ভারতে শিশুদের অবস্থা শোচনীয়। ফাইল চিত্র।
‘খামতি’ (১৮-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-এ ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭তম, যা ২০২১ সালের থেকেও খারাপ। সরকারের প্রতিক্রিয়া গত বছরের মতোই— এটি ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে এবং এর দ্বারা ভারতের ছবিকে আন্তর্জাতিক স্তরে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। সত্যিই অবাক ব্যাপার যে, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান— যারা এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তারাও ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে। এ বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর এ কথাও তো সত্যি যে, শুধুমাত্র ভারতীয় জনগণ যেন আহার ও সঠিক পুষ্টি পায়, তার জন্যই আইসিডিএস-এ প্রায় ১.৭৮ কোটি মহিলা ও ৭.৭ কোটি শিশু, ‘পোষণ অভিযান’-এ প্রায় ১২ কোটি ছাত্রছাত্রীকে পরিপূরক পুষ্টি এবং ন্যাশনাল ফুড সিকিয়োরিটি অ্যাক্ট-এর দ্বারা ৮০ কোটি ভারতীয়কে ফ্রি-তে রেশন দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রয়েছে সরকারের অনেক প্রকল্প।
অনেক গবেষকের মতে, এত কিছু সত্ত্বেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি অতিমারির জন্যই। করোনার ফলে বিশ্বে যে পরিমাণ মানুষ গরিব হয়েছেন, তার অর্ধেক ভারতীয়। এবং দেশে করোনা কালে কাজ হারিয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। রোজগার কমেছে দিনমজুরদের ও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। ফলে, ভারতের অধিকাংশ মানুষের পাত থেকে বাদ পড়েছে পুষ্টিকর খাবার। ২০১৯-২১ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫’এ দেখা গিয়েছিল, ভারতে ওয়েস্টিং উদ্বেগজনক এবং স্টান্টিং আগের থেকে কমলেও, পোষণ অভিযানের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। বরং দেশে রক্তাল্পতা আগের থেকে বেড়েছে।
সরকার যতই বাস্তব চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিক, ভারতে শিশুদের অবস্থা যে শোচনীয়, তা সরকারের প্রকাশিত তথ্যই বলছে। সরকার এই ব্যাপারে কতটা উদাসীন, তা প্রকল্পগুলোর জন্য অনুমোদিত অর্থই প্রমাণ করে। আইসিডিএস কর্মীরা বার বার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলোর জন্য অর্থ বৃদ্ধির দাবি করলেও সরকারের তরফ থেকে কোনও সদুত্তর আসেনি। একই অবস্থা প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও। যদিও অনেক দিনের দাবির পরে সরকার সম্প্রতি টাকা বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে, কিন্তু তা এতটাই কম যে, সেই বরাদ্দ টাকা দিয়ে কী করে প্রতি দিন ৪৫০ ও ৭০০ ক্যালরির খাবার ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া যেতে পারে, তা স্পষ্ট নয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কমেছে গরম রান্না করা খাবারের পুষ্টিগত মান, যার ফলে অভিভাবকদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও স্কুল কর্তৃপক্ষকেই।
তবে সমস্যা থাকলে তার সমাধানও থাকে, আশা করা যায় বর্তমান পরিস্থিতি দেখে সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ করবে যার দ্বারা অপুষ্টি ও অনাহারের সমস্যা থেকে ভারত দ্রুত মুক্তি পাবে।
সৌমিতা দেবনাথ, নাদনঘাট, পূর্ব বর্ধমান
নীতির সঙ্কট
এ বছর বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-এ ভারতের অবস্থান সদ্য খাদ্যসঙ্কট ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় কাটানো শ্রীলঙ্কার থেকেও খারাপ, অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তানের চেয়েও মন্দ। এটাই উন্নয়নের নমুনা বটে। কিন্তু এই দিন তো দেখতেই হত। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজের নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ধুঁকছে। খোলা বাজারের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিকে সামনে আনা হল পুঁজিপতিদের স্বার্থে, আর দেশের প্রায় ৮০% খেটে-খাওয়া মানুষ আরও বেশি দারিদ্রের অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন। ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ৮০% মানুষ দিনে ২ ডলার-এর কম আয় করেন, ক্রয়ক্ষমতার হিসাব কষলে তা দাঁড়ায় দিনে ৪৬ টাকা। যেখানে প্রয়োজনীয় ক্যালরি পাওয়ার মতো খাবার পেতে খরচ হয় দিনে ১১৫ টাকা। অথচ, গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ দিনে ৩৩ টাকা বা তারও কমে দিনাতিপাত করেন। এই সমস্ত পরিবার দিনে মাথাপিছু ১৩ টাকা খরচ করেন খাবার, আনাজ, ডাল ইত্যাদির জন্য। ভারতে ১৯.৩ শতাংশ শিশু উচ্চতার তুলনায় ওজনে বাড়েনি, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-এ সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ ইয়েমেনও ভারতের চেয়ে এ বিষয়ে এগিয়ে। তাই এই পরিসংখ্যানে আশ্চর্যের কিছু নেই।
