তিলোত্তমা মজুমদারের ‘আকাশ ভরা তারার কথা’ (রবিবাসরীয়, ১-৯) সাম্প্রতিক সময়ের একটি বলিষ্ঠ প্রবন্ধ। আর জি কর কাণ্ড এখন রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশ তথা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গেছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ অগস্ট, মাঝরাতে যে লাখ লাখ নারী-পুরুষ রাস্তা দখল করে নিয়েছিলেন, তা দেখে মনে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। ওই রাতের রাস্তা দখল বিশ্বের সব মানুষকে একটা বার্তা দিয়েছে যে, নারী-স্বাধীনতা, তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা বা দোষীদের শাস্তির দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যদি শুধু রাজনীতিই করে যায়, তা হলে সাধারণ মানুষ পথে নামবেনই! যে সব রাজনৈতিক দল ব্রিগেড সমাবেশ নিয়ে গর্ব করে, তারা অবাক বিস্ময়ে দেখেছে ওদের ব্রিগেডের জনসংখ্যার থেকে বিশগুণ বেশি জমায়েত ছিল সারা পশ্চিমবঙ্গের গ্ৰাম, শহর, নগর জুড়ে। একই সময়ে রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে দাবানলের মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিদেশের বিভিন্ন শহরে এই প্রতিবাদ মিছিল ছড়িয়ে পড়েছিল। সময়টা ছিল সন্ধ্যা থেকে রাত, রাত থেকে গভীর রাত, ভোর রাত। বিস্ময়কর ঘটনা হল উপস্থিতির ষাট থেকে সত্তর শতাংশ নারী! সমাজের সর্বস্তরের। উপস্থিতির জন্য কোনও চাপ ছিল না, অর্থের লোভ ছিল না, বিরিয়ানির প্যাকেট ছিল না, যানবাহনের সুবিধা ছিল না, পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও নিরাপত্তার আশ্বাস ছিল না। তবুও এই আশাতীত স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত। সমস্ত লজ্জা-সঙ্কোচ, ভয়, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে নারীরা মধ্যরাতে রাস্তার দখল নিয়েছিলেন। সমর্থক হিসাবে সমব্যথী পুরুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। দাবি ছিল, আর জি কর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক পড়ুয়ার পৈশাচিক-নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আসল অপরাধীদের ধরা এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। অবস্থান ও মিছিলে ছোট্ট অথচ তীব্র স্লোগান— ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, বিচার চাই, সুরক্ষা চাই, স্বাধীনতা চাই, সমানাধিকার চাই। সেই সঙ্গে ছিল আবৃত্তি, গণসঙ্গীত, ছবি আঁকা, পোস্টার তৈরির কাজ। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের ইতিহাসে এ রকম নারীজাগরণ, নারীঅভ্যুত্থান আগে কখনও হয়েছে কি না জানা নেই।
আর জি কর কাণ্ড নারীসমাজের কাছে একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক, একটা হৃদয় মোচড়ানো চাপা কান্না, একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। কন্যাসন্তানের অভিভাবকদের কাছে নিদারুণ ভয় ও আতঙ্ক। এরই বহিঃপ্রকাশ ‘মধ্যরাতে নারীদের রাস্তা দখল’। একবিংশ শতাব্দীতেও অধিকাংশ নারীর জীবন সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। ভ্রূণ হত্যা, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, গার্হস্থ হিংসা, ধর্ষণের শিকার বহু নারী। সন্তান পালনের ক্ষেত্রে পুত্র-কন্যারও সমানাধিকার থাকে না। ফলে মেয়েরা উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা অনেকেই উপার্জনশীল হতে, প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই স্বাধীনতা তাদের কাছে অধরা থেকে যায়। মেয়েদের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ মঞ্চ এই জমায়েত।
অনস্বীকার্য যে, সরকার, রাজনৈতিক দল, পুলিশ-প্রশাসন এ জাতীয় জঘন্য অপরাধ রাজ্য থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে না। কিন্তু সত্যিকারের অপরাধীকে হাতকড়া পরাতে, কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারে। মহামান্য হাই কোর্টের নির্দেশে তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছে সিবিআই-এর হাতে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই মামলা শুনছে। বিচার চলছে। একই সঙ্গে পুলিশ, প্রশাসনের বিরুদ্ধে লাগাতার অহিংস আন্দোলন চলছে। একটি মশাল থেকে হাজার মশাল, একটি মোমবাতি থেকে লক্ষ মোমবাতি জ্বলে উঠে নারীমুক্তির পথ আলোকিত করবে, এটাই আশা। পশ্চিমবঙ্গের নারীরা সারা পৃথিবীর নারীসমাজের পথপ্রদর্শক হবেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পৃথিবীর নারীসমাজ অসীম আগ্ৰহে তাকিয়ে আছে তদন্তের ফলাফলের দিকে। আমাদের সবার প্রার্থনা, সত্য উদ্ঘাটিত হোক।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
অসুরক্ষিত
‘ঘরে-বাইরে প্রশ্নের মুখে’ (২২-৮) প্রবন্ধে প্রেমাংশু চৌধুরী আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল গণবিক্ষোভে তৃণমূল কংগ্রেসের জনসমর্থন কমার যে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে সহমত হলেও, তার রাজনৈতিক সুবিধা বিজেপিই ঘরে তুলবে বলে যা বলেছেন, তার সঙ্গে একমত হওয়া গেল না। তার অনেকগুলি কারণ রয়েছে।
আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে বিজেপি শুরু থেকে নামেনি। না নামার কারণ সম্ভবত বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে ধর্ষণের ঘটনা এত স্বাভাবিক যে, এই ঘটনাটির প্রতিবাদ করা দরকার, তা তাদের মনেই হয়নি। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বিজেপি নেতারা ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার বিরোধিতা করেননি শুধু নয়, কাঠুয়ার মতো ঘটনায় দলের নেতারা ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিলও করেছেন। হাথরস এবং উন্নাওয়ে কী ভাবে ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে বিজেপি প্রশাসন চেষ্টা চালিয়েছিল, তা আজ কারও অজানা নয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদে নামার কথা তাদের মনেই হয়নি। কিন্তু যখন এ রাজ্য তো বটেই, গোটা দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা রাজ্য নেতাদের উপর চাপ তৈরি করলেন, তখনই রাজ্য নেতারা রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ সবই রাজ্যের মানুষ জানেন। রাস্তায় নামার পরও আর জি করের ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করা এবং গ্রেফতার করে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার দাবিকে জোরদার করার থেকেও রাজ্যে শাসনের পরিবর্তনই তাঁদের মুখ্য দাবি হয়ে উঠেছে। এই দাবির পিছনে যে সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থই কাজ করছে, এটুকু বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান রাজ্যের মানুষের আছে৷
তা ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের জনসমর্থন কমছে মানেই সেই সমর্থন বিজেপির দিকে যাবে, এমনটা ভাবা পরিস্থিতির অতি সরলীকৃত ব্যাখ্যা। এ রাজ্যে তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা কম। কারণ বিজেপি দল হিসাবে যেমন পরিচিত, তেমনই তার রাজনীতিও সাধারণ মানুষের অজানা নয়। বিজেপি শাসনে মহিলারা যে নিরাপদ নন, কোথাওই তাদের শাসন যে মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি, তা স্পষ্ট। বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশ ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে শীর্ষস্থানে রয়েছে। তাই এ কথা বলা যায় না যে, পরিস্থিতির সুবিধা বিজেপিই ঘরে তুলবে।
সমুদ্র গুপ্ত, কলকাতা-৬
সামনে মেয়েরা
আর জি করে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস খুন শহর-গ্রামের আন্দোলনকে এক সুরে মিলিয়ে দিয়েছে। প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রতিবেদন শাসক তৃণমূলের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সব শ্রেণির মানুষের প্রতিবাদের পিছনে আছে দীর্ঘ দিন ধরে চলা দুর্নীতি দমনপীড়নের ইতিহাস। এই ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কলেজ অধ্যক্ষের প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্ব তৃণমূল দলকে যথেষ্ট কোণঠাসা করেছে। একই সঙ্গে তৃণমূল দলের অভ্যন্তরের সরব ও নীরব ক্ষোভও দলের সঙ্কটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এটাকে বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে রাম-বামের চক্রান্ত বলে চিৎকার করছেন। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক, বিরোধীরা শাসকের সঙ্কটকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবে। ২০১২ সালে দিল্লির ভয়ঙ্কর নির্ভয়া-কাণ্ড পরবর্তী সময়ে মনমোহন সিংহের সরকারের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার গড়ে উঠেছিল বামফ্রন্টকে পরাজিত করে, হাতিয়ার ছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নেতাই প্রভৃতি স্থানে সরকারের অমানবিক আচরণ। সাম্প্রতিক ঘটনায় লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রাপক মহিলারা সবচেয়ে বেশি সরকার-বিরোধী আন্দোলনে শামিল, যা শাসকের বড় সমস্যা। বিরোধীরা চেষ্টা করবেন তাকে কাজে লাগাতে। তবে ভোটকুশলী মুখ্যমন্ত্রী কোন কৌশলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন, তা অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া, কদমতলা