সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘পাছে উনি রেগে যান’ (৪-২) প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন ‘আর জি কর আন্দোলন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’। একদম সত্যি কথা। বামেদের শেষ দিক এবং বর্তমান সরকারের এই ১৫-১৬ বছরে চিকিৎসা, শিক্ষা এবং খাদ্য দফতর নিয়ে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল এই আর জি কর-এর গণআন্দোলন। স্বাধীনতার পর এমন গণআন্দোলন কেউ দেখেছেন কি না সন্দেহ। গত দেড়-দুই দশকে রাজ্যের স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং শিক্ষা দফতর আর্থিক দুর্নীতি, স্বজন-পোষণ নীতি, প্রশাসনিক উদাসীনতার যে স্তরে পৌঁছেছে, তা মেনে নেওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে। প্রতিটি দফতরের দুর্নীতি আর জি কর কাণ্ডে যেন আগুনে ঘি ঢেলেছিল। আপাতত আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হলেও পরবর্তী কালে তা ফের জ্বলে উঠবে কি না, সময় বলবে।
এ বার একটু অন্য কথায় আসি। ডাক্তার এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও কর্মক্ষেত্রে একটু দায়িত্ববান হওয়া দরকার। চিকিৎসকদের একাংশের বিরুদ্ধে হাসপাতালে সঠিক ভাবে পরিষেবা না দিয়ে বাইরে চেম্বার সামলাতে ব্যস্ত থাকা, ওষুধ কোম্পানিগুলিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, রোগী পাঠিয়ে ল্যাবগুলিকে যেন তেন প্রকারেণ সচল রাখার চেষ্টার অভিযোগ হামেশাই শোনা যায়। এতে সমালোচনা হবেই। মুখ্যমন্ত্রী নিজের ছাড়াও পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতর সামলে হয়তো খোঁজখবর রাখার সময় পান না। তাঁর তৈরি করা কমিটিগুলিও বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন সময়ে সব দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকে। একই ভাবে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশও যদি স্কুল-কলেজে নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করেন, তবে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা কোথায় যাবে? তারা তো প্রচুর অর্থব্যয় করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে যেতে পারবে না। স্কুল-কলেজের পরিচালন কমিটিগুলি কোনও রং না দেখে এ ব্যাপারে সঠিক তদারকি করবে, সেটাই কাম্য। এ কথা সত্য, সব চিকিৎসক, সব শিক্ষক-শিক্ষিকা এক মানসিকতার নয়। এঁদের অনেকেই সমাজের জন্য কিছু করতে উন্মুখ। কিন্তু ‘পাছে উনি রেগে যান’— এই ভয়ে তাঁরা মুখ খুলতে পারছেন না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলিতে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
একনায়কতন্ত্র
সোমা মুখোপাধ্যায়ের উত্তর-সম্পাদকীয়ের সঙ্গে অনেকাংশে সহমত পোষণ করে এই চিঠি। গণতন্ত্রের হাত ধরে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের আবির্ভাব কোনও নতুন ঘটনা নয়। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে যে সরকার কেন্দ্রে এসেছিল, তারা অনেক ভাল কাজ করেছিল ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই সরকারের মধ্যে একটা স্বৈরতান্ত্রিক রূপ প্রকাশ পেয়েছিল। তার বিভিন্ন দিক আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। তেমনই ২০১১ সালে এ রাজ্যের যে সরকার মানুষের মনে আশা-ভরসা জাগিয়ে ক্ষমতায় এল, তারা এক দিকে যেমন চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল, তেমনই বিকট রূপে প্রকাশ পেল তার একনায়কতন্ত্র। রাজ্যের একটি মন্ত্রিসভা থাকলেও কোনও মন্ত্রীর স্বাধীন ভাবে কাজ করার বা কিছু বলার ক্ষমতা আছে বলে তো মনে হয় না। এমনকি নির্বাচনের ময়দানে ২৯৪টি আসনেই প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং— এ কথাও শুনতে হয় আমাদের। অথচ, গণতন্ত্রের মূল কথাই হল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ক্ষমতা কুক্ষিগত করা নয়।
বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রাম স্তর পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণ করেছিল। এক জন মানুষের হাতে যদি মুখ্যমন্ত্রীর পদ, পুলিশ ও স্বাস্থ্য— এই তিনটি দফতর থাকে, তবে যা ঘটা উচিত, তা-ই ঘটছে রাজ্য জুড়ে। কখনও দূষিত স্যালাইন, কখনও জাল ওষুধ, কখনও পরিকাঠামো না থাকায় রোগী মৃত্যু হচ্ছে। আর জি করের মতো বড় আন্দোলন, যেটি নাকি গণ-আন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল, স্বাস্থ্যের সুদিন ফেরাতে পারল কি? স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে এখনও পর্যন্ত অনেক কমিটিই গড়েছে সরকার, কিন্তু সে সব কমিটির মধ্যে কতগুলি তাদের মতামত শীর্ষ স্তরে জানানোর সুযোগ পেয়েছে? স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকেই আড়ালে আক্ষেপ করে বলেন, শীর্ষনেতৃত্বের নাগাল তাঁরা পান না, অথচ স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। নিলে কখন শীর্ষনেতৃত্বের রোষদৃষ্টিতে পড়তে হয়, সেই ভেবেই তাঁরা শঙ্কিত। আর জি কর আন্দোলন থেমে গেছে বলে যদি শাসক মনে করেন যে মানুষ আগামী দিনেও সব মেনে নেবেন, তবে সেটি হবে তাঁদের সবচেয়ে বড় ভুল।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
স্বাধীনতা কই
সোমা মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু সংযোজন। রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল দশা আজ বহুচর্চিত। এটি সর্বজনবিদিত যে আর জি করের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং জাল স্যালাইন কাণ্ডে প্রসূতির মৃত্যুর জন্য দায়ী স্বাস্থ্য দফতরের দুর্নীতি। এই অবাঞ্ছিত ঘটনা, এক জন দক্ষ স্বাধীন স্থায়ী মন্ত্রী থাকলে হয়তো ঘটত না। এই দফতরের নানা দুর্নীতি, মুখ্যমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। আর জি করের জনৈক ডাক্তার এই দফতরের স্তরে স্তরে কী ভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, কারা যুক্ত, লিখিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রী-সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলিতে জানিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। পরিণতিতে তাঁকে দূরে বদলি করা হয়েছিল। অভিযুক্ত সন্দীপ ঘোষ ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীই তাঁকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখন তিনি জেলে। অভিযুক্ত স্বাস্থ্য সচিবকে বসিয়ে রাখার পিছনে কোন স্বার্থ থাকতে পারে? মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেন, “কাটমানি তোলাবাজি চলবে না, আর কত কত তোমরা খাবে?” অথচ, অভিযোগ শুনতে তিনি পছন্দ করেন না। যে ভাবে তিনি সভা সমিতিতে চমকান-ধমকান, তাতে ইচ্ছা থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেন না। যে ক’জন আছেন তাঁরা নেত্রীর গুণগান করে সমস্যা আড়াল করতে সিদ্ধহস্ত। প্রবন্ধকার এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন— বামফ্রন্ট শঙ্কর সেনের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে কী ভাবে বিদ্যুৎ সঙ্কট সমাধান করেছিল। ওই সময়ে পঞ্চায়েত পরিচালনায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ ছিল একটা ইতিহাস। কিন্তু তৃণমূল দলের এক জনই সব। এই কুক্ষিগত রাখার নীতির জন্যই সমস্যা গভীর হতে বাধ্য।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া
খারাপের দায়
সোমা মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি পড়লাম। তিনি খুব যুক্তিপূর্ণ ভাবেই নানা বিষয় লেখার মধ্যে তুলে ধরেছেন। ওঁর লেখাকে সমর্থন করেই দু’-একটি বিষয় উল্লেখ করছি। এক জন সিভিক ভলান্টিয়ারের ক্ষমতা কতখানি যে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে ডিউটিরত এক জন পড়ুয়া-চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন করে বেরিয়ে যায়? আসামি ধরা পড়েছে। এ বার তাকে ফাঁসি দেওয়ার দাবি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর, যা নিয়ে উচ্চ আদালতেও আবেদন করতে পিছপা হয়নি শাসক দল। গোটা বিষয়টি শুধু রহস্যজনক নয়, যথেষ্ট সন্দেহজনকও বটে। আসলে হাসপাতালের দুর্নীতির চক্রটিকে আড়াল করে মূল দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়াই এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য বলে মনে হয়। মেদিনীপুর হাসপাতালে প্রসূতির মৃত্যুর কারণ যেখানে জাল স্যালাইন বলেই জানা গিয়েছে, সেখানে হাসপাতালের স্যালাইন সরবরাহকারীদের কোনও ভাবে না ধরে ডাক্তারদের দায়ী করে আইনি ব্যবস্থা করা ও সাসপেন্ড করা হল কোন উদ্দেশ্যে? আর জি করের মতোই মূল দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ বনাম ডাক্তারদের মধ্যে লড়াই লাগাতে? চমকে ধমকে আর কত দিন মানুষকে চুপ করিয়ে রাখবে শাসক দল? ভাল কিছু করলে তারা যেমন ঢাক পেটাতে ছাড়ে না, তেমনই খারাপ কিছু হলে তার দায় নিতে ‘এত রাগ কেন’?
বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া