স্বপ্নদ্বীপ মণ্ডল, হাওড়া
ক্ষুধিত শৈশব
‘ক্ষুধা-গহ্বরে তলাল দেশ’ (১৬-১০) শীর্ষক সংবাদটির তথ্যগুলি পড়ে বিশ্বের কাছে এক জন ভারতীয় হিসেবে মাথা হেঁট হয়ে যায়। ২০০০ সাল থেকে আয়ারল্যান্ড ও জার্মানির দুই সংস্থা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-এর রিপোর্টের মাধ্যমে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের একটা হিসাব প্রকাশ করে থাকে। এ বছর তাতে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭! অবশ্য মোদী সরকার রিপোর্টটিকে ভিত্তিহীন বলে পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছে। যদিও তাতে সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
মূলত যে চারটি মাপকাঠির ভিত্তিতে এই ক্ষুধা-সূচক তৈরি করা হয় সেগুলি হল, অপুষ্টি, শিশুদের উচ্চতার তুলনায় কম ওজন, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা ও শিশু মৃত্যুর হার। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে ওই চারটি বিষয় ধরে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ভারত আজ অনেক পিছিয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, ৯৭ কোটি ভারতীয় সুষম আহার থেকে বঞ্চিত। কৃষিপ্রধান দেশের চাষিরা ফসলের সঠিক দাম পাননি, অথচ করোনা অতিমারির পরে সব রকম খাবারের মূল্য আরও বেড়েছে। দু’দিক থেকেই মানুষ বঞ্চনার শিকার হতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে, সার্বিক ভাবে দেশে অপুষ্টির হার বেড়েছে।
২০১১ সালের সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে শিশুশ্রমিক এক কোটির বেশি। দারিদ্রের কারণে অভিভাবকরা শিশুদের নির্বিচারে ইটভাটায়, পাথর ভাঙার কাজে ও আতশবাজির কারখানায় কাজ করতে পাঠান। এই সব সস্তার শ্রমিক মালিকের কাছে লাভজনক। খিদে পেটে নিয়েই এদের শৈশব কখন ফুরিয়ে যায়, ক’জন তার খোঁজ রাখেন?
বাংলাদেশের শিশুরা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি লম্বা, কারণ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের ৪১.২ শতাংশ পরিবার, সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৭ শতাংশ। উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করার জন্য প্রতিনিয়ত নানান ধরনের ক্ষতিকারক জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা এবং উচ্চতার তুলনায় কম ওজন হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
সুশান্ত সাহু, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
তাঁতকাহন
‘গ্রামের অর্থনীতি ধুঁকছে, পুজোয় শাড়ি কিনবে কে?’ (২৮-৯) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে এই পত্রের অবতারণা। গ্রামীণ অর্থনীতি ধুঁকছে ঠিক, কিন্তু আত্মসমালোচনাও জরুরি। গতানুগতিক নকশা, ওজন বেশি, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য না নেওয়া, সর্বোপরি শিল্পী ও পাইকার উভয়েরই সদিচ্ছা ও দূরদৃষ্টিতার অভাবের কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। মান্ধাতার আমলের জাবদা নকশা আঁকড়ে থাকলে ব্যবসা অচল হতে বাধ্য। ধনেখালি শাড়ির পাড়, আঁচল, জমি কোনও বিভাগেই অভিনবত্ব নেই। শহুরে শৌখিন মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তাই শাড়ির বিক্রির জন্য গ্রাম-নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে।
অপর দিকে তাঁত শিল্পীদের অবস্থাও করুণ। আয় কম। গুজরাত, তামিলনাড়ু, এমনকি বাংলাদেশের শিল্পীদের অবস্থাও বেশ ভাল। কারণ, ভারী বয়নশিল্পের উপস্থিতি। ভারী শিল্প যন্ত্রচালিত তাঁতে কাঁচামাল সরবরাহ করে প্যান্ট, জামা, গেঞ্জির থান বুনিয়ে নেয়। কিন্তু এ রাজ্যে ভারী শিল্প বিদায় নেওয়াতে আমরা সেই ধুতি, গামছা, শাড়িতেই আটকে রইলাম। বেগমপুরেও তাঁত শিল্প বিদায় নিল।
প্রশান্ত ভড়, আঁটপুর, হুগলি