সম্পাদক সমীপেষু: আলোহীন অযান্ত্রিক

এখন শহরে ও শহরতলির রাস্তায় এই সব যানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে, সেই সঙ্গে যান্ত্রিক গাড়িও বেড়েছে প্রচুর। কিন্তু ওই সব ‘অযান্ত্রিক’ গাড়িতে আর আলো জ্বলে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০৪
Share:

চার-পাঁচ দশক আগেও কলকাতা এবং শহরতলির রাস্তায় রাতে ‘অযান্ত্রিক’ কম-গতির যান যেমন সাইকেল, সাইকেল রিকশা, টানা রিকশা, ভ্যান রিকশা ইত্যাদিতে আলো লাগানো বাধ্যতামূলক ছিল। সে সময় সাইকেলে অনেকেই ডায়নামো লাগাত। আর অন্য গাড়িতে কেরোসিন বাতি জ্বলত। বাতি না থাকলে পুলিশ গাড়ি আটক করত বা জরিমানা দিতে হত। এখন শহরে ও শহরতলির রাস্তায় এই সব যানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে, সেই সঙ্গে যান্ত্রিক গাড়িও বেড়েছে প্রচুর। কিন্তু ওই সব ‘অযান্ত্রিক’ গাড়িতে আর আলো জ্বলে না। বাধ্যতামূলক আইন হয়তো এখনও বলবৎ আছে, কিন্তু আইন মেনে পথে চলার অভ্যেস লোকে যেমন হারিয়েছে তেমনই রাতে গাড়িতে আলো জ্বেলে চলাটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে, মোটর গাড়ি চালকদের খুব অসুবিধে হয়। এমনিতেই কানে ফোন বা হেডফোন লাগিয়ে চলে প্রায় অনেকেই স্কুটার বা সাইকেলে, আর সব রাস্তায় আলোও খুব জোরালো নয়। প্রশাসন কি আবার সব রকমের গাড়িতেই রাতে আলো জ্বালানো বাধ্যতামূলক করে রাস্তা নিরাপদ করতে আগ্রহী হবে?

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা-১০৪

Advertisement

সেই মানুষগুলি

‘থিয়েটারেও কাছে টানি না’ (রবিবাসরীয়, ৭-১০) শীর্ষক বিভাস চক্রবর্তীর নিবন্ধটি পড়ে প্রাসঙ্গিক কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করতে এ চিঠি। নিবন্ধে তিনি খানিকটা আশাবাদী হয়ে মফস্সলের চিত্রটা জানতে চেয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আমি তেত্রিশ বছরের বেশি সময় কেশিয়াড়ির খাজরাতে বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এবং বর্তমান বাসস্থান পাঁশকুড়াতে সাংস্কৃতিক কাজকর্ম নিয়ে আছি। উভয় সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক করছি এত কাল। বিভাসবাবুকে যেটা জানাতে চাই আমি আমার শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছি সবং-এর মিশ্র জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। অদ্ভুত সে দিনগুলি স্মৃতিমেদুর করে আজও। তখনকার গ্রামীণ সমাজে যাত্রা ও যাত্রাধর্মী নাটক দেখতাম আমরা। বড়রা মহড়া দিয়ে কোনও পুজো বা উৎসবে মঞ্চস্থ করত। তেমনই এক বারের যাত্রাপালা ছিল ‘কৃষ্ণার্জুন’ এবং তাতে বলরামের ভূমিকায় অভিনয় করলেন সেখ দারাসতুল্লা নামে এক বর্ধিষ্ণু মুসলমান কৃষক, যাঁকে আমরা সবাই ‘দরসু কাকা’ বলে ডাকতাম। যাত্রার মূল কর্মকর্তা ছিলেন আমার বাবার বন্ধু আব্দুল ওহায়েব কাকা (যিনি মিন্টুবাবু নামে খ্যাত ছিলেন)। আর এক জনের কথা বলি— তাঁর নাম শেখ ফকির মহম্মদ, ঝাঁকড়া বাবরি চুল, মাথা ভর্তি। গ্রামের হাটে হাটে ঘুরে টর্চ, হ্যাজ়াক প্রভৃতি সারানোর পেশা ছিল তাঁর। যাত্রার মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি প্রায় অনিবার্য ছিল বহুকালব্যাপী। করুণ রস ফুটিয়ে তুলতে তাঁর জুড়ি ছিল না সে সময়। শিশু অভিনেতা হিসাবে ফকিরদার সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগও পেয়েছি। তবে ফকিরদাকে সংলাপ পড়ে দিতে হত, উনি সাক্ষর হলেও বড় বড় সংলাপ শুনেই মুখস্থ করে নিতেন। এ বার আসি মন্তাজদার কথায়। অভিনয় করতেন না। পূর্বে উল্লিখিত শেখ দারাসতুল্লার ছেলে। পরিবহণ ব্যবসায়ী, নাটক-পাগল মানুষ। নাটকের দিন ডিউটি যেতেন না। মনে আছে, এক বার শীতকালে ধানকাটা জমিতেই উঁচুতে মঞ্চ করে পৌরাণিক নাটকের অভিনয় চলছে, আমার বড়দা শক্তিপদ ভট্টাচার্যের পরিচালনায়। হঠাৎ অভিনয়ের মধ্যেই মাঝের পাটাতন ভেঙে বসে যেতে লাগল। মন্তাজদা উইংসের পাশেই ছিলেন, টের পেয়েই সটান মঞ্চের নীচে গিয়ে ভাঙা পাটাতন পিঠ দিয়ে তুলে ধরে রেখে জোরে জোরে বললেন ‘‘শক্তিদা অভিনয় চালিয়ে যান, আমি নীচে আছি।’’ দৃশ্য শেষে বড়দা মন্তাজদাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। সব শেষে আর এক জনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন রহমানদা। রহমান খান, বস্ত্র ব্যবসায়ী। রহমানদা এলাকায় নাটক বা যাত্রা বা ফুটবল খেলা থাকলেই সবার আগে হাজির। সুতীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে সমর্থন দিতেন খেলার মাঠে, ভাল অভিনয়ে শিল্পীকে ভরিয়ে দিতেন হাততালিতে। এঁদের অনেকেই আজ জীবিত নেই, তাঁদের স্মৃতি আমার মতো অনেক সবংবাসীর কাছে অমলিন। বিভাসবাবুর নিবন্ধ পড়তে গিয়ে এঁদের কথা মনে ভিড় করে এল। মনে হল এই অবক্ষয়ের কালে এই সব মানুষদের কথা আরও কিছু মানুষকে জানাতে পারলে তৃপ্তি অনুভব করব।

তারকেশ্বর ভট্টাচার্য

পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর

সুপ্ত সাম্প্রদায়িক

বিভাস চক্রবর্তী (‘থিয়েটারেও কাছে টানি না’, ৭-১০) লিখেছেন, ‘‘এ এক বিচিত্র শহর, ঢাকাতেই হোক, অসমেই হোক বা কলকাতায়— সে রকম লাগসই কোনও ঘটনা ঘটলে কয়েক জন মিলে শহরের কোথাও না কোথাও প্রতিবাদের বুড়ি ছুঁয়ে বুকভরা সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে চলে যাই আমরা।’’ নাট্যজগতের কথামৃত প্রবাদ অনুযায়ী ‘থ্যাটারে যেমন লোকশিক্ষে হয়’, তেমনই লোকশিক্ষা থেকেও থিয়েটার হয়। এই দেওয়া-নেওয়ার মঞ্চে মুশকিল হল সাম্প্রদায়িকতা নামক অতিস্পর্শকাতর বিষয় যার সামান্য এ দিক ও দিক হওয়ার জন্য যে খেসারত বাঙালিদের দিতে হয়েছে, তার হিসেব মেলা ভার। তাই ‘সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে’ যেতে হয় সার্বিক বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য। আর যা-ই হোক, নাট্যকর্মীরা আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক কর্মী হলেও শান্তিশৃঙ্খলার দায় বা দায়িত্ব, কোনওটাই সামলানোর উপযুক্ত নয়। তাই, সংবেদনশীল বিষয় নাটকে রাখলে নিজস্ব সীমাবদ্ধতা মাথায় রাখতেই হয়।

