সম্পাদক সমীপেষু: ভাষা ও জাতপাত

দ্বিতীয় বার সংস্কৃত নিয়ে আবার পড়তে গেলে, কলেজগুলি আর মুসলমান ছাত্রটিকে ভর্তি নিতে রাজি হল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০২
Share:

—ফাইল চিত্র।

শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার জন্য অধ্যাপক ফিরোজ খানকে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে কিছু সঙ্কীর্ণ মানসিকতার পড়ুয়া (‘সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের যোগ কোথায়’, ২০-১১)। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বাংলার স্বনামধন্য ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা। প্রথমে তিনি সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন হুগলি কলেজে, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য সে বার পরীক্ষা দেওয়া হয়ে উঠল না।

Advertisement

দ্বিতীয় বার সংস্কৃত নিয়ে আবার পড়তে গেলে, কলেজগুলি আর মুসলমান ছাত্রটিকে ভর্তি নিতে রাজি হল না। অবশেষে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে তিনি কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার সুযোগ পেলেন এবং সকলকে অবাক করে দিয়ে বেদে সর্বোচ্চ নম্বর পেলেন। এমএ-তে ভর্তি হলেন। কিন্তু পণ্ডিত অধ্যাপক সত্যব্রত সামশ্রমী, এমএ ক্লাসে শহীদুল্লাহকে মেনে নিতে পারলেন না। যবন ছাত্রকে পড়াবেন না বলে জেদ ধরে বসলেন। আশুতোষ অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু কাজ হল না। তখন আশুতোষ শহীদুল্লাহকে শব্দবিদ্যা নিয়ে পড়ার পরামর্শ দিলেন। বাধ্য হয়ে শহীদুল্লাহ তাই মেনে নিলেন এবং পরে বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি, ওড়িয়া, তামিল, গ্রিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে কৃতিত্বের পরিচয় দিলেন।

ফিরোজ খানকে বিএইচইউ-তে অধ্যাপনায় বাধায় ইতিহাসের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল যেন, শুধু ইনি শিক্ষক, শহীদুল্লাহ শিক্ষার্থী।

Advertisement

এখন আমাদের রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সংস্কৃত ভাষা

ও সাহিত্যে অসংখ্য মুসলমান ছাত্রছাত্রী অনার্স, এমএ করেছেন এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করছেন। অনেক মাদ্রাসাতেও সংস্কৃত পড়ানো হয়। আসলে আরবি, সংস্কৃত— এগুলো এক একটা ভাষা, যেগুলির সাহিত্যভাণ্ডার নানা মণিমাণিক্যে পূর্ণ।

আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, আলিবাবা ও চল্লিশ চোর, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, মেঘদূত প্রভৃতি কাহিনি বা কাব্যগুলি, ভাষার ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের কাছে আজও সমান জনপ্রিয়।

ফিরোজ আলি কাঞ্চন

গলসি, বর্ধমান

গোলাপি শান্তি

ইডেন গার্ডেন্সে গোলাপি বলের ঐতিহাসিক টেস্ট নিয়ে আমরা এখন উদ্বেলিত। ধরে নেওয়া যায় অন্তত তিন দিন খেলা চলবে। আমরা ব্যাট আর বল নিয়ে নাচব। কিছু দিন আগে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা লোপ করা হল, সারা রাজ্যে জারি হল কার্ফু, বন্ধ হল মোবাইল আর ইন্টারনেট, বন্দি হলেন তিন জন প্রাক্তন মুখমন্ত্রী-সহ তাবৎ অ-বিজেপি নেতা। ভারতে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু প্রতিবাদ দেখা গেলেও, শান্ত পশ্চিমবঙ্গ। সেই বাংলা— যেখানে রয়েছে নকশালবাড়ি, নন্দীগ্রাম, জঙ্গলমহল। যে বাংলাকে নিয়ে গোখলে সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন।

অযোধ্যার রায় বেরলো; মসজিদ ভাঙার কারিগররাই পেল বিতর্কিত জমির অধিকার, মন্দির বানানোর বরাত। নির্বিকার বাংলা; কারণ, সেটাই রাজনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক।

গত ছ’মাস ধরে মহাশক্তিশালী চিনের বিরুদ্ধে হংকংয়ে চলছে বিক্ষোভ (প্রসঙ্গত, হংকংয়ের মাথাপিছু আয় আমাদের কুড়ি গুণ)। পাতাল রেলের ভাড়াবৃদ্ধির প্রতিবাদে সান্তিয়াগোতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সারা চিলিতে (মাথাপিছু আয় ভারতের সাত গুণ), পথে নেমেছেন দশ লক্ষ লোক, কিছু নগরবাসী ইতিমধ্যেই পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন।

চিলি, হংকং, কাশ্মীর, অযোধ্যা কলকাতা থেকে অনেক দূরে, তাই আমরা নিরাপদে। আমার সন্তান দুধেভাতে আছে, তাই আমি নিশ্চিন্ত, বাকিটুকুর দায় আমার নয়। টিভির পর্দায় গোলাপি বল, শহরে গোলাপি আলো, বুকে গোলাপি সুখ। ‘মিছিল নগরী’র এখন বিশ্রামের পালা।

দেবাশিস মিত্র

কলকাতা-৭০

রাজ্যপাল বনাম

রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের প্রাত্যহিক দ্বন্দ্ব, রাজ্য রাজনীতিতে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী একটু ঘুরিয়ে ও তাঁর প্রধান অমাত্যেরা সরাসরি রাজ্যপালকে বিঁধছেন। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকাশে ধনখড় সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন তৃণমূলের সংসদীয় দলের সদস্যেরা। এ রাজ্যে রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকারের সংঘাতের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। ১৯৬৭ সালের ২ নভেম্বর প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করায় রাজ্যপাল ধর্মবীরের বিরুদ্ধে শাসক দল খড়গহস্ত হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে মনোনীত করা ইস্তক রাজ্যপাল এ পি শর্মা তৎকালীন বাম সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। নন্দীগ্রাম কাণ্ডে গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর মন্তব্য বুদ্ধ, বিমান, অনিলকে যারপরনাই ব্যথিত করেছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে উৎখাত করায় এনটিআর ও রাজ্যপাল জগমোহনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পরম্পরায় এ জিনিস নতুন কিছু নয়।

খটকা জাগে অন্যত্র। ধনখড় ও রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব মোটামুটি ভাবে বিজেপি বনাম তৃণমূলের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেগে দেওয়া গিয়েছে। যত বেশি এ নিয়ে চর্চা হবে, এই দুই রাজনৈতিক দলের টিআরপি বাড়বে। বাম-কংগ্রেস জোটকে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা (স্থানীয় বাজারে জিনিসের দাম অগ্নিমূল্য, পার্শ্ব শিক্ষকদের অনশন, ডেঙ্গি রোধে ব্যর্থতা ইত্যাদি) মূল আলোচনার চর্চা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

তাই অনেকে ভাবছেন, এই বিরোধ সুনিপুণ চিত্রনাট্যের অংশ।

রাজশেখর দাস

কলকাতা-১২২

ভিডিয়ো সমাধান

প্রতি বছর নভেম্বর মাসে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের নিজ নিজ পেনশন বণ্টনকারী অফিসে ‘লাইফ সার্টিফিকেট’ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। দেশ এখন ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র দিকে এগিয়ে চলেছে। পেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রেও ‘ডিজিটাল লাইফ সার্টিফিকেট’ দেওয়ার বিধান প্রচলিত হয়েছে। তা ‘অন লাইন’-এও গ্রহণযোগ্য। তা হলে, যে পেনশনাররা শারীরিক ভাবে গিয়ে নিজেদের জীবিত প্রমাণ করতে অসমর্থ, তাঁদের জ্যান্ত চেহারাটা ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ বা ও-রকম কিছুতে ‘ভিডিয়ো কল’-এর মাধ্যমে দেখে নিলেই তো হয়!

কল্যাণ কুমার চৌধুরী

অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি অডিট অফিসার

কুইজ়ে ভূত

বাংলা টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলের অগুন্তি ধর্মীয়, অধর্মীয়, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক সিরিয়ালের অধিকাংশেই জমিয়ে কুসংস্কারের চাষ হয়। শুধু তাতেই রক্ষা নেই। সম্প্রতি দেখলাম, এক জনপ্রিয় কুইজ়ের অনুষ্ঠানে এক প্রতিযোগিনী নানাবিধ অত্যাধুনিক গ্যাজেটের মাধ্যমে ভূত দেখা ইত্যাদির ডেমো দিলেন।

দীর্ঘ সময় ধরে সিরিয়াস মুখে তিনি বিবৃত করলেন, কোথায় কোথায় তাঁরা রীতিমতো তদন্ত করে ভূতের পাল্লায় পড়া লোকজনের অসুস্থতা, অশান্তি ইত্যাদি দূর করেছেন। সেই ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রক্রিয়ার ভিডিয়ো ক্লিপও দেখানো হল।

এত অবাস্তব অভিজ্ঞতা জীবনে কমই হয়েছে, না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না— একটি প্রথম শ্রেণির চ্যানেলে এ রকম কিছু দেখানো হতে পারে। জানি না, বিশ্বাস, না টিআরপির মোহ, কী আছে এ-হেন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্মের পিছনে।

চার পাশে এমনিতেই কুসংস্কারের প্রবল রমরমা। তার ওপর প্রতিষ্ঠান ও সেলেব্রিটিরা কুসংস্কারকে এ ভাবে প্রশ্রয় দিলে, সমাজে তার কুপ্রভাব আরও মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা।

তরুণ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা-৪২

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement