দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার (‘নির্বাচনই যদি হয় আন্দোলন’, ২৫-১১) প্রসঙ্গে কিছু কথা। দীপঙ্করবাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘একটা একমুখী প্রবাহ’ এ রাজ্যের রাজনীতিতে গড়ে উঠেছে, যার হাত ধরে ‘তৃণমূল সরাও’-এর ডাক, আর এ জন্য বিজেপি ক্রমেই বাড়ছে। এখানে এড়িয়ে যাওয়া হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন, বিজেপি কেন বাড়ছে? বামপন্থী শক্তিও তো বাড়তে পারত, তাই না? যে সমস্ত প্রশ্ন নির্বাচনের বিষয় করে তোলার পক্ষে তিনি সওয়াল করেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় সেগুলি ‘অ্যাজেন্ডা’ হওয়ারই যোগ্য; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব এখন এটাই, এক দিকে তৃণমূল আর অন্য দিকে বিজেপিকে ঘিরেই একুশের নির্বাচন, বামপন্থীরা তৃতীয় স্থানে, বহু দূরে।
নির্বাচনের ফলের উপরেই আজ রাজনৈতিক দলগুলির শক্তি বা দুর্বলতা নির্ধারিত হয়, নির্বাচন তাদের কাছে মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ মানেই তো শত্রু! এ দেশের বামপন্থীদের ‘অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্স’-এ মানুষ বিভ্রান্ত, বিরক্তও। বামপন্থীরা কিন্তু তা বোঝেন না, বুঝতেও চান না। তাই দলের মধ্যে উপদল গিজগিজ করে, দল ভেঙে নতুন দল গড়ে, আবার নির্বাচন এলে এক ছাতার নীচে জড়ো হয়ে নির্বাচন লড়ে। আর সে ছাতায় ডান-বাম মিলেমিশে এক অদ্ভুত রামধনু খিচুড়ি তৈরি হয়! জানতে ইচ্ছে করে, এ ভাবেই কি এ দেশের বামপন্থীরা ‘বিপ্লব’ আনতে চান?
আর একটা কথা। দীপঙ্করবাবু কি সত্যিই বিশ্বাস করেন ‘বাংলায় তৃণমূল কৃষক ও শ্রমিকের কথা বলে’ ক্ষমতায় এসেছিল? এ রাজ্যের মানুষ এমন তত্ত্ব মানবেন? একমাত্র সিপিএম-বিরোধিতা সম্বল করেই তৃণমূল এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল, বামপন্থী শাসনের প্রতি মানুষের সার্বিক বিরক্তিকে কাজে লাগিয়ে— এ কথা বুঝতে বোধ হয় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
বিপ্লব গুহরায়
কান্দি, মুর্শিদাবাদ
একই ব্যাধি
‘বুদ্ধি কি ফিরিবে না’ (সম্পাদকীয়, ২৪-১১) প্রসঙ্গে দু’-চার কথা। বঙ্গীয় বামপন্থীদের অধিকাংশই চান, তৃণমূল কংগ্রেস আগে দূর হোক। রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসে আসুক, তাদের সঙ্গে মোকাবিলা হবে পরে। এই উৎকট ভাবনার কারণ, ৩৪ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সিপিআইএম-কে পরাস্ত করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই যন্ত্রণা আজও বামপন্থীদের ক্ষতবিক্ষত করে। অতএব মমতা যোগ্য প্রশাসক হলেও তাঁর পরাজয় না-দেখা পর্যন্ত বামেদের স্বস্তি নেই। সম্পাদক ঠিকই বলেছেন, “আজ, সঙ্ঘ পরিবারের আগ্রাসনের মুখে দাঁড়াইয়া আবারও সেই একই ব্যাধি প্রকট হইয়া উঠিতেছে।... বামপন্থীরা স্থির করিয়াছেন, দেশের বৃহত্তর এবং গভীরতর বিপদ দেখিবেন না, দেখাইয়া দিলেও দেখিবেন না।” বিস্ময়ের কথা, যে সাম্প্রদায়িক দলটি চির কালই বামেদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে, কার্যত তারা আজ প্রধান প্রতিপক্ষ নয়! ‘কংগ্রেস’ নামক নড়বড়ে ক্রাচে ভর দিয়েই লড়াই চলছে, চলবে!
সবুজ সান্যাল
ধাড়সা, হাওড়া
শত দোষ
কথায় বলে, হতবুদ্ধির শত দোষ। তাই এ রাজ্যের সিপিএম চিরশত্রু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধছে। কংগ্রেস ৩৪ বছর বাম রাজত্বে হাজার হাজার সমর্থক হারিয়েছে। গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, পিংলা, শালবনি, মেদিনীপুরের কবর থেকে তাঁদের কান্নার করুণ সুর শুনতে পেয়েও বধির। যে সিপিএম চির কাল দেওয়ালে ইন্দিরা গাঁধী, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি অথবা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কার্টুন আঁকত, আজ সেই দলই অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে কংগ্রেসের শরণাপন্ন। গ্রামগঞ্জের তৃণমূল স্তরের কংগ্রেস কর্মীরা কি বাম-জমানায় হারানো স্বজনের কথা ভুলে সিপিএম-কে সমর্থন মেনে নেবেন? না কি সিপিএম ক্যাডাররা, যাঁরা কংগ্রেসকে বুর্জোয়া, স্বৈরাচারী, একনায়কতন্ত্ৰী ও পারিবারিক সাম্রাজ্যবাদী দল আখ্যা দিয়ে মিটিং, মিছিল করেছেন, তাঁরা এই আত্মসমর্পণ বেছে নেবেন? তবে এই জোট ভাল ভাবেই জানে যে, ৭ শতাংশ সমর্থন নিয়ে রাজ্য দখল করা যায় না। তাঁদের উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি নয়, তৃণমূলকে রাজ্য থেকে উৎখাত করা। সেই জন্যই এই অশুভ আঁতাঁত তৃণমূলের ভোট ভেঙে বিজেপির সুবিধে করে দিতে চায়।
তপনকুমার বিদ
বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
আত্মরক্ষাই সব?