তবু বলি, যতই এড়িয়ে যাওয়া যাক না কেন, এই ‘সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা’ বিষয়টি আমাদের চেনা পরিমণ্ডলে স্পষ্ট ভাবেই আছে। নিজস্ব অভিজ্ঞতা পেশ করি। আশির দশকে কর্মসূত্রে চন্দননগরে এসে বাড়ি ভাড়া খুঁজি। বাড়িওয়ালার প্রথমেই প্রশ্ন: নাম কী, কী করি। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। পরের প্রশ্ন: বাঙাল? বুঝলাম বাঙাল হলে ভাড়া পাব না। যদিও আমি এ দেশি বর্ধমানি ঘটি, স্ত্রী বরিশালি বাঙাল। কী করি, চেপে গেলাম। আর এক বার, ইতিহাসের অনুসন্ধানে বিখ্যাত এক পরিবারে যাই। তিনি প্রায় পুলিশি জেরা করতে শুরু করলেন, আমি সত্যিই খাস বর্ধমানের লোক কি না। দু’টি ক্ষেত্রেই বিভাসবাবু কথিত ‘সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা’ হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি।

সাধারণ বুদ্ধিতে যেটুকু বুঝি, চন্দননগরের আদিবাসী বলতে গেলে ভাগীরথী বা গঙ্গা ও সরস্বতী নদীভিত্তিক ধীবর সম্প্রদায় ও কৃষিনির্ভর মানুষকে বোঝায়। ক্রমে গঙ্গা ও সরস্বতী নদীভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ে। চৈতন্যের সময়ে দ্বারিক জাঙ্গাল রোড, মুসলিম শাসনে শাহি সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, ব্রিটিশ শাসনে রেলপথ ও ফরাসি শাসনে চওড়া রাস্তা গড়ে ওঠে। যাতায়াতের এই সুবিধার জন্য বাইরে থেকে বর্গি বা অন্য শাসকের তাড়া খেয়ে বহু বর্ণের মানুষ চন্দননগরে আসেন। ফরাসি আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি, নিরাপত্তা-সহ আরও অনেক কিছু কারণে এক দিকে শেঠ, নন্দী, কুণ্ডু, রক্ষিত, ধাড়া, ধর, দাস ইত্যাদি অন্য দিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী প্রমুখ পদবিধারীরা আসেন। এঁরা ভাল জায়গায় বাড়ি করেন। কয়েক পুরুষ ধরে থাকেন। তুলনায় ‘অর্বাচীন’ বাঙালরা পরে আসেন, বাংলা তথা ভারত ভাগ হওয়ার সূত্রে কলোনি গড়ে বাসা শুরু করেন। বাঙাল মানেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ওঠাবসা— ছ্যা ছ্যা, ওদের কোনও এঁটোকাঁটার বালাই নেই, সবেতেই মাছ ইত্যাদি। অর্থাৎ বাঙালরা প্রায় মুসলমানেরই সমধর্মীয়। তায় এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসে জবরদখল।

এই সব আমাদের প্রতি দিনের বাস্তব, কষ্ট হলেও আমরা সয়ে নিই। কত জটিল সামাজিক বিষয় নিয়ে নাটক রচনা করা হয়: সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার অণু-ইতিহাস নিয়ে নাটক লেখা হয়নি কেন, কে জানে।

শুভ্রাংশু কুমার রায়

ফটকগোড়া, চন্দননগর, হুগলি

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement