আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা বর্তমানে নিদারুণ দুর্দশায় রয়েছেন। তাঁদের নিজ ঘরে ফেরানো বা যেখানে আছেন সেখানেই থাকার ব্যবস্থা করা, খাওয়া ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা— এ সব বিষয়ে কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়েই, দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হল।
লকডাউনের বিরোধিতা করার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু এই ঘোষণার আগেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে সুব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল।
আসলে হতদরিদ্রদের মানুষ বলেই মনে করে না এ দেশের শাসক সম্প্রদায়। কাজের অধিকারকে প্রত্যেকটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে আজও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। চূড়ান্ত বেকার সমস্যার যুগে বাজারে অঢেল শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত। কাজ পাওয়া কঠিন। আর কাজ যদিও বা মেলে, মজুরি নিয়ে মালিকের সঙ্গে দর কষাকষির কোনও সুযোগই নেই শ্রমিকদের। ফলে পেটের দায়ে অপেক্ষাকৃত একটু বেশি মজুরিতে শ্রম বিক্রি করার তাগিদে হন্যে হয়ে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে পরিবার পরিজন ছেড়ে অনেকে পাড়ি দিতে বাধ্য।
এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য যে আইন আছে, তা মালিক/ঠিকাদার এবং সরকার— কেউই মানে না। অবশ্য আইন না মানার ক্ষেত্রে সরকার বাহাদুরই পথিকৃৎ।
যেমন:
(১) এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে অথবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে কত শ্রমিক কাজ করতে যাচ্ছেন, তার সংখ্যা এবং সমস্ত বিস্তারিত তথ্য সহ নিবন্ধগ্ৰন্থ (রেজিস্টার) উভয় রাজ্য বা দেশের সরকারের রক্ষা করা বাধ্যতামূলক।
(২) সংশ্লিষ্ট পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অন্যান্য বিধিবদ্ধ আইনানুগ প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাগুলি সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্য বা দেশের শ্রম দফতরের।
এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময় অন্তর বা প্রয়োজনে পরিযায়ী শ্রমিকরা যাতে সুষ্ঠু ভাবে নিজ গৃহে ফিরতে পারেন, তার দায়িত্বও আইনে সুনির্দিষ্ট করা আছে।
তা হলে, আইন অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে কত পরিযায়ী শ্রমিক আছেন, তার সংখ্যা সরকারের জানা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের ‘লকডাউন’ঘোষণার আগেই নিজ গৃহে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার পালন না করে, তাঁদের প্রতি চরম নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করেছে।
শুধু তা-ই নয়, যাঁরা নিজেদের উদ্যোগে ঘরে ফিরে আসছেন, কোনও একটি রাজ্য সরকার চরম অমানবিক ভাবে রাসায়নিক স্প্রে দিয়ে তাঁদের ‘শোধন’ করেছে। এ হল সভ্যতার লজ্জা।
আমরা এই অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা মোচনের জন্য বার বার চিঠি লিখে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। ফল হয়নি। এঁদের ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা করার কোনও সুযোগ এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। সে জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলি গ্ৰহণ করার দাবি জানাচ্ছি।
(১) অবিলম্বে কিছু সীমিত রুটে ট্রেন ও আন্তঃরাজ্য বাস চালিয়ে (প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা গ্ৰহণ করে) যুদ্ধকালীন জরুরি ভিত্তিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক।
(২) যত ক্ষণ তা সম্ভব না হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের নিজ স্থানে পরিবার পরিজন সহ থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার দায়িত্ব কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোকে নিতে হবে। নয়তো করোনাভাইরাসের পরিবর্তে অনাহারে, অর্ধাহারে, উদ্বেগে ও বিনা চিকিৎসায় যদি এঁদের এক জনেরও মৃত্যু হয়, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
মানস কুমার সিংহ
সদস্য,ওয়ার্কিং কমিটি, এআইইউটিইউসি
অমানবিক
দেশব্যাপী করোনা আতঙ্কের আবহে অনন্য নজির গড়ল যোগী আদিত্যনাথ সরকারের পুলিশ। একটি চেকপোস্টে শুদ্ধকরণের নামে এক দল পরিযায়ী শ্রমিকের গায়ে জীবাণুনাশক রাসায়নিকের স্প্রে ছড়িয়ে ভিজিয়ে দেওয়ার ছবি দেখে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়। চার ঘণ্টার নোটিশে সারা দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণার সময় ভিন্ রাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের তীব্র অসুবিধার কথা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আদৌ বিবেচনা করেননি। বোঁচকা মাথায় পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরতে গিয়ে অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এতে শুধু লকডাউনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়নি, প্রান্তিক মানুষদের একাংশকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র এ দায় এড়াতে পারে না। যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসন লকডাউন পর্বে বাস চালিয়ে প্রাথমিক ভাবে শর্ত লঙ্ঘন করেছে। এ বার রাস্তার পাশে মালপত্র সহ উবু হয়ে বসে থাকা এক দল লোকের উপর জীবানুনাশক স্প্রে ছড়িয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হল। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠেছে, এয়ারপোর্টে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের ওপর পরীক্ষার কড়াকড়ি হল না, অথচ পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এমন আচরণ!
সরিৎশেখর দাস
চন্দনপুকুর, ব্যারাকপুর
প্রাপ্তিগুলো
করোনাভাইরাস আপাত ভাবে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে। আমাদের দেশেও পরস্পর যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলির এক হওয়ার বিরল চিত্রটি আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
করোনা মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করতেও সহায়ক হয়েছে। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মেলামেশার সময় ছিল না ইতিপূর্বে। এখন লকডাউনের ফলে অবকাশ যাপনে সেই প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়দের সঙ্গে অন্তত ফোনে সম্পর্ক মেরামতের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
বাড়িতে সাজানো রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরৎ রচনাবলি এবং জমতে থাকা শারদীয় পত্রিকাগুলোর ধুলো ঝেড়ে নাড়াচাড়া করার অবকাশও এখন সবাই পাচ্ছেন। যুগের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মানুষজনের কাছে এটি একটি বড় প্রাপ্তি।
পেশাগত চাপে হারিয়ে যাওয়া সৃষ্টিশীলতাকে ফিরিয়ে আনার জন্যও কিছুটা সময় পাওয়া যাচ্ছে। মাথায় রাখতে হবে, জওহরলাল নেহরু (এবং অন্য অনেক মনীষী) জেলে বসেই সাহিত্যচর্চা করেছেন। আমরাও যদি যার যার সাধ্যমতো ‘বন্দি’ সময়টাকে কাজে লাগাই, হয়তো অনেক কিছুই সৃষ্টি করতে পারব, যা অন্য অনেককে আনন্দ দিতে সক্ষম। সুখের কথা, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অনেকেই সেই চেষ্টা করছেন।
আর পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমে যাওয়াটা তো বিরাট প্রাপ্তি বটেই।
তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসী হয়ে যাওয়া ভারতবর্ষের ‘হিরের টুকরো’ ছেলেমেয়েরা ঘরে ফেরার ফ্লাইট ধরলেন এবং প্রায় ভুলে যাওয়া পিতা-মাতার কোলে ফিরলেন, এও কি কম কথা?
সর্বোপরি, তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রগুলির গর্ব ও উন্নসিকতায় করোনা একটি ওজনদার চপেটাঘাত।
তরুণ কুমার মাইতি
বরদাপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
কিছু প্রস্তাব
পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত সুষ্ঠু ভাবে করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পরিচালনা করা হচ্ছে। তবু কিছু প্রস্তাব রইল।
১) সমস্ত চিকিৎসককে একসঙ্গে সেবায় নিয়োজিত না করে রোটেশনের মাধ্যমে করা।
২) মেডিকেল কলেজে ৩০০০ বেডও কম হতে পারে এটা ধরেই নিয়ে অগ্রিম ব্যবস্থা করা। এর জন্য ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র, মৌলালি ও যুবভারতীতে যুব আবাস, কিছু বড় হোটেল ও কিছু পৌর হাসপাতাল (দমদম) কাজে লাগানো যেতে পারে।
৩) এর পরেই বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবকের প্রয়োজন বিভিন্ন কারণে পড়তে পারে। তার জন্য বেশ কিছু ক্লাবকে তৈরি থাকতে বলা এবং ক্লাবের সদস্যদের জন্য উপযুক্ত পোশাক, মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।
উৎসব ভট্টাচার্য
কলকাতা-১৩৫
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।