সুবোধ সরকারের লেখা ‘সংখ্যালঘু শান্তি পাক’ (২০-১২) প্রবন্ধ বিষয়ে দু’-একটি কথা। লেখক বাংলাদেশ বিষয়ে অনেকগুলি ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন এবং আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে জানিয়েছেন গান্ধীজির মৃত্যু হয় না, মুজিবুর রহমানের স্বপ্নও শেষ হয় না। তবে আজ বাংলাদেশে যা চলছে তাকে শুধু সংখ্যালঘু বা হিন্দু-মুসলিম সংঘাত বলে দাগিয়ে দিলে পুরো বিষয়টা বোঝা যায় না। আসলে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই একটা চাপা প্রতিশোধ স্পৃহা একতরফা ভাবে তৈরি হয়েছে। এই আবহাওয়া তৈরির জন্য একক ভাবে সে সময় পাকিস্তানকেই দায়ী করা হয়, যা সত্য এবং বারে বারে প্রমাণিত। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ায় সেই ঈর্ষারই শরিক হয়ে গেল দু’টি দেশ। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ।
আজ বাংলাদেশ সরকার এবং ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যতই অস্বীকার করুক, বাংলাদেশ সৃষ্টির মূলে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর সরকারের ঋণ কেউই কোনও দিন মুছতে পারবে না। আমাদের দেশের চার দিকে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি রয়েছে তারা নানা ভাবেই ভারত সরকারের সহায়তার উপর অবলম্বন করে, ভারতকে ছাড়া তাদের চলে না। চিনের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে বন্ধুত্ব দেখানোর উদ্দেশ্য জানা। এই সব দেশে চিনের জমিদখল এবং দাদাগিরি দেখানো— এই মনোভাব কিন্তু ভারত সরকার কখনওই দেখায়নি। বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির, দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙা হলেও এখনও পর্যন্ত এখানে তেমন কেউ পাল্টা প্রতিক্রিয়াও দেননি। কেউ প্রতিশোধ নিতেও যাননি। লেখক কিছু উদাহরণ দিয়ে ভারতের জনগণের ঔদার্যের কথা বলেছেন। কিন্তু ঈর্ষার বিষয়টি উনি উল্লেখ করেননি। সত্যি বলতে কী, ভারতের অস্ত্রশক্তি, খাদ্যশক্তি, শিক্ষাশক্তি, এবং ধৈর্যশক্তি এই প্রতিবেশীদের ঈর্ষার বিষয়। তাতে ভারতীয় জনগণের ঔদার্য, পরকে আপন করে নেওয়ার মহানুভবতা টোল খায়নি। তবে, কোথাও যেন এই সহনশীলতার জন্য নিজেদেরই বড় অসহায়, পীড়িত মনে হয়।
শ্যামলজিৎ সাহা, চুঁচুড়া, হুগলি
ভাষা না ধর্ম
সুবোধ সরকারের ‘সংখ্যালঘু শান্তি পাক’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ইতিহাস বলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির ভিত্তিতে। তা-ই যদি হয় তা হলে বাংলাদেশে বাংলাভাষী নাগরিকের একাংশ কী করে সংখ্যালঘু বনে গেলেন, তা বোঝা দুষ্কর। তাই প্রবন্ধের শিরোনামটি কিছুটা অবাক করে।
বাঙালিদেরই একাংশ নাকি সংখ্যাগুরু এবং অন্য অংশ সংখ্যালঘু। অর্থাৎ, সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু নির্ধারণে ভাষা-পরিচয় শেষ পর্যন্ত নির্ণায়ক হতে পারল না। ধর্ম-পরিচয়ই মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। অথচ মুক্তিযোদ্ধারা যে খান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিলেন, সেই খান সেনাদের ধর্ম কী, তা তখন তাঁদের বিবেচ্য ছিল না। ভাষাসৈনিকরাও পাকিস্তানি শাসকের অন্যায় ফতোয়ার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি হিসাবে লড়েছিলেন। কারণ তাঁরা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আবেগসম্পন্ন, শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি পেয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি, যা বাঙালির আত্মপরিচয়ের দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। যার সলতে পাকিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালির মুখে ধ্বনিত হয়েছিল “আমার ভাষা তোমার ভাষা বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা।” তাই মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পাওয়ার দিনটি এ-পার বাংলার বাঙালিরাও গর্বের দিন হিসাবেই দেখে থাকেন।
তা হলে আজ কেন বাংলাভাষী নাগরিকেরই একাংশকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে? বাংলা ভাষার টান কি আর বাঙালিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারছে না? কুমিল্লায় প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে যে ভাবে সর্বসমক্ষে হেনস্থা করা হল তাতে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে এল। শেখ হাসিনা-পরবর্তী নব্য বাংলাদেশ কি ‘ইউ টার্ন’ নিয়ে একাত্তরের আগের অবস্থায় ফেরত যেতে চাইছে, না কি সবই হাসিনা-শাসনে ক্ষমতার আতিশয্যের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ? ভয় হয়, ইতিহাস নতুন করে লিখতে গিয়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-র পাতাটি না খোয়া যায়।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
নেহরু-মডেল
‘কুলোর বাতাস’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধের (১৯-১২) পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ভাবী ভারতের রূপরেখা নিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর পত্রালাপে নেহরু গান্ধীকে সক্রেটিস ও নিজেকে তাঁর শ্রদ্ধাবনত শিষ্য আলকিবিয়াদিসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। “তাই সক্রেটিস জানতে চাইলেন, কোন মূল্যবোধের উপর স্বাধীন ভারতের প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হবে? উত্তরে শিষ্য বলছেন, আপনার ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর আদর্শ সম্পূর্ণ অবাস্তব, বহু বছর আগেই মনে হয়েছে। গত বিশ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে তাতে মধ্যযুগীয় রামরাজ্যে বিশ্বাস আঁকড়ে থাকার অর্থ জনগণকে বঞ্চিত করা। খাদি ও কুটির শিল্পের সম্প্রসারণে সমাধান হবে না। গড়ে তুলতে হবে নয়া যুগের নয়া মন্দির— বিশাল ইস্পাত কারখানা, সার কারখানা, জলাধার, বিদ্যুৎ প্রকল্প।”
কোটি কোটি ভারতবাসীর দারিদ্র মোচনে নেহরুকে পরিকল্পিত অর্থনীতির ধারণা জুগিয়েছিল রাশিয়া। নিরাশ গান্ধী এক সময় কংগ্রেস সংগঠন ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন এক অংশ সরকারে যোগ দিক এবং অন্য অংশ সমবায়ী পদ্ধতিতে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়নের কাজ করে চলুক। এক পত্রে নেহরু মাউন্টব্যাটেনকে লিখেছেন, প্রায় প্রত্যেক হিন্দু পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করতে চাইছে কারণ সেখানে কোনও নিরাপত্তা নেই। ১৯৫১-র শেষে নেহরু বেশি চিন্তিত উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ও হায়দরাবাদের মুসলমানদের দেশত্যাগ নিয়ে। মুসলিমদের নিরাপত্তাবোধের অভাব তিনি বুঝেছিলেন। কিন্তু ভুক্তভোগীদের এতটা ঔদার্য দেখানো সম্ভব ছিল না। সেই সময় থেকেই জনসঙ্ঘের ভিত্তি শক্ত হতে লাগল।
এক কালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সাধারণতন্ত্রের ভিত্তি মনে করতেন গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ। গণপরিষদ এবং নির্বাচনী বক্তৃতা সব জায়গাতেই নেহরুর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল হিন্দু মহাসভা ও জনসঙ্ঘ। বিচারপতি দুর্গাপদ বসুর মতে, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা উভয় শব্দই অস্পষ্ট। এক রায়ে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, “এ সমাজতন্ত্রের অর্থ মার্ক্সবাদ আর গান্ধীবাদের একটা সংমিশ্রণ, তবে গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্রের দিকেই ঝোঁক বেশি।” অর্থাৎ এক সময় সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যেই নেহরুর সমাজতান্ত্রিকতা বিষয়টি খোলসা হয়। দুর্গাপদ বসু ভারতের সংবিধান পরিচয় গ্রন্থে লিখেছেন, আমাদের সংবিধান জোড় দেওয়া সংবিধান হলেও সুন্দর করে জোড় দেওয়া সংবিধান। জোড় দেওয়া সংবিধানে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দগুলি অস্পষ্ট হলেও দেশে সম্প্রদায়ভিত্তিক এক উদার আবহাওয়া ছিল। রাজাগোপালাচারী পঞ্চাশের দশকে এক রক্ষণশীল, ধনতান্ত্রিক দল গঠন করেন— স্বতন্ত্র। হিন্দু মহাসভা টিমটিম করছিল, শ্যামাপ্রসাদের জনসঙ্ঘ প্রথম থেকেই হিন্দুদের দল বলে চিহ্নিত ছিল। জাতীয় প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হলে তা কিন্তু উগ্র সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করতে পারত।
তথাকথিত ‘নেহরু মডেল’ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ১৯৩৭-এর নির্বাচন থেকেই অস্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। ভারতকে যাঁরা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্নে মশগুল তাঁরা ভুলত্রুটির ‘নেহরু মডেল’ শুধরে দেশকে ‘জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’-এ বসাতে বদ্ধপরিকর। ধর্মে-ধর্মে লড়িয়ে দিয়ে দেশের শাসনক্ষমতায় বসার এবং থেকে যাওয়ার প্রতিযোগিতা সর্বত্র।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া