রাজ্যে এমন অনেক কলেজ আছে যেখানে অস্থায়ী শিক্ষকদের দিয়েই কলেজ চলে। সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে তাঁদের সপ্তাহে মোট ১৫ ঘণ্টা কাজ করার কথা। কিন্তু কলেজের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা তা মানেন না। বহু কলেজ কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন, এবং দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা করে ক্লাস নিতে বাধ্য করেন। এই অস্থায়ী শিক্ষকেরা (স্টেট এডেড) পরীক্ষার খাতা দেখা বা ইন্টার্নাল প্রশ্ন করার যোগ্য বলে বিবেচিত হন না। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত শিক্ষকের নামেই সমস্ত পেপার মূল্যায়ন করার চিঠি পাঠায়। নিয়ম না থাকলেও, জেনারেল ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস এঁদের দিয়ে করানোর চেষ্টা করা হয় অনেক কলেজেই।
অস্থায়ী শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নিতে পারেন, কিন্তু তার জন্য ছুটি নিলে ডিগ্রির সার্টিফিকেট জমা না দেওয়া পর্যন্ত মাইনে বন্ধ থাকবে। যেটা স্থায়ী শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অস্থায়ী শিক্ষকরা মা হবেন, সন্তান মানুষ করবেন, কিন্তু ছুটি পাবেন না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন ইচ্ছেমতো সমকাজ বেঁধে দিচ্ছেন, তখন সমবেতনের দাবি নিয়ে অস্থায়ী শিক্ষকরা রাস্তায় আন্দোলনে নামলে দোষ কোথায়? আরও দেখা যায়, অধ্যক্ষ বা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক স্থায়ী শিক্ষকদের অনিয়ম সহজে মেনে নেন, কিন্তু অস্থায়ী শিক্ষকদের কাজের সময় একটুও কম হল কি না, তা নিয়ে চোখ রাঙিয়ে বসে আছেন। প্রশ্ন হল, অস্থায়ী শিক্ষকরা কার নীতি মানবেন? সরকারের নির্দেশ, না কি কলেজের চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম?
রূপশ্রী ঘোষ, কলকাতা-১০৩
চূর্ণীর দশা
বহু স্মৃতিবিজড়িত নদিয়া জেলার চূর্ণী নদী আজ সংস্কারের অভাবে নোংরা আবর্জনায় পূর্ণ সরু খালে পরিণত। কিন্তু আজ থেকে আনুমানিক চল্লিশ বছর আগেও চূর্ণী নদীর জল স্বচ্ছ ছিল। নদীর বালির পাড়ে স্বচ্ছ জলে আঁশবেলে, বাটা, ছোট চিংড়ি, পুঁটিমাছ দেখা যেত। নদীতে গুণটানা বড় নৌকা চলত। কিন্তু আজ সবটাই অতীত। কেন এই রকম হল, সেটা বলার আগে চূর্ণীর ইতিবৃত্ত জানা দরকার।
চূর্ণী আগাগোড়া নদিয়ারই নদী। উত্তরে করিমপুরের হোগলবেড়িয়ার পদ্মার শাখা থেকে উৎপত্তি মাথাভাঙা নদীর; সেখান থেকে মুরুটিয়া পেরিয়ে শেখপাড়া হয়ে তা চলে গিয়েছে বাংলাদেশে। সেখান থেকে মাথাভাঙার প্রবাহ কিছু পথ পেরিয়ে কৃষ্ণগঞ্জ হয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে। সীমান্ত থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে গোবিন্দপুর হয়ে পাবাখালিতে এসে মাথাভাঙা দু’ভাগে পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমের শাখাটি চূর্ণী নদী নামে প্রবাহ শুরু করে। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বয়ে যাওয়া চূর্ণীর বেশির ভাগ অংশই রয়েছে ভারতের সীমানায়। এক সময় চূর্ণী নদী ছিল পরিবহণের অন্যতম মাধ্যম। বড় বড় নৌকাতে মালপত্র পরিবহণে বহু মানুষের জীবন চলত। রুই, কাতলা, বোয়াল, গলদা চিংড়ি, সুস্বাদু কালবোস মাছ পাওয়া যেত নদীতে; মাছ ধরে কয়েক হাজার মানুষের জীবিকা নির্বাহ হত।
নদীর গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ছিল সুদি-কচ্ছপ ও কালো ডলফিন। জাল ফেললেই মাছের সঙ্গে পাওয়া যেত একগাদা গেঁড়ি-গুগলি। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যেত নদীর দু’ধারের গাছগুলোতে। কিন্তু এখন আর কিছু পাওয়া যায় না। পরিবেশকর্মীদের মতে, পুরো জীববৈচিত্রই উধাও হয়ে গিয়েছে নদী থেকে। কারণ, বাংলাদেশের দর্শনাতে চিনি ও মদের কারখানার অপরিশোধিত দূষিত বর্জ্য, রানাঘাট শহরের একাধিক অঞ্চলের বর্জ্য সরাসরি চূর্ণীর জলে মেশে। এর ফলে নদীর জল বিষাক্ত হয়ে, কালো বর্ণ ধারণ করছে। বিষাক্ত জলে মাছের মড়ক দেখা দিয়ে বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে। নদীতে স্নান করলে চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে। নদীর দু’ধারের গাছগাছালি উধাও হয়ে সেখানে দখলদারির কলোনি গড়ে উঠেছে। তা হলে কি চূর্ণী বাঁচবে না? এ ভাবেই এক দিন হারিয়ে যাবে মানচিত্র থেকে! রাজ্য সরকার একটু বিবেচনা করুক, যাতে চূর্ণী নদীকে বাঁচানো যায়।