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজনীতি নির্মাণ করতে হয়’ (১৩-১১) প্রবন্ধটি এক জন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর বৌদ্ধিক বিপর্যয়ের সাক্ষ্য বহন করছে। তাঁর পর্যবেক্ষণ, বিহার নির্বাচনের মাঝপথে নীতীশ কুমার-নরেন্দ্র মোদীরা বিরোধীদের প্রচারের জন্যেই মন্দির-মসজিদ ছেড়ে উন্নয়নকে প্রচারের প্রধান আলম্ব করতে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর কথামতো, অ্যাজেন্ডা বদলেছিলেন। ভাল কথা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে অনির্বাণবাবুর পরামর্শটা ঠিক কী? উল্টোটাই তো। লেখক যেন বাম-কংগ্রেস-তৃণমূলের অশুভ আঁতাঁতকে সচেতন ভাবে আহ্বান করছেন। কালবিলম্ব না করে, এখনই। ‘আগে ওদের এনে এদের তাড়াব, তার পর ওদের তাড়াব’, এতটা দেরিও তিনি করতে চাইছেন না। কিন্তু মোদীকে আমরা পেলাম কোথায়? মোদী তো জাতীয় স্তরে বয়ান ঠিক করেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনটা বিধানসভা ক্ষেত্রের জন্য হচ্ছে জেনেও, শুধুমাত্র বিজেপিকে রুখতে রাজনৈতিক আত্মহত্যার পথ প্রশস্ত করে নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দেওয়াটাকে লেখক সমর্থন করছেন।
রাজনীতি নির্মাণের সম্ভাবনাকে নির্বাচনী সাফল্যের অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন লেখক। সদ্যসমাপ্ত বিহার বিধানসভা নির্বাচনের এই দিকটাকেই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের সামনে প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির মোকাবিলায় এই রাজনীতি নির্মাণের সম্ভাবনার উপরে নির্ভর করছে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব, তথা খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা— এমনটাই অভিমত প্রাবন্ধিকের। এই দেওয়াললিখন পড়তে না-পারাটাকে তিনি আত্মঘাতী নির্বুদ্ধিতা বলছেন। আসলে তিনি দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথারই ইঙ্গিতপূর্ণ প্রতিধ্বনি করতে চেয়েছেন। এক কথায়, বিহার মডেলের অনুলিপি। এই সম্ভাবনার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনীতি সচেতন। তাই প্রথমেই বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট তৈরি হতে পারে। রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক মানচিত্রে ক্ষয়িষ্ণু বাম-কংগ্রেস এর ধাক্কা আর হয়তো কোনও দিনই সামলে উঠতে পারবে না।
আদর্শ আঁকড়ে মানুষ বাঁচে। শুধুমাত্র একটি বিধানসভা নির্বাচনে লড়ার তাগিদে নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া কতখানি সমীচীন? শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার দুর্দশা ঘোচানোর জন্য জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীনতার পর ৬০ বছর সময় পেয়েছিল। এ রাজ্যে বামফ্রন্ট ৩৪ বছর। আজ যদি পুঁজিবাদী শক্তির পরম মিত্র উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আশ্রয়ে ভারতভূমি দখলে উদ্যত হয়, সেই ঐতিহাসিক দায় থেকে কংগ্রেস-বাম অব্যাহতি পেতে পারে কি?
এটা বিধানসভা নির্বাচন। জাতীয় রাজনীতির সংখ্যাগুরুবাদের বিধ্বংসী বিদ্বেষকে পরাভূত করার চেয়ে দলমত নির্বিশেষে রাজ্যের মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। রাজ্যের শাসক দলের অপরিণামদর্শী রাজনীতির শূন্যতা বিজেপিকে সুযোগ করে দিচ্ছে। বিহার নির্বাচনের মাঝপথে বিরোধীদের রণকৌশলের চাপে নাহয় নীতীশ কুমার-নরেন্দ্র মোদীরা নিজেদের অ্যাজেন্ডা বদল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে কী হওয়ার কথা লেখক বলেছেন? সবটাই তো আত্মরক্ষার তাগিদে। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঠিক করাটাই যখন তাদের সমস্যা, তখন জনগণের ভাগ্য এই মুহূর্তে তাদের হাতে কতখানি নিরাপদ?
পার্থ প্রতিম চৌধুরী
কোন্নগর, হুগলি
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।