‘ভাষা সংঘাত’ (১০-৩) সম্পাদকীয়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে কিছু ভাবনা সংযোজন করার উদ্দেশ্যে এই পত্রের অবতারণা। ভারতে এখনও প্রচলিত ৭৮০টি ভাষা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে পিপল’স লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া (পিএলএসআই)। এবং আগামী সাড়ে চার দশকে প্রায় অর্ধেক ভাষার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোনও কোনও ভাষায় ৫০ জনেরও কম মানুষ কথা বলেন। হয়তো অচিরেই এই ভাষাগুলি হারিয়ে যাবে দেশ থেকে। যেমন, সাম্প্রতিক কালে হারিয়ে গিয়েছে ‘বো’ ভাষা। আন্দামানে শেষ যে মানুষটি ‘বো’ ভাষায় কথা বলতে পারতেন, তাঁর মৃত্যু হয় ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি। কবি সুবোধ সরকারের কথায়, “আজ বোয়া মারা গেল/ তার মৃত্যুর সঙ্গে মারা গেল একটা ভাষা/ আমার খুব ভয় করছে, খুব ভয় করছে আমার/ একদিন বাংলাও কী এভাবেই মারা যাবে, বোয়া?”
ভারত একটি বহু ভাষাভাষীর দেশ। ভারতীয় সংস্কৃতিকে বৈচিত্রপূর্ণ রূপ দিতে এই সব ভাষা এবং উপভাষাগুলির ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও মাত্র ২২টি ভাষা সংবিধান স্বীকৃত এবং আরও ৩৮টি ভাষা স্বীকৃতির অপেক্ষায় দিন গুনছে। আমাদের দেশে জাতীয় ফুল আছে, জাতীয় পাখি আছে, জাতীয় পশু আছে, জাতীয় পতাকা আছে, জাতীয় সঙ্গীত আছে, অথচ জাতীয় ভাষা নেই। হিন্দি এবং ইংরেজি এ দেশে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভারতের সংবিধান রচিত হয়েছিল ইংরেজিতে। ভাবা হয়েছিল ২৬ জানুয়ারি, ১৯৬৫-র পর থেকে ইংরেজি ভাষাকে সরিয়ে দেবনাগরী হরফে লিখিত হিন্দি ভাষাই ভারতের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে। কিন্তু যত বারই কেন্দ্রীয় ভাবে সেই প্রচেষ্টা প্রকাশ্যে এসেছে, তত বারই রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘর্ষের বাতাবরণে তা আর হয়ে ওঠেনি। বলা বাহুল্য, ভারতের প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা হিন্দি। তাই ছলেবলে অবশিষ্ট ভারতবাসীর উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালেও ছিল, এখনও আছে। অথচ, শ্রীলঙ্কার তামিল অধিবাসীদের উপরে জোর করে সিংহলি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার পরিণতিতে কী ঘটেছিল তা সকলেরই মনে আছে। তেমনই পূর্ব পাকিস্তানে জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার পরিণতিতে পাকিস্তানের মানচিত্রটাই বদলে গিয়েছিল। অনুমান করা যেতে পারে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশেও সে রকম ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই ভারতের কোনও শাসকই সরাসরি প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে সাহস পান না। কিন্তু হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল জারি রাখতেও পিছপা হন না।
অরুন্ধতী রায়ের আজাদি গ্রন্থ থেকে দু’টি লাইন ধার করে বলা যায়, “...উই ইন ইন্ডিয়া লিভ অ্যান্ড ওয়ার্ক (অ্যান্ড রাইট) ইন আ কমপ্লিকেটেড ল্যান্ড, ইন হুইচ নাথিং ইজ় অর এভার উইল বি সেটেলড। স্পেশালি নট দ্য কোয়েশ্চেন অব ল্যাঙ্গুয়েজ।”
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
ব্যয়বহুল শিক্ষা
‘বেসরকারি স্কুলে ফি বৃদ্ধি: রাশ চায় রাজ্য’ (১২-৩) সংবাদে প্রকাশ বেসরকারি স্কুলের ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে অভিভাবকদের ক্ষোভের প্রসঙ্গে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন যে, বেসরকারি স্কুলের পঠনপাঠনের মান যথেষ্ট ভাল। কিন্তু তাদের ফি বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাজ্য সরকার একটি বিল আনার কথা ভাবছে। উদ্দেশ্য সাধু সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল অন্তত শহরাঞ্চলে যথেষ্ট সংখ্যক সরকারি স্কুল থাকা সত্ত্বেও সন্তানদের নিয়ে বহু অভিভাবক প্রচুর ব্যয় করে বেসরকারি স্কুলে ছুটছেন কেন? শিক্ষামন্ত্রীও এ কথা বলতে পারলেন না যে, প্রচুর সরকারি স্কুল আছে। যে অভিভাবকরা বেসরকারি স্কুলের খরচ চালাতে পারছেন না, তাঁরা সন্তানদের সরকারি স্কুলে নিয়ে আসুন। এই না বলতে পারার কারণ কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, রাজ্যের সরকারপোষিত স্কুলগুলোর পঠনপাঠনের মান আশানুরূপ নয় বলে শিক্ষামন্ত্রীও মনে করেন? আর তা-ই যদি মনে করেন, তা হলে তার মূল দায় কার উপরে বর্তায়?
