় প্রতি দিন। গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহের দুই পাশে এবং দুই উপনদী কালীগঙ্গা ও রামগঙ্গা নদীর দু’ধারে অত্যন্ত দূষণকারী কলকারখানার সংখ্যা অন্তত ৩০% বেড়েছে। ফলে গঙ্গা অববাহিকার ওই অংশের জলে ভারী ধাতুর পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। ক্যানসার রোগ সৃষ্টিকারী বেশ কিছু উপাদান, আর্সেনিক জলে মিশছে। ২০১৮ সালে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে ইলাহাবাদ, মির্জ়াপুর থেকে গাজ়িপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর থেকে উলুবেড়িয়া অবধি নদীর জল স্নানের অনুপযুক্ত। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পুরো প্রবাহপথেই ব্যাক্টিরিয়ার সংখ্যা অত্যন্ত বেশি যা থেকে বিভিন্ন রকম চর্মরোগ হতে পারে। জলে এই ব্যাক্টিরিয়ার আধিক্য কাঁচা বর্জ্য, মানুষের শরীরজাত ময়লার অত্যধিক উপস্থিতিকেই বোঝায়।
গঙ্গার এই দূষণ আজকের নয়। ১৯৯৭ সাল থেকেই হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমের সাধু-সন্ন্যাসীরা এ নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। উচ্চতর প্রশাসনিক আধিকারিককে চিঠি লেখার পাশাপাশি তাঁরা অনশন, অবস্থানও জারি রেখেছেন। সন্ন্যাসীদের অনশন চলাকালীন মৃত্যু দেশ জুড়ে আলোড়নও ফেলেছিল। যদিও অবস্থার যে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, তা বাস্তব তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। তাই আশঙ্কা জাগে, যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে তা সম্পূর্ণ হবে তো? তবে শুধু গঙ্গার পাড় নয়, গঙ্গার জলও এই প্রকল্পের আওতায় এলে ভাল হত।
প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি
বিপজ্জনক
দিল্লি ডায়েরি (৩-১১) থেকে জানা গেল, এক আইনজীবী এমন একটি এআই ব্যবহার করছেন যা তথ্য খুঁজে দিচ্ছে এবং তার উৎসও জানিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি বিপজ্জনক। কারণ কৃত্রিম মেধা অনেক ক্ষেত্রেই খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এত সুন্দর করে নিজের মতো ভুলভাল তথ্য বানিয়ে দেয় যে, বোঝাও যায় না সেটা ঠিক না ভুল। ব্যবহারকারীকে মূল উৎস থেকে যাচাই করে দেখতে হয়। চ্যাটজিপিটি-তে অ্যাকাউন্ট খুলে বাংলা হরফে ‘রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতাটি লেখো’ লিখলে দেখা যাচ্ছে সুন্দর এবং ঝরঝরে বাংলায় নিজের মতো যা খুশি তাই একটা কিছু লিখে দিয়েছে, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটির কোনও মিল নেই! বার বার জিজ্ঞেস করলে সে বার বারই নতুন কিছু বানিয়ে দেবে, সে নিজেও বুঝবে না যে তা ভুল। এই কারণে বিজ্ঞানের গবেষণায় এআই ব্যবহার করে নতুন তথ্য বার করা এবং গবেষণাপত্র লেখা প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে, কারণ এআই যা বলবে, অনেক সময়ই তা ঠিক না ভুল বোঝার কোনও উপায় থাকে না। কৃত্রিম মেধা তথ্যের উৎসও ভুলভাল কিছু একটা বানিয়ে লিখে দেয়।
যে আইনজীবীরা কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করে তথ্য বার করছেন, তাঁরা সমস্যাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কি না জানা নেই। সুপ্রিম কোর্টের মামলা অনেক মানুষের জীবনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে, সেখানে ঠিকঠাক যাচাই না করে কৃত্রিম মেধা থেকে তথ্য নিয়ে ব্যবহার করলে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
অর্চিষ্মান পাণিগ্রাহী, কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস
নিজেই পণ্য
দীপ্সিতা ধরের ‘বিপদ ওঁদের, আমাদের কী’ (৩০-১১) প্রবন্ধে খাদ্য সরবরাহের কাজে নিযুক্ত মানুষদের প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। বছর দুয়েক আগে অরুণাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যায়। হোটেলের রান্নাঘর বন্ধ। ম্যানেজার বললেন, একটু বেশি অর্থ ব্যয় করলে এবং ঘণ্টাখানেক সময় দিলে পছন্দসই খাবার আনিয়ে দেবেন। শূন্য তাপাঙ্কে, অত রাতে সেটা কী ভাবে সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “আপনাদের খাবার পৌঁছনোর কাজটাই ওঁদের পরিবারের অন্নসংস্থানের উপায়! এত রাত, এত ঠান্ডা, এতটা পথ কোনও বাধা নয়।” অতিরিক্ত অর্থের কতটা সেই খাদ্য সরবরাহকারীর কাছে পৌঁছয়, সেটা কোনও ক্ষেত্রেই হয়তো জানা যায় না। বিজ্ঞাপিত ও পরিচিত বৃত্তের বাইরে অসংগঠিত ক্ষেত্রে এমন অসংখ্য মানুষ এ ধরনের পেশায় যুক্ত আছেন। প্রশ্ন জাগে, এঁদের শারীরিক ও অর্থনৈতিক ভাল-মন্দের দায় নিয়োগকর্তা এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা স্বীকার করেন কি?
একটি প্রশিক্ষণমূলক প্রকল্পে এক বক্তার কথা আজও কানে বাজে। নিজেকে বিক্রি করতে হবে। গিগ অর্থনীতির কর্মীরা সে পথই অবলম্বন করেন। পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কর্মে নিযুক্ত হয়ে, নিজেরাই যেন ‘পণ্য’ হয়ে ওঠেন। ওই মানুষগুলো সম্পর্কে তাঁদের নিয়োগকর্তা কিংবা রাষ্ট্র পরিচালকেরা কী ভাবেন, ভাবলেও তার বাস্তবায়ন কতটা— জানা নেই। উপভোক্তাদের সঙ্গে তো মাঝেমধ্যেই তাঁদের ক্ষণিকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি হয়। আমরা কি পারি না, মানুষগুলোর প্রতি কিছুটা সংবেদনশীল, একটু আন্তরিক এবং আরও একটু মানবিক হয়ে উঠতে?
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা