অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে’ (রবিবাসরীয়, ১৮-২) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, বাংলা ভাষায় হিন্দি ও ইংরেজির যথেচ্ছ ও উদ্ভট অনুপ্রবেশ গভীর উদ্বেগ ও বেদনার। বিশ্বায়ন ও সমাজমাধ্যম সর্বস্বতা নিঃসন্দেহে এই প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে, এর গভীরে নিহিত রয়েছে বাঙালির জাত্যভিমান ও ভাষা-আবেগ হ্রাস পাওয়া। হিন্দি-ইংরেজি সেরা আর বাংলা ম্যাড়মেড়ে— এই হীনম্মন্যতাবোধে ভোগা কিছু বাঙালি বাংলা বলতে লজ্জা পান! আবার অনেক বাঙালি মনে করেন, বাংলা ভাষার সঙ্গে ইচ্ছেমতো হিন্দি-ইংরেজি না মেশালে, ভাষাটা ঠিক ওজনদার ও অভিজাত হয়ে ওঠে না। অথচ, এই বাংলার মাটিতে, বাংলাভাষীদের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নোবেলজয়ী রয়েছেন, যা সর্বভারতীয় অন্য কোনও ভাষাতে নেই। বাংলা ভাষায় ছবি করে সত্যজিৎ রায় অস্কারজয়ী। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর স্বীকৃতি লাভ।
ভাষা আবেগ ধরে রাখতে পারার দরুন বাংলাদেশে ‘ভাষা দূষণ’ একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। দক্ষিণ ভারতেও মাতৃভাষার প্রতি টান মারাত্মক। আমাদেরও ঠিক এমনটা চাই। নিশ্চিত ভাবে, কর্মসংস্থান ও জীবিকার স্বার্থে আমাদের হিন্দি, ইংরেজি, ফরাসি-সহ নানা ভাষা শিখতে হবে। তাই বলে বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। মাতৃভাষা বাদ দিলে যে কোনও মানুষ শিকড়হীন হয়ে পড়ে। সুতরাং, ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ গোছের মানসিকতা আমাদের ছাড়তে হবে। বাংলা ভাষায় কথায় কথায় হিন্দি, ইংরেজির সংস্পর্শ সন্তর্পণে এড়াতে হবে। জাত্যভিমান বাড়িয়ে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে ভালবাসতে ও চর্চা করতে হবে। তার পর, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা নিয়মমাফিক গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমতায় সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
প্রণব মাটিয়া, পাথরপ্রতিমা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
গৌরবের ভাষা
ভাষা নদীর ধারার মতো। বহতা নদীর মতোই বাংলা ভাষার মূল ধারার সঙ্গে অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা এসে মিশেছে। পরবর্তী কালে উপনদীর মতো উপভাষা, বিদেশি ভাষাকে আত্মস্থ করে বাংলা ভাষা এগিয়ে চলেছে। কখনও বিদেশি ভাষাকে সরাসরি গ্রহণ করেছে, আবার কখনও বিদেশি ভাষাকে বিবর্তিত করে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য বিদেশি ভাষার কারণে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সঙ্কটের কারণ নেই। কিন্তু ইংরেজির ক্ষেত্রে তা আছে, এই ভাষার পৃথিবীব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার কারণে। আর দেশীয় হিন্দি থেকে ভয়, কারণ এই ভাষার প্রতি সরকারি বদান্যতা ও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম। তবে মাৎস্যন্যায়ের আতঙ্ক বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ততটা প্রকট নয়, কারণ ভাষাটির বিশালত্ব— ওই ভাষায় সৃষ্ট সাহিত্যের বৃহৎ পরিধি, বিশ্বে সংখ্যার নিরিখে বাংলাভাষীদের স্থান পঞ্চমে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সময় বাংলার কথা মনে করতেই হবে। অমিতাভ গুপ্তের ‘বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি’ (২৫-২) প্রবন্ধে সেটা স্বীকৃত। তবে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রায় সমস্ত কিছুই পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলা ভাষা সাহিত্য বিক্রির বাজার দ্বারা প্রভাবিত, কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টি অতটা নিয়ন্ত্রিত নয়। শিবরাম চক্রবর্তীর মতো সাহিত্য-পাগল লোকের সংখ্যা এখনও কম নয়। বইমেলা বা সমাজমাধ্যমে তাঁদের দেখা মেলে। এখন কাজের জগতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেশ কয়েকটি রাজ্যে স্বীকৃত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দি আসক্তি বেশি হওয়ায় হিন্দি আগ্রাসন বেশি সমস্যা তৈরি করেছে। দক্ষিণ ভারত আন্দোলনের মাধ্যমে এই আগ্রাসনকে দমিয়ে দিয়েছে। আমরা বাঙালিরা কেন পারব না?
মাতৃভাষা বটবৃক্ষের মতো। এই মহীরুহের প্রভাব বিস্তার প্রতিফলিত হত, যদি কাজের জগতে বাংলা ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে শুধু আইন তৈরিতে থেমে না থেকে প্রয়োগে জোর দেওয়া হত। এই প্রয়োগের প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যেমন, আগে ব্যাঙ্কের অনেক ফর্মে বাংলা ব্যবহৃত হত। এখন দেখা যায় না। আর একটা কথা, প্রবন্ধকারের ‘শৌখিন বাংলা’ কথাটা যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলা ভাষা— মাতৃভাষা শুধু কি শখের ভাষা? ইংরেজ আধিপত্য যখন মধ্য গগনে, তখন এই বাংলায় কথা বলা দিকপালরা সাহিত্য, বিজ্ঞান-সহ বহু ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শক হয়েছেন। বাজার বাধা হয়নি। এখনও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অতএব বাংলা ভাষাতে গর্বিত হতে বাধা নেই। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছা ও মানসিকতা।
শুভেন্দু মণ্ডল, বগুলা, নদিয়া
অনুবাদ পত্রিকা
সন্দীপন চক্রবর্তীর ‘আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে’ (২৪-২) শীর্ষক প্রবন্ধ বিষয়ে বলি, অনুবাদ সাহিত্য কেন প্রয়োজন— সেই প্রসঙ্গে এই লেখাটি বেশ মূল্যবান ও মনোগ্রাহী। এই প্রবন্ধে প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন যে, আশির দশকে অশোক বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ফ্যাসিবিরোধী এবং প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের যুগে, এক ‘সর্বভারতীয় যোগাযোগ’-এর জায়গা হিসাবে জেগে উঠছিল ভোপালের ভারত ভবন। তারই ফসল হিসাবে তিনি বাংলায় প্রকাশিত বেশ কয়েকটি পত্রিকার নাম উল্লেখ করেছেন, যার মাধ্যমে আমরা সমকালীন ভারতীয় সাহিত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পেরেছি। সেখানে বৈশম্পায়ন ঘোষাল প্রতিষ্ঠিত অনুবাদ পত্রিকা-র নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে অনুবাদ পত্রিকা-র বর্তমান সম্পাদক হিসাবে জানাই যে, অশোক বাজপেয়ীর অনেক আগেই আমার বাবা বৈশম্পায়ন ঘোষাল অনুবাদ পত্রিকা-র কাজ শুরু করেছিলেন। তার পিছনের কাহিনিটি এ রকম—
বাবার বয়স তখন ১৯। সন্ন্যাস নিয়ে ঘর ছেড়েছেন বিবেকানন্দের মতো পরিব্রাজক হয়ে ভারত দেখবেন বলে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে তিনি পৌঁছলেন কেরলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে মাথায় টুকরি (কাঠের বোঝা) নেওয়া এক মহিলার সঙ্গে দেখা হল। তখন অনেক রাত। সেই মহিলার কাছে সন্ন্যাসী জানতে চাইলেন, রাতে কোথাও থাকার জায়গা হবে কি না। মহিলা তাঁকে ইশারায় একটি আস্তানার সন্ধান দেন। পর দিন ভোরে তাঁর ঘুম ভাঙে শিশুদের কলতানে। দেখেন ওটা আসলে একটা স্কুল। এক জন মহিলা এগিয়ে আসেন। কাল রাতে তিনিই তাঁকে আস্তানার সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, কেন তিনি সন্ন্যাসী হতে চান। তখন বৈশম্পায়ন উত্তর দেন— তিনি ভারতবর্ষকে চিনতে চান।
ভদ্রমহিলা ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি বলেন, পায়ে হেঁটে চেনা যায়। তবে ভারতকে জানতে হলে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সাহিত্যকে জানতে হবে। কারণ, এগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে মানুষের জীবন জড়িয়ে। তিনি আরও বলেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পড়েছেন। তবে অনুবাদে। সন্ন্যাসী ভারতীয় সাহিত্যের কী পড়েছেন, তা জানতে চান। তরুণ সন্ন্যাসী ইংরেজিতে বহু বই পড়লেও ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে সে রকম চর্চা করেননি। বহু কষ্টে সংস্কৃত (নিজে পড়তে পারতেন) ও হিন্দি থেকে অনূদিত গুটিকয় বইয়ের নাম করতে পারলেন। মহিলা তাচ্ছিল্য করে বললেন, এই জ্ঞান নিয়ে ভারতবর্ষ চেনা সম্ভব! ভারতকে জানতে গেলে আগে ভারতীয় সাহিত্যকে জানতে হবে।
এই ঘটনার আরও কয়েক বছর পর তিনি ফিরে এসে সংসারে থিতু হন। কিন্তু মাথায় ঘুরত সেই মহিলার অমোঘ বচন। তাঁর মনে হয় অনুবাদই একমাত্র পথ হতে পারে বাংলায় ভারতকে ধরার তথা বিশ্বকে বাঙালির কাছে নিয়ে আসার। সেই ভাবনা থেকেই অন্নদাশঙ্কর রায় ও লীলা রায়ের প্রশ্রয়ে এবং স্বরাজব্রত সেনগুপ্ত, বাণী হাজরা, অলকা উকিল, লাভলী বসু, সর্বোপরি স্ত্রী সোনালী ঘোষালের সহায়তায় তিনি শুরু করেন সম্পূর্ণ বাংলায় অনুবাদ সাহিত্যের পত্রিকা অনুবাদ পত্রিকা। সেটা ১৯৭৫ সাল। আর ভারত ভবন তৈরি হয় ১৯৮২ সালে। তত দিনে বাবা সারা ভারতে পরিচিত মুখ অনুবাদ পত্রিকা-র সম্পাদক হিসাবে। অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে তা পঞ্চাশের পথে।
বিতস্তা ঘোষাল, কলকাতা-৭