মুষ্টিমেয় ধনী পরিবারের সন্তানদের নামী ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর একটা ধারা দীর্ঘ দিন ধরেই রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ সন্তানকে ভাল করে ইংরেজি শেখানোর আগ্রহ এবং সাধারণ ভাবে সরকারি স্কুলের পড়াশোনার মান ভাল নয়— এমন ধারণা। বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে সরকার অনুমোদিত প্রাথমিক স্কুল থেকে ইংরেজি ও পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হয়। পরে ইংরেজি ফিরে এলেও বাম আমলের বেশ কিছু ইংরেজি পাঠ্যবই সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে, শিশু মনস্তত্ত্বের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে খেয়ালখুশি মতো রচিত হয়েছে।
সেই তুলনায় বরং সিবিএসই বা আইসিএসই পাঠক্রমের বইগুলো শিক্ষাদানের পক্ষে অনেক বেশি কার্যকর। অন্যান্য বিষয়ের বইয়েরও অবস্থা একই রকম। কাজেই, সামান্য সঙ্গতি আছে এমন অভিভাবক মাত্রেই সন্তানকে বেসরকারি এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই পড়াতে চান। আর, সরকারপোষিত স্কুলগুলি মূলত গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের স্কুল হয়েই থেকে যাচ্ছে। প্রচুর খরচ করে সন্তানকে যাঁরা বেসরকারি স্কুলে পড়াচ্ছেন, তাঁরা সন্তানের বাড়িতে পড়াশোনার বিষয়েও কড়া নজর রাখেন। অথচ, দরিদ্র পরিবারে স্বামী স্ত্রী উভয়কেই উদয়াস্ত গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা করতে হওয়ায় সন্তানের দেখভালের বিষয়টা ভয়ঙ্কর ভাবে অবহেলিত হয়। এমন অবস্থায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল না থাকায় সমস্যা আরও গুরুতর হয়েছে। গরিষ্ঠ অংশের পড়ুয়াদের মধ্যেই পড়াশোনা সম্পর্কে অনীহা তৈরি হচ্ছে এবং তা ক্রমশ অতিমারির মতো সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারপোষিত স্কুলগুলোতে শিক্ষক-সংখ্যা কমে যাওয়া, স্বল্প বেতনে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের দিয়ে পঠনপাঠনের কাজ চালানো, পরিকাঠামোর অভাব, অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার ইত্যাদি। এ ছাড়া, সরকারি নির্দেশেই প্রতি বছর ভোট, স্বচ্ছতা অভিযান, পরিবেশ রক্ষার জন্য গাছ লাগানো ইত্যাদি হরেক শিক্ষা বহির্ভূত কাজের জেরে স্কুলের স্বাভাবিক পঠনপাঠন ব্যাহত হয়। ভোট, পুলিশক্যাম্প প্রভৃতির জন্য স্কুলভবন অধিগ্রহণ করার ফলেও ওই দিনগুলোতে ক্লাস বন্ধ থাকে। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত সরকারপোষিত স্কুলগুলোতে সমস্ত শূন্যপদে শিক্ষক শিক্ষাকর্মী নিয়োগ হলে এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে পারলে সরকারপোষিত স্কুলকেই অভিভাবকরা অগ্রাধিকার দেবেন। বেসরকারি স্কুলে ছাত্রভর্তির ঢল বন্ধ হলেই তারাও ফি বাড়াবে না।
পার্থ ভট্টাচার্য, ভাটপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
সঠিক মূল্যায়ন?
‘আংশিক সময়ের শিক্ষকদের হাতে উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা’ (১২-৩) শীর্ষক খবরের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। এত কাল নিয়ম ছিল যাঁদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অন্তত তিন বছর পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরাই উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখতে পারবেন। কিন্তু বহু স্কুলে এ-যাবৎ শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় বা শিক্ষক না থাকায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদকে অগত্যা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক, প্যারা টিচার বা আংশিক সময়ের শিক্ষকদের দিয়েই খাতার মূল্যায়ন করতে হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবককুলের স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগ হতে পারে খাতার সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে। বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষক না থাকার জন্য শিক্ষা দফতর ‘বিশেষ পদ্ধতি’তে আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগের কথা বললেও সব স্কুলে তা মানা হয়নি। ফলে প্রশ্ন থেকে যায় সেই শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে। সে ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। এই প্রহসন আর কত দিন চলবে?
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