প্রতীকী ছবি।
গত কুড়ি বছর ধরে বেঙ্গালুরুতে বসবাস করছি। আমি একটি বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থায় চাকরিরত। ১৭ মার্চ থেকে, করোনাভাইরাসের জন্য অফিসের নির্দেশে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করছি। কাজের চাপে ওই সপ্তাহে প্রায় বেরনো হয়নি বাড়ি থেকে। এমনকি, লকডাউনের কড়াকড়িতে প্রতি দিন রাস্তায় ‘ওয়াকিং’-এর জন্য বেরিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। আমার বাড়ির কাছে পাঁচখানা পার্ক। তবে সবক’টাই বন্ধ মোটামুটি মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে। এই কয়েকটা দিন তবুও অফিসের কাজে মোটামুটি ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধের মিটিংগুলো আগে কখনও এতটা এনজয় করিনি। লকডাউনের পরে প্রথম ফ্রাইডে। অফিসের কাজ একটু কমই। তবে সকাল থেকে মেজাজটা কেমন যেন বর্ষার মেঘের মতো হয়ে রয়েছে। বেশ কয়েক বার ছেলে-বউয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হল। বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম এটা সাময়িক, কেটে যাবে!
রাতেরবেলাটা আরও অনেক উইকএন্ডের মতো একটু দেরিতে ঘুমোতে গেলাম, প্রায় ১২টা নাগাদ। আরও অনেকের মতো, আমারও প্রাত্যহিক চরম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যায়। তাই হয়তো ঘুম নিয়ে আমার কোনও দিন সমস্যা নেই। তবে আজ যেন কিছুতেই ঘুম আসছে না। আমার গোটা পরিবার গভীর নিদ্রায়। কখন চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল। আমি স্বপ্নটপ্ন বিশেষ দেখি না, বা দেখলেও মনে থাকে না। আজ কেমন যেন... পুরো বিছানাটা ঘামে চুপচুপ করছে। কানের পাশের রগদুটো কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। ধু ধু মরুভূমির মধ্যে এক চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি। পাশে একটা হাত আমাকে প্রাণপ্রণে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। তার মুখটা কেমন আবছা। একটা অদ্ভুত আতঙ্ক আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ধীরে ধীরে ক্লোরোফর্মের মতো গ্রাস করছে। পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীকে ডাকার চেষ্টা করলাম। বেশ কিছু ক্ষণ হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইলাম। তা হলে কি প্রেসারটা বেড়েছে?
ধীরে ধীরে উঠে আমার স্টাডি রুমে এসে বসলাম। প্রেসার মাপার যন্ত্র দিয়ে দু’তিন বার মাপলাম। না! মোটামুটি আমার প্রেসারটা স্বাভাবিক। হঠাৎ করে চোখ গেল আয়নাটায়। অনেক দিনের না-কামানো দাড়ি। চুলগুলো বহু দিন কাটা হয়নি। অবিন্যস্ত দাড়ি-গোঁফ-চুলের মধ্যে প্রায় পুরোটাই সাদা। মুখে এক বিষাদগ্রস্থ আতঙ্কের ছাপ। কবীর সুমনের গানটা মনে এল, "এক মুখ দাড়ি গোঁফ, অনেক কালের কালো ছোপ ছোপ… "। কেমন একটা ভয় করতে লাগল, তা হলে আমিও কি… । কম্পিউটার অন করে, ভাবলাম গান শুনি, কানের পাশে হাতুড়ির শব্দটা আরও যেন জোরালো , চোখের সামনে কিছু ছোট ছোট পোকা। কোনও গানই ভাল লাগল না। কমেডি মুভিজ দেখার চেষ্টা করলাম। না, কিছুই ভাল লাগছে না। কেমন এক চরম অস্থিরতা। মনে পড়ল, প্রবাসী বন্ধু চার-পাঁচ দিন আগে মেসেজ পাঠিয়েছিল— ও করোনা-আক্রান্ত। মাথার মধ্যে একগাদা অসংলগ্ন চিন্তার ভিড়। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘Social Element’ আমি, বহির্মুখী চরিত্র। বেশ কিছু দিন ধরে মানুষের সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন। হঠাৎ করে পরিচিত সেই দু চারটে মুখের বাইরে আর কোনও মানুষ না দেখতে পেয়ে হয়তো মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। অনেক আগে ‘The Diary of Anne Frank’ পড়েছিলাম। ভাবলাম, দেখি আর এক বার পড়ে। এ বার কানের কাছে হাতুড়ির আওয়াজটা একটু যেন কম। চোখের সামনের পোকাগুলো এখনও বিচ্ছিন্ন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। অফিসের ল্যাপটপ খুলে ‘Employee Assistance Program’-এর নম্বরটা নিলাম। সৌভাগ্যবশত আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তাতে কর্মী ও তাঁদের পরিবারের জন্য এই সুবিধাটা রয়েছে। আমরা ২৪x৭ ওদের (Third Party Organization) ফোন করে বা অনলাইনে নিজেদের ব্যক্তিগত যে কোনও শারীরিক বা মানসিক সমস্যার জন্য পেশাদারি পরামর্শ নিতে পারি। আমাদের কোনও পয়সা দিতে হয় না; সবটাই কোম্পানি থেকে প্রিপেড। নম্বরটা মিলিয়ে ডায়াল করার আগে একটা অহং বোধ মাথায় চারা দিল। আমার পরিচিত পরিজনদের মাঝে আমি নিজেই পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত, আমাকেও... ?
