শাশ্বত ঘোষ (‘বয়স্কদের খেয়াল রাখবে কে’, ৫-৮) লিখেছেন, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে, পশ্চিমবঙ্গে, মহারাষ্ট্রে ও পঞ্জাবে ইতিমধ্যেই সমাজের বৃহত্তর অংশের উপর বৃদ্ধদের দেখভালের ভার বৃদ্ধি পেয়েছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এই সমস্যা আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতে তা যে আরও তীব্র হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কোভিডের সময় থেকেই গত দু’বছর ধরে রেলযাত্রায় প্রবীণদের ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। সে চিকিৎসার জন্যই হোক, দূর রাজ্যে সন্তানের কাছে ক’টা দিন থাকার জন্য হোক, নিদেনপক্ষে বেড়াতে যাওয়ার জন্য হোক, ট্রেনে প্রবীণদের ছাড় মানে যেন দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত, অতএব তা পরিত্যাজ্য। অনেক পেনশন-প্রাপক এবং পেনশনহীন মানুষ ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজ়িটের সুদের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকার সমানে ব্যাঙ্কের সঞ্চয়ে সুদের হার হ্রাস করে চলেছে। অন্য দিকে, পেট্রল ও ডিজ়েলের মূল্য বৃদ্ধি করে প্রকারান্তরে সব জিনিসের দাম বাড়াচ্ছে।
বহু প্রবীণ পিতামাতার সন্তান থেকেও তাঁদের অসহায় অবস্থা, যৌথ পরিবার ভাঙার জন্য। আছে কিছু বৃদ্ধাশ্রম, তা-ও অর্থলোভী লোকেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ, সব দিক দিয়েই প্রবীণরা সকলের কাছে ‘বোঝা’। এ ক্ষেত্রে, প্রবীণদের সমস্যা তাঁদের নিজেদেরই মেটাতে হবে। পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে তাঁদের বাঁচতে হবে। তাঁরা ক্লাব, পার্ক বা নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় মিলিত হতে পারেন। সর্বজনীন পুজো, খেলাধুলোয় যোগ দিতে পারেন। সমাজমাধ্যমে পারস্পরিক কথা বলার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সূত্র আদানপ্রদান হতে পারে। সামাজিক সুরক্ষাও মিলতে পারে।
তপন কুমার দাস, কলকাতা-১২২
শাসকের মন
শাশ্বত ঘোষের প্রবন্ধ পড়ে বোঝা গেল, বয়স্কদের নিজেদেরই খেয়াল রাখতে হবে। বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্তদের জীবনে সামাজিক সুরক্ষা শিথিল হয়েছে। মাথায় ছাতার মতো সেই রাষ্ট্র নেই, সমাজও নেই। আগামী প্রজন্ম অস্বাভাবিক দ্রুত জীবন, অস্থায়ী জীবিকা নিয়ে হাঁসফাঁস করছে। বয়স্কদের দেখার সময় নেই।
প্রবন্ধে কিছু আশার দিক আছে। যেমন, ২০৫০ নাগাদ বিশ্বজনীন গড় আয়ু বেড়ে ৭৭.২ বছর হবে। উন্নত বিশ্বে মানুষের এই গড় আয়ু বৃদ্ধি কিছুটা সার্থক, কারণ সেখানে বয়স্করা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত করে, রাষ্ট্র ও সমাজের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অনেকটাই দূষণমুক্ত পরিবেশে দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকেন। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে অধিকাংশ মানুষ টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। বর্তমান প্রজন্মের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যেও এ দেশে রাষ্ট্রীয় ব্যয় খুবই কম। তা হলে বয়স্কদের সেই দায় এসে যায়, প্রথমত নিজেদের জন্য ভাবতে হবে, দ্বিতীয়ত আগামী প্রজন্মকে ভাবতে শেখাতে হবে।
বয়স্করা বর্তমানে সমাজের প্রতি ঋণশোধ, বা নিজস্ব মানবিক উৎকর্ষের তাগিদে সামাজিক নানা দায় গ্রহণ করছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে এ ব্যাপারে সাংগঠনিক রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ১৯৮২ সালে ভিয়েনা ‘ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান ফর অ্যাকশন অন এজিং’ অনুযায়ী ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল। যার ফলে, ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত (রেজ়লিউশন ৪৫/১০৬) নেওয়া হল যে, প্রতি বছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হবে। কিন্তু রাষ্ট্র এর প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করে যাচ্ছে।
প্রবন্ধে উল্লিখিত ২০২১-এর ‘ইন্ডিয়া স্কিল রিপোর্ট’ ও ২০১৯-এর ‘ন্যাশনাল এমপ্লয়বিলিটি রিপোর্ট’ অনুযায়ী স্পষ্ট, আগামী দিনে বয়স্করা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে অনেকটাই পিছিয়ে পড়বেন। জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, লিঙ্গ অসাম্য ইত্যাদিতে জর্জরিত মহিলারা আরও বিপন্ন হবেন। আধুনিক জীবনে এক দিকে ভোগবাদের বিপুল আয়োজন, অন্য দিকে ক্রয়ক্ষমতার ক্রমহ্রাস জীবনকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সঙ্কটে ফেলেছে। আধুনিক প্রজন্ম এই দুষ্টচক্রে পড়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। বেকারত্ব ও ছদ্মবেকারত্ব বাড়ছে, সৃষ্টি করছে মনের অসুখ। এরাও এক দিন বয়স্ক হবে।
প্রবন্ধে উল্লিখিত জাতীয় জনসংখ্যা নীতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, কিন্তু এই নীতি তো প্রতি দশ বছর জনসুমারির কার্যক্রমেই নিহিত। এই সব নীতি নির্মাণ, রূপায়ণ ও প্রণয়নে বয়স্করাই অভিজ্ঞ পরামর্শ দেন। কিন্তু তার আগে দেখা যায় সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে অসরকারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের সংখ্যাতত্ত্বে বিস্তর গরমিল। রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক শাসক দল— তাদের কি মন নাই?
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
আড়ালে নিগ্রহ
প্রবীণদের হালহকিকত জানাতে সম্প্রতি একটি অসরকারি সংস্থার সর্বভারতীয় সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। আর্থিক বিষয়ে সমীক্ষা বলছে, বয়স্কদের ৭০ শতাংশ পেনশন ও পারিবারিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। বৃদ্ধদের ৫৭ শতাংশের আয়ের থেকে ব্যয় বেশি, ৪৫ শতাংশের পেনশন যথেষ্ট নয়, ৩৮ শতাংশের কাজের অনিশ্চয়তা আছে, ৩ শতাংশ সরকারি সাহায্য পান। কোনও আয় নেই ৩ শতাংশ প্রবীণের। স্বাস্থ্যসমীক্ষার হিসাব, ৬৭ শতাংশ প্রবীণের স্বাস্থ্যবিমা নেই। রিপোর্টে বয়স্কদের জন্য বাসস্থান ও লোকালয় সন্নিকটে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে চিকিৎসার আর্জি জানানো হয়েছে। বয়স্কদের পরিচর্যা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিষয়ে সমীক্ষা জানিয়েছে, ৮১.৭ শতাংশ বয়স্ক পরিবারের সঙ্গে বাস করলেও ৭৯ শতাংশ বয়স্ক জানিয়েছেন পরিবারের লোকেরা তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটান না। এ ছাড়াও একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে, নিঃসঙ্গতায় দিন কাটছে ৫.৪ শতাংশ প্রবীণের।
পরিবার, দেশ ও দশের স্বার্থে যাঁরা জীবন কাটিয়েছেন, বাকি সময় যথাযথ মর্যাদা তাঁদের প্রাপ্য। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে প্রায় ১৪ কোটি প্রবীণ কী পেলেন? ২০০৭ সাল থেকে কেন্দ্রীয় ভাগের বার্ধক্যভাতা ২০০-৫০০ টাকায় দাঁড়িয়ে আছে। বিপিএল তালিকাভুক্ত পাঁচ কোটি দশ লক্ষ প্রবীণের মধ্যে মাত্র ১৬,২৯০ জন সরকারি বৃদ্ধাবাসে স্থান পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, সুষম খাবারের অভাবে ২৭% প্রবীণ ওজন ঘাটতি ও ২২ শতাংশ বাড়তি ওজনের কারণে রোগে ভুগছেন। প্রবীণ নিগ্রহের ঘটনাও বাড়ছে। পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য নিগ্রহের সব ঘটনা জনসমক্ষে আসে না। প্রবীণ সুরক্ষার দায় শুধু সরকারের নয়, দেশবাসীরও।
অতীশ ঘোষ, মাখলা, হুগলি
চাঁদার জুলুম
দুর্গোৎসব ২০২২-এর জন্য দিন গোনা শুরু। ‘পুজো আসছে’ কথাতে খুশির ছোঁয়া লাগলেও, মফস্সল শহরে যেখানে চাঁদা-নির্ভরতায় পুজো হয়, সেখানে মধ্যবিত্তের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কারণ, চাঁদার অঙ্ক। যে পাড়ায় এক লক্ষ টাকা চাঁদা তুলতে জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যায়, সেখানে পুজো বাজেট নির্দিষ্ট হয় পাঁচ গুণ। ফলে, অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ নয় এমন অঞ্চলের কতিপয় মধ্যবিত্তের ঘাড়ে ঝুলতে থাকে বড় অঙ্কের চাঁদার খাঁড়া। পরিবারের এক জনের দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত গৃহকর্তা বাড়ি বিক্রি করে চলে যাওয়ার সময়েও মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, এমন সংবাদও কানে এসেছিল। বর্তমানে মানুষ আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাই চাঁদা-নির্ভরতা কমিয়ে, কম বাজেটে মাতৃ আরাধনা হোক হৃদয়ের রঙে, আবেগের ভাষায় সমৃদ্ধ হয়ে।
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা