সদ্যপ্রয়াত অশোক মিত্র সম্পর্কে লেখা হয়েছে (৩-৫), ‘‘বাংলার রাজনীতি তাঁকে প্রথম নজর করে জরুরি অবস্থার সময়ে।’’ ঘটনা হচ্ছে, জরুরি অবস্থার কুড়ি দিন আগেই জয়প্রকাশ নারায়ণের আহ্বানে কলকাতা ময়দানে ৫ জুন, ১৯৭৫-এ এক বিশাল ইন্দিরাবিরোধী সর্বদলীয় জনসভা হয়েছিল। শ্রীমিত্রকে দিয়ে সে দিন সভার প্রস্তাব পাঠ করানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে তাঁর রাজনীতিতেও অভিষেক ঘটল। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে তিনি যখন বামফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জনতা পার্টির অধ্যাপক অশোক মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তখন তাঁকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি কখনও আগে রাজনীতি করতেন? তাঁর উত্তরে শ্রীমিত্র বলেছিলেন, রাজনীতি করতাম কি না, এ কথা ঢাকার বিপ্লবী সুনীল দাস ও অধ্যাপক সমর গুহকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। ঘটনাচক্রে বিপ্লবী সুনীল দাস রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ১৯৭৫ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন কংগ্রেসের প্রার্থী অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন মহাশয়কে পরাজিত করে। পরে অবশ্য আর কখনও শ্রীমিত্র রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে, ওঁদের নাম করেননি।
পংকজ কুমার গুহ কলকাতা-৪৭
এই মে দিন
মে দিনের প্রভাতেই রিক্ততর হলাম, অশোক মিত্র পরলোকগত। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ছ’টি বইয়ের একটির নাম ছিল কবিতা থেকে মিছিলে। কলকাতা থেকে পাঁচশো মাইল দূরে মফস্সল একাকী কৈশোরে পাঠ, বহু পুনঃপাঠেও সেই বইয়ের অনেক কিছুই ছিল অগম্য, ক্রমশ যৌবনে উত্তরণের কালে সেই বই-ই যেন হয়ে উঠেছিল দিগ্দর্শন। তত দিনে গোগ্রাসে গিলছি তাঁর নাস্তিকতার বাইরে, অচেনাকে চিনে চিনে, সমাজ সংস্থা আশা নিরাশা, পুরনো আখরগুলি, পরিণত বয়সে পরের কিস্তির আপিলা চাপিলা’র জন্য ছিল পক্ষকাল নিরন্তর অপেক্ষা। অর্থনীতিচর্চার সুবাদে প্রবেশ হল ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-র (ইপিডব্লিউ নামে পরিচিত) বিস্তৃত জগতে। সেখানে আবিষ্কৃত হলেন আর এক ক্ষুরধার অশোক মিত্র, বিষয়বৈচিত্রে যাঁর লেখা রামধনুকেও হার মানায়। এ ছাড়া পড়লাম কলকাতা ডায়রি, দ্য টেলিগ্রাফ-এর কাটিং কর্নার কলাম। কোনও লেখায় আখ্যান: ১৯৫৭ সালে স্বাধীন দেশে প্রথম বাম সরকারের বাজেট প্রস্তুতিতে এক সহকর্মীকে নিয়ে প্রায় দু’মাস গোপনে হোটেলে থেকে সাহায্য করা, যেখানে প্রবেশাধিকার ছিল শুধুমাত্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও পার্টির রাজ্য সম্পাদকের। কোনও লেখায় চে গুয়েভারার বিশাল বুকে তাঁর ছোট চেহারার আলিঙ্গন-অভিজ্ঞতা। কোথাও আই ভি পটেলের (অমর্ত্য সেন ছাড়া আর যাঁকে তিনি অর্থশাস্ত্রে বিশেষ দক্ষ বলে মনে করতেন) গলা ছেড়ে রবীন্দ্রগান গাওয়া।
২০০৯ সালে ইপিডব্লিউ-র একটি দশ দিনব্যাপী কর্মশালায় দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তা হয়ে এলেন পত্রিকার তৎকালীন ডেপুটি এডিটর বার্নার্ড ডি মেলো। উপস্থিত সব অংশীকে তিনি, তাদের পছন্দমতো একটি প্রবন্ধকে সংক্ষেপ করতে বলে আধ ঘণ্টা সময় দিলেন। আমি বাছলাম ইপিডব্লিউ-তে অশোক মিত্রের লেখা নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর নিয়ে প্রবন্ধ। সবার লেখা পড়ে মতামত দিয়ে, আমার লেখাটা হাতে নিয়ে বার্নার্ড কাছে এসে বললেন: যাঁর লেখনীর বিশেষ গুণই হল মেদহীনতা, কোন সাহসে আমি তাঁর লেখার সংক্ষিপ্তকরণে হাত দিয়েছি!
