ডায়েরি লিখতাম সেই কিশোর বয়সে। বয়স যত বেড়েছে সময় যেন হাত থেকে পিছলে পিছলে গিয়েছে। বেড়েছে দায়িত্ব, এসেছে প্রযুক্তি। এই যে আমি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ছোট্ট এমস শহরে বসে ডায়েরি লিখছি, তার পেছনে কম পরিশ্রম আর কম সংঘর্ষ নেই , নিঃসন্দেহে। তবুও আজ, হোয়াটস্যাপের হাতছানি, নেটফ্লিক্স এর দাপানি, উপেক্ষা করেও যে ডায়েরি নিয়ে বসা, সেটা কি নিছকই অপ্রাসঙ্গিক?
এই সেদিনও যখন আমাদের স্প্রিং ব্রেক এর ছুটি পড়ল। ডিন এসে বলে গেলেন, ছুটিটা আরও ১৫ দিনের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হল তবে সব কাজকর্ম অনলাইনে চলবে। তখনই কি ভেবেছিলাম যে সে-ই হবে আমাদের কলেজের শেষ দিন? কলেজের বন্ধু, অধ্যাপক, সহপাঠী, কারও সঙ্গে আর সামনাসামনি দেখা হবে না? এমনকি গ্র্যাজুয়েশন সেরেমনি পর্যন্ত হবে না?
সেই ১৫ দিন কাটার আগেই এই মহাপ্রদেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ল সেই ভয়ঙ্কর ভাইরাস। তার সঙ্গে পৃথিবী জুড়ে আসতে থাকা দুঃসংবাদ তো রয়েছেই। একে একে বন্ধ হতে থাকল সমস্ত স্কুল, কলেজ, অফিস, রেস্তরাঁ। বাতিল হতে লাগল একের পর এক অনুষ্ঠান। ছোট্ট, ছিমছাম, সিনেমার মতো সাজানো শহরটা যেন এক নিমেষে বদলে গেল জনমানবহীন পরিত্যক্ত আস্তানায়। বসন্ত এল, ফুল ফুটল, কিন্তু কেউ দেখতে এল না, ঠিক যেন সেই ‘সেলফিশ জায়ান্ট’ এর বাগান, সুন্দর কিন্তু কেউ সাহস করে না পা বাড়াতে।
আরও পড়ুন: এ ভাবে ঘরবন্দি হয়ে আতঙ্কে দিন কাটাতে হবে, কোনও দিন ভাবিনি
ইউনিভার্সিটি চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখছে না। গ্র্যাজুয়েশনের জন্য গান গেয়ে ভিডিয়ো বানিয়ে তুলে পাঠাতে বলছে। তবে দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে! যে মেয়েটি তিন বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে করতে ভেবেছিল, এ বার শেষ সেমেষ্টারটায় একটু আনন্দ করবে, কনফারেন্স এ গিয়ে পেপার প্রেজেন্ট করবে, ফ্যাশন শোয়ে শো তে অংশগ্রহণ করবে, নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নেবে, একে একে সব স্বপ্ন ভেস্তে গেল। অনিশ্চিত থেকে চরম অনিশ্চয়তার পথে চলতে লাগল সমাজ, বিশ্ব, চরাচর। এই মুহূর্তে মাথার ওপর একটি ছাদ, দু’ মুঠো ভাত আর সুস্থ শরীর, এই কামনায় পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশগুলি যুঝে চলেছে।
এ দেশে এখন চাকরি নেই, দেশ ছেড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই, চাকরি ছাড়া এ দেশে বেশি দিন থাকার অনুমতিও নেই। যে মেয়েটা মুখে রক্ত তুলে খেটেছিল একটা চাকরির আশায়, সেই চাকরি পাওয়ার পরও একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস এসে যখন সব তছনছ করে দিয়ে যায়, তখন কী প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিকতায় কোনও ঘটনার বিচার করা যায়? যে জানলার সামনে বসে মেয়েটা স্টাডি ফ্রম হোম করে, কোনও কোনও দিন যখন সারাদিনে একটি মানুষেরও টিকি দেখা যায় না, সে জানলার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের ভয়াবহ চেহারা ফুটে ওঠে। সেই মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্লাভস আর মাস্ক পড়া মানবজাতি। তখন আর সে নিজের অপারগতাকে বড় করে দেখতে পারে না। মনে হয়, না, করোনাগ্রস্তদের চেয়ে ভালই আছি। মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকা, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখা মানুষগুলোর চেয়ে ভালো আছি।
আরও পড়ুন: মনে খালি প্রশ্ন আসে, কবে যেতে পারব কলকাতায়?
কিন্তু তার পরেই মনে পড়ে আমার নিজের দেশের কত শত দিন আনি দিন খাই লোক হয়ত প্রতিদিনের খাবারটুকুও উপার্জন করে উঠতে পারছেন না। তাতে বুকটা আবার ভারি হয়ে ওঠে। এই অনিশ্চয়তার জীবনে প্রতিদিন নিজের সঙ্গে লড়াই চলে। আজকাল এই অনিশ্চয়তার সময়গুলো, যখন আমি লিখছি আর আপনি পড়ছেন, তার মাঝখানে কতগুলো মানুষ মারা গেল তা জানতেও পারছি না। আমরা একটু একটু করে বোধহয় সামাজিক রীতিনীতিগুলি ভাঙতে শুরু করি। নিজেকে একটু একটু করে হারাতে শুরু করি। জীবনের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে হারাতে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করি। আর সেখানেই শুরু হয় আমাদের আসল পরীক্ষা। করোনা তো একটা অজুহাত মাত্র, সামনে আসতে চলেছে এক নিয়ন্ত্রণহীন কুরুক্ষেত্র।
দেবাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)