সোশ্যাল মিডিয়া যত ক্ষণ ‘সোশ্যাল’, তত ক্ষণ নিরাপদ, কিন্তু সীমানা লঙ্ঘন করাই তার স্বভাব। এই মুহূর্তে যেমন করোনাক্রান্ত মানববিশ্বে কত দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াকে! চিকিৎসাবিজ্ঞান যে কথা এখনও জানে না, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ তা জেনে ফেলেছে! আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, দেশের গোপন সামরিক কর্মকাণ্ড— এ সবও তার নখদর্পণে। সবচেয়ে বেশি জানে করোনার ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান...
অথচ তাচ্ছিল্য করে এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে বিশ্ব এখন আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয়। অজানা উৎসের সংবাদ, অচেনা কণ্ঠের বার্তা, অদেখা স্থির বা চলমান ছবি তরঙ্গসম আছড়ে পড়ছে আমাদের মতো খবরলোভী মানুষের মধ্যে। সেই আমরা, যাদের খবরের চেয়ে না-খবরের দিকেই অধিকতর মনোযোগ। সেই আমরা, যারা চমকে উঠতে ভালবাসি এবং সেই চমকের ভাগ অতি দ্রুত ছড়িয়ে দিতে চাই চেনা-অচেনা সবাইকে। কখনও সামাজিক কল্যাণের শর্ত চাপাই, কখনও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচ্ছন্ন ভয় দেখাই। এমনি করে সোশ্যাল মিডিয়া আজ চমক দিয়ে ‘ঘুম ভাঙানিয়া’র বদলে ক্রমশ পরিণত হতে চাইছে ‘দুখ জাগানিয়া’য়।
এক সময় রেডিয়োর জায়গা কেড়ে নিয়েছিল টেলিভিশন; আজ রেডিয়ো টিভি কাগজ সবাইকে টেক্কা দিয়ে লাগামহীন সোশ্যাল মিডিয়া বহুরূপে সম্মুখে আমাদের। সেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকা খবরের ভিড়, সেখানে সাংবাদিকতার বিধি নেই, তবু আমজনতাকে মোহিত করে রাখার মতো খবর আছে। ‘পাবলিক’ জানতে চায় না, এটা কোন কাগজের খবর, বা সাংবাদিকটি কে? সমাজমাধ্যমের মধ্যে বেশ একটা ‘মাফিয়া-মাফিয়া’ গন্ধ আছে। অজানা গোপন উৎস থেকে উঠে আসছে খবর, বেশ একটা নিষিদ্ধ জগতের হাতছানি। তাই টানে বেশি। আর যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও দায় নেই, কারও নিয়ন্ত্রণ নেই তার উপরে, ভুয়ো সংবাদ আর গুজবকে ‘খবর’ করে তোলার জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, তাই তার লাগামহীন সংবাদ বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
এক সময় মনে হত, মোবাইল ফোন ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করার আগেই যন্ত্রটি এসে গেছে আমাদের নাগালে। আজ মনে হয়, সোশ্যাল মিডিয়াও যথাসময়ে যোগ্য হাতে পড়েনি। তাই এত ভুল-ধারণা-ছড়ানো, ভুয়ো খবর। বোধহয় সমাজমাধ্যমেরও একটা ‘লকডাউন’ দরকার, খুব শিগগিরই। হাত পাতব প্রযুক্তির কাছেই। শুভবোধ আর শিক্ষা যখন মাথা তুলতে পারছে না, প্রযুক্তি এগিয়ে এসে একটা নিয়ন্ত্রণরেখা এঁকে দিক, যাতে ভ্রান্তির মুখে লাগাম টানা যায়।
প্রবীর সরকার
পুরুলিয়া
আগেভাগে
ইংল্যান্ডে আট বছর ডাক্তারি করছি, আমি এক জন ‘চেস্ট ফিজ়িশিয়ান’। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে এসেছিলাম আমার প্রথম পিতৃত্বকালীন ছুটিতে। ১৪ দিনের মাথায় ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে, তত ক্ষণে জেনে গেছি ইংল্যান্ড করোনাভাইরাস-আক্রান্ত, অনেকে সেলফ-আইসোলেশনে আছেন।
যে হেতু আমার কোনও উপসর্গ ছিল না, আমি ইংল্যান্ড যাাত্রা করলাম ১৪ মার্চ। দেখলাম, কলকাতা এয়ারপোর্টে সবাই মাস্ক পরে ঘুরছে, দুবাই এয়ারপোর্টেও তা-ই, এর পর ম্যানচেস্টারের প্লেনে চিত্রটা একেবারে আলাদা।
কেউ মাস্ক পরে নেই। কারও হাতে স্যানিটাইজ়ারও নেই। ইংল্যান্ডের রাস্তাঘাটেও সব স্বাভাবিক, কেউ কোনও সতর্কতাই অবলম্বন করছেন না। ট্রেনেও কোনও সতর্কবাণীর ঘোষণা হল না।
পরের দিন হাসপাতালে গেলাম। তত ক্ষণে আমাদের সাত জন সহকর্মী ডাক্তার ‘সেলফ-আইসোলেশন’এ চলে গিয়েছেন। আমার ‘আর্জেন্ট মাস্ক টেস্টিং’ হল, তার পর আমার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে কি না, দেখতে পাঠানো হল। তখনও সাসপেক্ট করোনা পেশেন্ট নর্মাল ওয়ার্ড-এর একটাই ঘর। টেস্ট রিপোর্ট আসতে সময় সময় লাগে। এর পর সংখ্যাটা বাড়তে লাগল হু-হু করে।
হাসপাতাল দুটি ভাগে ভাগ হল। এক দিকে ‘সাসপেক্ট অ্যান্ড করোনা’ রোগী, অন্য দিকে বাকি রোগীরা। হাসপাতালে ঢোকার দুটি মুখ করে দেওয়া হল। ঢোকার মুখেই রোগীদের দেখে ঠিক করা হল, তিনি কোন ভাগে যাবেন। আমার সপ্তাহান্তে রোজ ১৩ ঘণ্টার শিফট চলল। বেশ কিছু রোগীর মৃত্যু হল। ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্ট প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিল। ক্যান্টিন সাধারণের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
তাই মনে হয়, কিছু দিন আগে থেকে ইংল্যান্ডের সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। তা হলে হয়তো এতটা সংক্রমণ হত না। ভারত অনেকটা আগে সতর্ক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সতর্কতা ঠিক ঠিক বজায় রাখা হচ্ছে কি? বা, সকলেই সমান সতর্ক কি? না কি, কয়েক জনের মধ্যে একটা আলগা মনোভাব দেখা যাচ্ছে? এ সব বিষয়ে খেয়াল রাখতেই হবে, না হলে, ভারতকেও এ ভাবেই মাশুল দিতে হতে পারে।
মিলন বারিক
পিন্ডারফিল্ড হাসপাতাল
প্রমথনাথ
আবাহন দত্ত লিখিত ‘খনিজের সন্ধানে ঘুরেছেন বাংলা থেকে মায়ানমার’ (রবিবাসরীয়, ১৫-৩) শীর্ষক নিবন্ধের প্রেক্ষিতে এই চিঠি। ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রমথনাথ বসুর বিষয়ে আলোচনার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। তবে প্রমথনাথ বসু সম্পর্কে গবেষণায় এবং চর্চায়, দীপককুমার দাঁ-র সঙ্গে, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সুবীরকুমার সেন-এর (১৯৪৭-২০১৩) নামও সবিশেষ উল্লেখ্য। সুবীরবাবু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। এ ছাড়া তাঁর বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও প্রমথনাথ বসুর গবেষণা ও লেখালেখির বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন।
প্রমথনাথের জীবন ও বাংলা ভাষায় লেখালেখির উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক হল, ‘প্রমথনাথ বসু: বাংলা রচনা সংকলন’ (প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, ২০০৮)। এই বইটি শ্রীদাঁ ও শ্রীসেন যুগ্ম ভাবে সম্পাদনা করেছিলেন। এই বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে, সুবীরবাবুর এক ছাত্র ও বর্তমানে বর্ধমানের চন্দ্রপুর কলেজের গ্রন্থাগারিক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকাও স্মর্তব্য।
প্রমথনাথের উপরে সুবীরবাবুর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, প্রমথনাথের আত্মজীবনীমূলক পুস্তক ‘রেমিনিসেন্সেস অ্যান্ড রিকালেকশনস অব আ সেপটুয়াজেনিরিয়ান: ফ্রম অমৃত বাজার পত্রিকা, ১৯৩১-১৯৩৪’ (সুবীরকুমার সেন মেমোরিয়াল কমিটি, ২০১৩) সংকলন ও সম্পাদনা করা। নিজের মেয়েকে লেখা প্রমথনাথের একটি চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, এই লেখাগুলি তিনি নিজেই একটি পুস্তকাকারে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন পুস্তক ও প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও সুবীরবাবু ভারতে সায়েন্টোমেট্রিক্স ও ইনফর্মেট্রিক্স গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। এ ছাড়াও বহু দিন অমুদ্রিত থাকার পর জেবিএস হ্যালডেন-এর ‘সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডিয়ান কালচার’ (নিউ এজ, ২০১৪) পুস্তকটির একটি নতুন সংস্করণ সম্পাদনা করে প্রকাশ করার কৃতিত্বও তাঁর।
তবে বাঙালির প্রমথনাথ বিষয়ক বিস্মৃতির পাশাপাশি আশ্চর্যের বিষয়, প্রমথনাথ সম্পর্কে সমকালীন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের নীরবতা; যদিও তাঁরা তাঁকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিনতেন, জানতেন এবং তাঁর সঙ্গে অনেকে কাজও করেছেন। উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসুর নাম করা যায়। তবে প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর আত্মজীবনী ‘লাইফ অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্সেস অব আ বেঙ্গলি কেমিস্ট’-এ প্রমথনাথের লেখা ‘স্বরাজ— কালচারাল অ্যান্ড পলিটিকাল’ বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, প্রফুল্লচন্দ্র সেখানে প্রমথনাথকে ‘আ বেঙ্গলি রাইটার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মাত্র।
শুক্লা চক্রবর্তী, শিলাদিত্য জানা
কলকাতা-৫০