দেবাশ্রিত রায়, রানাঘাট, নদিয়া
বামেদের ভুল
‘ভরাডুবির পরে’ (২৬-৬) সম্পাদকীয়টির সমর্থনে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। সম্পাদকীয়তে যথার্থই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সর্বহারাদের দল থেকে সর্বহারা মানুষেরা কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন? লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আইনসভায় বামেদের সামান্য হলেও শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে। এটা শুভ লক্ষণ, সন্দেহ নেই। ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজন, একনায়ক রাজনীতির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের বিকল্প নেই। এখনও পর্যন্ত তাঁদের শক্ত ঘাঁটি কেরল। কয়েক বছর আগে ছিল ত্রিপুরা, তারও আগে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। অথচ, বাংলা ও ত্রিপুরায় বামপন্থীরা শূন্য। বামশাসিত কেরলেরও অবস্থা খুব ভাল নয়। এমন দুরবস্থা কেন? বামেদের বাঁধাধরা গতের সমীক্ষা— “সাংগঠনিক ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে হবে”, “আমাদের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছতে পারিনি,” ইত্যাদি। এ সব আসলে অহঙ্কারী চরিত্রের অভিব্যক্তি।
নরেন্দ্র মোদীর দশ বছরের শাসনে দেশের মেহনতি মানুষের চরম দুর্দশা ঘটেছে। তা হলে তো বামপন্থীদের উত্থান হওয়ারই কথা! কিন্তু কেন হল না? যারা বামেদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে, তাদের সহ্য করতে পারছে না বামেরা। ক্ষমতাচ্যুত-করা দলকে ‘প্রতিপক্ষ’ মনে করছে, তাদের সমর্থকদের সম্মান করতে পারছেন না নেতারা। পশ্চিমবঙ্গে সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল আগের তুলনায় অনেক ভাল ফল করেছে। বিজেপির ফল খারাপ হয়েছে। অথচ, বাম-কংগ্রেসের জোটের ফল ভাল তো হয়ইনি, বরং খারাপ হয়েছে। বামেরা সেই শূন্যতেই থেমে, কংগ্রেস দুই থেকে কমে একটাতে ঠেকে গেল। তৃণমূলকে কটাক্ষ করতে গিয়ে বাংলার ভোটারদেরই আক্রমণ করছেন বামপন্থীরা। তাঁদের বক্তব্য, বাংলার মানুষ ‘ভিক্ষায় তুষ্ট’। এই বক্তব্য কতটা মারাত্মক, তা কি বুঝতে পারছেন বামপন্থীরা? যাঁদের ভিখারি বলবেন, তাঁদের থেকে ভোট আশা করবেন, এটা কি হয়?
রেশন, চাকরি, আবাস, একশো দিনের কাজ প্রভৃতি প্রকল্পে দুর্নীতির কথা তুলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে বামেরা, কিন্তু সেগুলো মানুষ গ্রহণ করেননি। বামপন্থীদের উচিত ছিল একশো দিনের কাজের টাকা বন্ধের কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। তা হয়নি। হয়তো মনে করেছেন, কেন্দ্রের টাকা না পাওয়ার রোষ তৃণমূল সরকারের উপর পড়বে। ‘মজা দেখতে থাকা’ বামপন্থীদের মজা দেখালেন জনগণই।
যদি বামপন্থীরা বিজেপির সুরে সুর না মিলিয়ে তাঁদের নিজস্ব ঢঙে মেহনতি মানুষের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারতেন, তা হলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। উচিত ছিল কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার পাশাপাশি রাজ্যের দুর্নীতির বিরুদ্ধেও আন্দোলন করা।
এ বার আসছি বামশাসিত কেরলে। ২০১৯-এ কেরলে বামপন্থীরা একটিমাত্র আসন পেয়েছিলেন। সে বছর বামপন্থী ও কংগ্রেসের মধ্যে কোনও জোট ছিল না। ২০২৪ নির্বাচনে বামপন্থীরা ইন্ডিয়া মঞ্চে থাকলেও বামশাসিত রাজ্যে তাঁরা জোট করেননি। এমনকি রাহুল গান্ধীর আসন ওয়েনাড়েও প্রার্থী দেয়। বামপন্থীদের এই যে ইন্ডিয়া জোটে থাকা অথচ রাজ্যে রাজ্যে জোটের ক্ষেত্রে ভিন্ন পথে চলা, এটাও তাঁদের বিপদের কারণ মনে হচ্ছে। যদিও কেরলে বামপন্থীরা আগের বারের তুলনায় একটি আসন বেশি পেয়েছেন। তবে মনে হয় এটা ইন্ডিয়া মঞ্চে থাকার কারণে তাঁদের উপহার দিয়েছেন কেরলের মানুষ, বিজেপিকে হারাতে। কেন বামেদের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে তাদের দুর্দশা, সেটা নিয়ে আত্মসমীক্ষার দরকার। কারণ ভারতীয় আইনসভায় বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রত্যাশা করে ভারতের জনগণ।
মুহাম্মাদ আবদুল মোমেন, পোলেরহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনা