অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ‘ঘুরে দাঁড়ানোর দিন’ (২৫-৯) পড়ে প্রত্যাশিত আলোর সন্ধান পেলাম না, তাই একটু হতাশ হলাম। স্বল্প পরিসরে বহু বিষয়ের অবতারণা করার পরে প্রবন্ধকার সিদ্ধান্তে এলেন, “প্রকৃত উন্নতির জন্য প্রয়োজন মৌলিক মূল্যবোধগুলির প্রতি অবিচলিত আস্থা।” তাঁর মতে, মৌলিক মূল্যবোধ মানে সততা, সহানুভূতি, অন্য মানুষের প্রতি ভালবাসা। এ জাতীয় পরামর্শ বা উপদেশ আমাদের দেশের মহাত্মারা কম দেননি। উপরন্তু তাঁদের জীবনচর্যার মাধ্যমে অনেকে এগুলোর যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এ কারণে তাঁদের আমরা ভক্তি করি, তাঁদের ছবি বাড়িতে টাঙিয়ে রাখি। কিন্তু এই গভীর সামাজিক সমস্যা সমাধানের কোনও বাস্তব রাস্তা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে কি? কোনও বিশেষ রাজনৈতিক নেতার সদিচ্ছা দিয়েও কি এই ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব? আমাদের পরাধীন দেশে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আসমুদ্রহিমাচল আন্দোলিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ তাঁকে ‘গান্ধী মহারাজ’ বলে গ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন উদীয়মান শিল্পপতি জি ডি বিড়লা ছিলেন তাঁর পরম ভক্ত।
সম্ভবত এই শেষোক্তদের উদ্দেশ্যে গান্ধী ‘অছিবাদ’-কে জনমানসে তুলে ধরেছিলেন। সংসারে দু’টি ভাই, বড় শিল্পপতি ধনকুবের, আর ছোট হতদরিদ্র। তাই বড় ভাইয়ের দায়িত্ব ছোট ভাইকে দেখা এবং নিজেকে তার নিজস্ব সম্পদের অছি বলে মনে করা। সে সময়ে এর স্বপক্ষে কী সমর্থন গান্ধীজি পেয়েছিলেন, তার সাক্ষী ইতিহাস দেবে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ‘অমৃত মহোৎসব’কালে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্যের ছবি কারও অজানা নয়। আজ শিল্পপতিদের মুঠোর মধ্যে আবদ্ধ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাণভ্রমরা। এমতাবস্থায় কে কাকে মৌলিক মূল্যবোধ সম্পর্কে যথার্থ সচেতন করার অধিকারী, কৌশিকবাবু তা উল্লেখ করেননি।
প্রসঙ্গত তিনি সাম্প্রতিক কালের অনেক গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ফরাসি বিপ্লব এবং রুশ বিপ্লবের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। রুশ বিপ্লবের পরিণতি ‘সাঙাততন্ত্রে’ পর্যবসিত হয়েছে, এ ভাবে বললে ইতিহাসের যথাযথ বিচার করা হয় কি? দু’টি মহান বিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে দিকনির্ণয়কারী হিসাবে বিশিষ্ট স্থান দখল করবে। এ সত্য অস্বীকার করার অর্থ ইতিহাসকে অস্বীকার করা। এ কথা কে না জানে যে, অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের সামন্ততান্ত্রিক পরিমণ্ডলে ধূমায়িত হচ্ছিল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আকুতি। তারই বিস্ফোরণ ফরাসি বিপ্লব। আবার নতুন পরিবেশে, নতুন শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরে জন্ম নিতে থাকল নতুন ধরনের শোষণ, যন্ত্রণা। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল রুশ বিপ্লবে, যার প্রশংসা শোনা গেল রবীন্দ্রনাথ, জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য মানুষের কথায়। তাই এই মহান বিপ্লবগুলি সম্পর্কে অশ্রদ্ধা পোষণ করে আর জি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রকৃত মূল্যায়ন করা কি সম্ভব? প্রতিটি আন্দোলনের নিজ নিজ প্রেক্ষাপট আছে। তা নজরে রেখে এ দেশে সামাজিক পটপরিবর্তনের সম্পর্কে বিদগ্ধজনরা আলোকপাত করবেন, এটাই বাঞ্ছনীয়।
তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-৯
জাগ্রত বিবেক
কৌশিক বসুর প্রবন্ধের আলোচনায় উঠে এসেছে বিশেষ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ প্রেক্ষিত, সে ফরাসি বিপ্লব হোক বা রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লব। সারা বিশ্বের ঘটনা থেকে রাজনৈতিক নেতাদেরও শেখার অনেক কিছুই আছে, সে বিষয়েও প্রবন্ধকার আলোকপাত করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাস থেকে শেখার, ক্ষমতা কী ভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিপথে চালিত করতে পারে। কাকে বলে উন্নয়ন, সেটা ভেবে দেখা দরকার। সেই সঙ্গে প্রকৃত উন্নতির জন্য প্রয়োজন মৌলিক মূল্যবোধগুলির প্রতি অবিচলিত আস্থা। প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, মৌলিক মূল্যবোধ মানে সততা, সহানুভূতি এবং অন্য মানুষের প্রতি ভালবাসার বোধ।
আর জি করের তরুণী চিকিৎসকের নির্যাতন ও হত্যা দেখিয়ে দিল, সমাজের সর্বাঙ্গে ঘুণ ধরেছে। নৃশংস হত্যা যারা করেছে এবং যারা প্রশ্রয় দিচ্ছে বা প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছে, দেশের জনগণ কোনও দিন তাদের ক্ষমা করবে না। বিবেককে জাগ্রত করে ঘুরে দাঁড়ানোর দিন শুরু হোক।
সোমা বিশ্বাস, কলকাতা-৭৬
দিনবদল
এক জন ভাল শাসক কী ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন, আবার স্বৈরাচারী শাসক কী ভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, উদাহরণ দিয়ে তা বোঝাতে চেয়েছেন কৌশিক বসু। তিনি উল্লেখ করেছেন, ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে এমন অনেক নেতার উদাহরণ রয়েছে, যাঁরা ভাল শাসক থেকে ক্রমশ খারাপ শাসকে পরিণত হয়েছেন, এবং তার উল্টোটাও ঘটেছে। তিনি ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণাকারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উল্লেখ করেছেন। সম্প্রতি-প্রাক্তন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাও বলেছেন। কিন্তু যে রাজ্যের ঘটনা দিয়ে তাঁর প্রবন্ধ শুরু করেছেন, তার অবস্থার কথা উল্লেখ করেননি।
কৌশিকবাবু তাঁর প্রবন্ধে জানিয়েছেন, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় তাঁর রাগ হচ্ছে, তাঁর লজ্জিত লাগছে। অথচ, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ যে রাজ্যে অবস্থিত, যে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে, সে রাজ্যের প্রশাসকের ভূমিকা তিনি এড়িয়ে গেলেন কেন, বোঝা গেল না। এ রাজ্যে গণতন্ত্র কতটা রক্ষিত হচ্ছে? স্কুলে চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনকে যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশ দিয়ে স্তব্ধ করতে চেয়েছেন, তা দিল্লির যন্তর মন্তরে কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা-বিরোধী আন্দোলনকে দিল্লি পুলিশ দিয়ে স্তব্ধ করার সঙ্গে তুলনীয়। তা হলে এ কিসের গণতন্ত্র! গণতন্ত্রে যে কোনও বৈধ আন্দোলনকে পুলিশ দিয়ে কি আটকানো উচিত? এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সব সমান। তাই মানুষের অধিকার রক্ষায় মানুষকেই পথে নামতে হবে, সব ভয়-বাধা দূর করে যা করছেন কলকাতার জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের অনুসরণ করে বাংলার ভীত, সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ আশার আলো দেখতে পেলেন। তাঁদের দলমত নির্বিশেষে দিনের পর দিন ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে রাজপথ, যা এর আগে স্বাধীন বাংলাও কখনও দেখেনি। তাই প্রবন্ধকারের মতো আমরাও চাই, ৯ অগস্ট দিনটি বাংলার, বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর দিন হোক।
জয়ন্ত কুমার দেবনাথ, রানাঘাট, নদিয়া
শেষ ঘণ্টি
“চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন/ আর কবিতায় শুয়ে কাপলেট...” হয়তো আর থাকবে না সেই ট্রামলাইন। উনিশ শতকে কলকাতা-সহ ১৫টি শহরে চালু হয়েছিল ট্রাম। দীর্ঘ ১৫০ বছরের পথ চলা শেষ হতে চলেছে। একটা সময় কলকাতা মানে ছিল ট্রাম, আর ট্রাম মানেই ছিল কলকাতা। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ছবিতে দেখা যায় ট্রাম, তা যেন ছিল কলকাতারই পরিচিতি। ঢং-ঢং-ঢং করে সারা শহর মুখরিত রাখত ট্রাম। হয়তো এই আওয়াজে আর ঘুম ভাঙবে না কোনও শিশুর। কলেজপড়ুয়া প্রেমিক-প্রেমিকার বাদাম হাতে আর হয়তো ফেরা হবে না ট্রামে করে। কর্মব্যস্ত মানুষের সময়-স্বাচ্ছন্দ্যের অনেক দাম, তাই এখন মেট্রো রেল, অ্যাপ ক্যাব— এগুলোই মানুষের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে। কমতে কমতে ট্রামের রুট নেমে এসেছিল মাত্র তিনটেয়। সময় ও পথের যানজটের দোহাই দিয়ে বন্ধ হচ্ছে ট্রাম। শেষ ঘণ্টি বেজে গিয়েছে, কিন্তু ট্রামের উপর নির্ভর করে যাঁদের পেট চলত, তাঁদেরই বা কী হবে? কী হবে সেই সব মানুষদের, যাঁদের দিনের একটা অংশ ট্রামে কাটত?
অভিজ্ঞান দাস, চক মহম্মদ, পূর্ব মেদিনীপুর