দেবত্র দে ব্যারাকপুর
ঠোঁটকাটা
যখন অশোকবাবু বামফ্রন্টের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দফতরেরও তিনি মন্ত্রী ছিলেন। দিঘার উন্নয়ন তখন সেই দফতরের অধীনে। দিঘার ‘কটেজ’ এবং সৈকতাবাসের পুরো দায়িত্ব দিঘার প্রশাসকের হাতে। কথা হচ্ছিল অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ রিজার্ভেশন পর্যটন দফতরকে দেওয়া যায় কি না। প্রাথমিক আলোচনার পর বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে একটা মিটিং-এ পর্যটনমন্ত্রী এ প্রসঙ্গ তুলতেই মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা রাগত স্বরেই অশোকবাবুকে বলে ফেললেন, ‘‘অশোকবাবু, সাম্রাজ্য চলে যাবে বলেই আপনার আপত্তি আছে নাকি? তাই ব্যাপারটা এগোচ্ছে না।’’ অশোকবাবুর ঝটিতি জবাব, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আমাকে ভাল ভাবে জানেন এবং চেনেন। তিনি আমাকে যা কাজ দেন তা-ই করি বা করব। সাম্রাজ্যবিস্তারে কোনও দিন আগ্রহ দেখাইনি, তার রক্ষাতেই বা সচেষ্ট হব কেন?’’ সভায় তখন নিস্তব্ধতা।
এ হেন অশোকবাবু ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে মহাকরণ ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকা মনস্থ করলেন। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে, আলিমুদ্দিনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইঙ্গিত যেটুকু দিলেন তা হল, ‘‘একটি বিশেষ ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির দুস্তর ব্যবধানের জন্য।’’ কিছু দিন আগে থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অর্থনীতির অধ্যাপক— তাঁর অনুজ— যাঁকে তিনি রাজ্য যোজনা পর্ষদের ‘আংশিক সদস্য’ হিসেবে নিয়ে এসেছেন, তিনিই কি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন? মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারে পরিকল্পনা মূল্যায়নের দফতরওয়ারি মিটিং-এ ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে উঠল। অশোকবাবু যখন মন্ত্রী, সচিব বা দফতরিদের তুলোধোনা করছেন, তখন অধ্যাপক তাঁদের হয়ে সাফাই গেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে (তাঁরই পাশে একটি চেয়ারে বসে) ‘দুর্লভ’ হাসি ফোটানোর চেষ্টায় সদাব্যস্ত।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকেই যোজনা কমিশনের সঙ্গে মতবিরোধ শুরু হল রাজ্যের, আমাদের বার্ষিক পরিকল্পনার আয়তন ‘রিসোর্স-বেস্ড’ নয় বলে। এই কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় অশোকবাবুই। তাঁর কথাতেই, ‘‘কোনও ছুতোয় সাংবাদিকদের ডেকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক আশু পুনর্বিন্যাসের আত্যন্তিক আবশ্যকতা নিয়ে গলা ফাটাতাম। দু’এক বছরের মধ্যে আমি সারা দেশে সংবাদপত্রে নিন্দা-প্রশংসা-জল্পনার খোরাক হয়ে গেলাম। কেরলের একদা মুখ্যমন্ত্রী বাসুদেবন নায়ার হেসে বললেন, ‘তোমার ভয়ে ওই ক’বছর কেন্দ্রীয় সরকার কাঁপত’।’’ কেন্দ্রবিরোধী প্ল্যাটফর্মে অশোকবাবুর সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতাকে জ্যোতিবাবু অবশ্যই ভাল চোখে দেখেননি।
রাজ্য রাজনীতি ও প্রশাসনে যখন এমন অবস্থা, তখন শিক্ষককুলের মাইনে ও প্রমোশন সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিসভায় চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। শুনেছিলাম, সেই অধ্যাপক স্বজাতির অনুকূলে মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটা অর্থমন্ত্রীর এক্তিয়ারে প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে পদ আঁকড়ে থাকার মানুষ অশোকবাবু নন। তাই সব ছেড়েছুড়ে তাঁর প্রস্থান।
দেবকীনন্দন মণ্ডল কলকাতা-৯১
পুরো বাংলায়
১৯৯৩। আমি তখন কর্মসূত্রে পঞ্চায়েত দফতরে। পঞ্জাবের প্রাক্তন রাজ্যপাল প্রয়াত নির্মল মুখোপাধ্যায় ও বর্তমান সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। তারই উপর আলোচনা চক্রের অনুষ্ঠান। প্রধান বক্তা অশোক মিত্র। বাংলায় বলতে শুরু করেছেন। অনুরোধ করা হল, নির্মলবাবু বাংলা বুঝতে পারেন না, যদি ইংরেজিতে বক্তব্যটি পেশ করেন। উত্তরে বললেন, পদবি তো এখনও মুখোপাধ্যায়ই ব্যবহার করেন, তাই আমি বাংলাতেই বলব। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার সেই বক্তব্য। শুরুর মুহূর্তেই সহকর্মীকে বলেছিলাম, দেখো, আজ বক্তৃতায় একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করবেন না। তা-ই ঘটল। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। বিশ্বাস দৃঢ় হল, যে মানুষ নিজেকে এমন সক্ষম ও সমৃদ্ধ করে তুলেছেন, তিনি একটু বেশি ক্রোধ প্রকাশের অধিকার রাখেন।
অরবিন্দ ঘোষ কলকাতা-১০৬
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়