সিবিআই নব্বই দিনেও চার্জশিট জমা দিতে না পারায় আর জি কর কাণ্ডে তথ্যপ্রমাণ লোপাটে মূল অভিযুক্ত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল জামিন পেয়ে গেলেন। অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়ার সময়েই সিবিআই জানিয়েছিল পরে তারা সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা দেবে। তাতে অন্য সন্দেহভাজনদের তারা যুক্ত করবে। তা হলে সেই চার্জশিট তারা জমা দিল না কেন?
গত অগস্টে আর জি কর কাণ্ডের পরই স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনার যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত দরকার। যারা এই দানবীয় কাজে জড়িত, তাদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়া দরকার। এতে সমাজে আস্থা তৈরি হবে” (আরজি কর: লাল কেল্লা থেকে বার্তা প্রধানমন্ত্রীর, ১৬-৮)। বাস্তবে, সিবিআই-এর এই ভূমিকা সমাজে সত্যিই আস্থা তৈরি করল, না কি ন্যায়বিচার সম্পর্কে, তদন্তকারী সংস্থা সম্পর্কে সমাজ জুড়ে প্রবল অনাস্থা তৈরি করল? আর সেই অনাস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দফতর কি দায়িত্ব এড়াতে পারেন?
২০১৪ সাল থেকে সারদা চিটফান্ড দুর্নীতি-সহ প্রায় ডজনখানেক যে বড় দুর্নীতির মামলার দায়িত্ব সিবিআই নিয়েছে, তার কোনওটিরই তারা ফয়সালা করতে পারেনি। তা কি এই জন্য যে, এগুলির সব ক’টিতেই কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলগুলির নানা স্তরের নেতারা জড়িত? এ বারও সিবিআই-এর সঞ্জয় রায়কেই দোষী সাব্যস্ত করে কার্যত পুলিশের রিপোর্টটিতেই স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া এবং চার্জশিট জমা না দেওয়ার ঘটনায় একই অভিযোগ উঠছে যে, সিবিআই রাজনৈতিক নির্দেশে হাত গুটিয়ে থাকল। আর জি করের চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনাটি কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। এর নৃশংসতা যেমন মানুষকে স্তম্ভিত করেছে, তেমনই এর পিছনে যে বিরাট দুর্নীতি-চক্র এবং হুমকি প্রথা কাজ করেছে, সকলের কাছেই আজ তা স্পষ্ট। তাই তদন্ত সঠিক পথে এগোলে এই বিরাট চক্রটি প্রকাশ্যে এসে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন রাজ্য সরকারের, তেমনই এই ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে যে নজিরবিহীন আন্দোলন দেশ জুড়ে গড়ে উঠেছে তা যদি সফল হয়, দাবি আদায় করতে পারে, তার দেশজোড়া বিরাট প্রভাব পড়বে। কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারের আশঙ্কা এখানেই। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে আজ মহিলাদের ধর্ষণ-খুন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ রাজ্যে আর জি কর আন্দোলন যদি অভয়ার ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়, তবে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেও আন্দোলন শুরু হবে এবং শাসক হিসাবে বিজেপি বিপদে পড়বে। তাই কি সিবিআই হাত গুটিয়ে থাকল?