হঠাৎ করে খেয়াল যায় বাইরের দিকে। অনেকটা সময় চলে গিয়েছে। ফিকে সূর্যের আলোয় ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। রাস্তার আলোগুলো এখনও জ্বলছে। একটু ঠাণ্ডা হাওয়া, হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, সব পোকাগুলো ভ্যানিশ। কানের কাছে আওয়াজটাও অনেকটা কম।
কত ক্ষণ সে ভাবে কেটেছে জানি না। দেখলাম ঘড়িতে এখন ৬ট ৩৭। শেভিং কিট নিয়ে বসে পড়লাম। এখনও পরিবার ঘুমোচ্ছে। তার পর বাথরুমে অনেক ক্ষণ। বডি স্প্রে আর আফটারশেভ লোশন লাগিয়ে এখন মনটা অনেকটা শান্ত। প্রায় দু’সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। হয়তো সামাজিক প্রয়োজনীতা নেই বলেই বেশ কিছু অভ্যাস উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছিল। বুঝলাম জীবনে রুটিনটার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
নিজের, বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাগুলো দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতে থাকি আগের রাতটাকে। মনে হল, একঘেয়েমি এবং পৌনঃপুনিকতার একটা সার্বিক ক্লান্তি আমাকে গ্রাস করেছিল। এটা থেকে বেরতে হবে। দুটো অনলাইন কোর্স-এ সাবস্ক্রাইব করলাম। একটা রুটিন তৈরি করলাম। আমার প্রতি দিন অফিস কমিউট টাইম প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। তাই প্রতি দিন ন্যূনতম আমি চার ঘণ্টা দিতে পারি, এই কোর্সগুলোতে। প্রথম কোর্সটাতে পর পর দুটো এসাইনমেন্ট ১০০ শতাংশ। বেশ খুশি খুশি মনে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। সৌভাগ্যের কথা, আগের রাতের বিভীষিকা ফিরে আসেনি।
করোনাতে ক্লান্ত আমার সমস্ত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলো মিউট করা। রুটিনটা বেশ ভাল সেট হয়ে গিয়েছে আমার। আমার টিমের সঙ্গে সম্প্রতি ভিডিয়ো কল শুরু করেছি। এটা খুব আনন্দদায়ক। ওদের অভিব্যক্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করি; আশা-আক্ষাঙ্খা-সুবিধে-অসুবিধেগুলো বোঝার চেষ্টা করি। আমার তো ওদের কাছে রোল মডেল হওয়ার কথা। জানি না আমি পারছি কি না? যাই হোক, সর্বোপরি এখন আমার কাছে একদম সময় নেই। সেই আগের মতোই ব্যস্ততা। রাতের ঘুমের সমস্যাটা প্রায় নেই।
আমি যেটা হৃদয়ঙ্গম করেছি, এই রকম একটা সময়ে, এই বন্দিদশায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা সবচেয়ে ভাল উপায়। পজিটিভ কোনও এনগেজমেন্ট খুঁজে বার করতে হবে। সেটা কারও হবি, কিছু জমানো ইচ্ছে, অথবা নিজের প্রফেশনাল লাইফ আরও বেটার করার জন্য যদি কিছু করা যায়, তা হলে সবচেয়ে ভাল। শুধু এনগেজমেন্ট নয়। লক্ষ্য ঠিক করে নেওয়াটাও বাঞ্ছনীয়। ছুটতে হবে সেই লক্ষ্যের দিকে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর ফের নতুন লক্ষ্য স্থির করতে হবে।
ভাবলাম, আমার এই অভিজ্ঞতাটা, আমার এই জ্ঞানার্জনটা হয়তো আরও অনেকের কাজে লাগতে পারে, তাই শেয়ার করা।
যুদ্ধটা সে দিন আমারই ছিল। সেই ভয়ঙ্কর রাতের যুদ্ধটা। সামনের যুদ্ধটা কিন্তু আর আমার একার নয়। সেটা আরও কঠিন। আমার-আপনার, আমাদের সকলের। আরও কয়েকটা দিন বা সপ্তাহ। আমার মনে হয়, সেদিনের আমার স্বপ্নটা ছিল প্রতীকী। ওই চোরাবালিতে শুধু আমি নই, আমি-আপনি বা সমগ্র মানব জাতি রয়েছে। আর পাশের সেই হাতটা যেটা আমাকে প্রাণপ্রণে বাঁচাতে চাইছিল, তা হল আমাদের চেতনা। আর এই যুদ্ধটাই শেষ যুদ্ধ। আমাদের কাছে জেতা ছাড়া আর কোনও পথ নেই।
তাই মেনে চলি কিছু শৃঙ্খলা, কিছু কর্তব্য। সহায়তা করি আমাদের সেই ভাইবোনেদের যাঁরা নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে আমাদের বাঁচাচ্ছেন। ডাক্তার, নার্স, সোশ্যাল ওয়ার্কার, পুলিশ, এবং আমাদের সংবাদমাধ্যম। তাঁদের সেলাম!
পত্রলেখক বেঙ্গালুরুতে একটি বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)