ইন্দ্র মিত্র, কলকাতা-৩১
খাঁচার তোতা
আর জি করের চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের পর সারা দেশ যখন ন্যায়বিচারের জন্য সিবিআই-এর দিকে চেয়ে আছে, তখন এই কি তাদের ভূমিকা! অভিযুক্তদের গ্রেফতারের তিন মাসেও চার্জশিটটুকু দিতে পারল না? এ কি তাদের শুধুই অপদার্থতা, না কি এর পিছনে অন্য কোনও গুরুতর কারণ রয়েছে? অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে আমার মতো সরব অসংখ্য মানুষকে এই প্রশ্নই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ প্রথম থেকেই সিবিআই বলে আসছিল যে, তদন্ত ঠিক পথেই চলছে এবং তারা যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে চলেছে। সুপ্রিম কোর্টও প্রতিটি শুনানিতে বলেছিল, তদন্ত সঠিক পথেই চলছে। সিবিআই-এর এই কর্মপদ্ধতি অভয়ার ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করা লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগ এবং প্রত্যাশাকে গভীর ভাবে আঘাত করেছে। জামিনের সংবাদ প্রচার হতেই আর জি করের আন্দোলনরত চিকিৎসক, ছাত্র এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁদের তীব্র ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। পরের দিন সিবিআই দফতরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বিভিন্ন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠন।
তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পরে সিবিআই নিজেই তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ জানিয়েছিল এবং প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হলেও পরে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সন্দীপ ঘোষ এবং অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করে তারা। সিবিআই-এর কাছে এর প্রমাণ না থাকলে কিসের ভিত্তিতে গ্রেফতার করেছিল তারা? সমস্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল কী ভাবে চিকিৎসক-ছাত্রীর মৃত্যুর দিন সকাল থেকে প্রথমে সেটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা এবং তার পর সারা দিন ধরে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার কাজে গোটা হাসপাতাল-প্রশাসন যুক্ত হয়ে পড়েছিল, নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে ময়নাতদন্ত হয়েছিল। লোপাট হওয়া তথ্যপ্রমাণ উদ্ধার করতে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির সাহায্য নিতে হয়েছিল সিবিআইকে। এই গোটা কাজটি করা হয়েছিল নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক। অভিযোগ ছিল, এই গোটা কর্মকাণ্ডের পিছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন আর জি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার ওসি। এ ছাড়াও তদন্তে সিবিআই বহু জনকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং জানায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটে এবং খুন-ধর্ষণে জড়িত থাকার অনেক প্রমাণ তারা জোগাড় করতে পেরেছে। তা হলে তো তাদের চার্জশিট জমা দিতে না পারার কথা নয়। জনমনে সন্দেহ জেগেছে যে, অভিযুক্ত দু’জনকে জামিন করিয়ে দিতে সিবিআই ইচ্ছাকৃত ভাবে চার্জশিট জমা দিল না। অতীতে অনেক মামলাতেই সিবিআইয়ের ভূমিকা দেখে বিচারকরা পর্যন্ত তাদের ‘খাঁচার তোতা’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এ বারও কি সিবিআই তার আচরণের দ্বারা সেটাই প্রমাণ করল?
সমুদ্র গুপ্ত, কলকাতা-৬
শুধুই হতাশা
আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বা অন্যান্য অভিযুক্ত সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি নির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে চার্জশিট পেশ করেছে। সরকারের কাজ করতে গিয়ে কোনও সরকারি কর্মচারী যদি দুর্নীতিতে জড়ায় যেমন— ঘুষ নেওয়া, ঠিকাদার নিয়োগ ইত্যাদি নিয়মবহির্ভূত ভাবে করা বা বেআইনি পথে অর্থ উপার্জন, তা হলে তাকে দুর্নীতি নিরোধক আইন, ১৯৮৮-র আওতায় পড়তে হবে। কিন্তু এই ধরনের অভিযুক্তদের জন্য আইনে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা আছে। সাবেক ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ও বর্তমানের ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ২০২৩-এর ২১৮ ধারায় সেই অধিকার দেওয়া আছে। উদ্দেশ্য, সরকারি কর্মচারীদের মিথ্যা ও বাজে মামলা থেকে সুরক্ষা প্রদান। তাই কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আগে একটা অনুমোদন আবশ্যক। সন্দীপ ঘোষের মামলায় রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেয়নি। সেই জন্য আদালত চার্জশিট গ্রহণ করতে পারছে না, বিচার থমকে গেছে। ২০১৬ সালের বৈজনাথ বনাম মধ্যপ্রদেশ সরকার মামলায় শীর্ষ আদালত জানায়, সরকারি কর্মী যদি সরকারের কাজ করতে গিয়ে বেআইনি কাজে নিজেকে যুক্ত করেন, সে ক্ষেত্রে অনুমোদন অপরিহার্য। অনুমোদন দেন নিয়োগকর্তা অথবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার অধিকার যাঁর আছে। লালুপ্রসাদ যাদবের (২০১৩) মামলায় শীর্ষ আদালত বলেছিল যে, আদালত মামলাটি নজরে নেওয়ার সময়ে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি আর সরকারি কর্মচারী না থাকেন, তা হলে অনুমোদন ছাড়াই আদালত বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। অপর এক মামলায় শীর্ষ আদালত বলেছিল, অনুমোদনের ব্যাপারে দেরি করা ঠিক নয়। তিন মাসের মধ্যে অনুমোদন বা বিরূপ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কিন্তু রাজ্য সরকার অনুমোদনে অস্বাভাবিক বিলম্ব করলে উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ প্রার্থনা করা যায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কী করবে বোঝা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছেন।
অসীমেশ গোস্বামী, শ্রীরামপুর, হুগলি