উমা দাশগুপ্ত মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, গত বছর নীরবে অতিক্রান্ত হয়ে গেল অমলেশ ত্রিপাঠীর জন্মশতবর্ষ (‘আমাদের মাস্টারমশাই’, ২-৪)। অধ্যাপক ত্রিপাঠী ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস, ইউরোপীয় আধুনিক ইতিহাসচর্চা, রুশ বিপ্লবের ইতিহাস রচয়িতা ই এইচ কার-এর গ্রন্থ, এরিক হবসবমের লেখা গ্রন্থের বিশ্লেষণমূলক বিস্তৃত আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় অধ্যাত্মশাস্ত্র, দর্শনও অধ্যয়ন করেছেন। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ বইটিতে ধরা পড়ে তাঁর আধ্যাত্মিক অনুধ্যান। শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের শতবর্ষ উপলক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকা-র বিশেষ ক্রোড়পত্রে (১৫-৯-১৯৯৩) ‘সনাতন ধর্মের প্রচারক: নবীন ধর্মের প্রবক্তা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখেন তিনি। তাতে দেখিয়েছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনার বিস্তার, ও বেদান্তের আলোকে ভারতবাসীর মুক্তির পথ। দুর্ভাগ্য, এই প্রবন্ধটি আজও গ্রন্থে স্থান পায়নি। রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে তিনি আনন্দবাজারে (৯-৫-১৯৮৬) লিখেছিলেন একটি প্রবন্ধ, ‘বারবার ফিরে যেতে হয় তাঁর কাছে’। তাতে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, বাঙালির চিন্তার দুর্দিনে কেন রবীন্দ্রনাথ বড় আশ্রয়। বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তাঁর লেখা দীর্ঘ প্রবন্ধ দেশ সাহিত্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, যা দেখিয়েছিল যে, এই দুই মনীষীর চিন্তাভাবনা কেমন ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল বাংলার সংস্কৃতিতে, এবং স্বদেশ মন্ত্রের উচ্চারণ বাংলার সমাজজীবন গঠনে কতখানি সহায়তা করেছিল। প্রথামাফিক সাহিত্য-গবেষক না হয়েও কত সাবলীল ভাবে, সহজ গদ্যে মেলে ধরতেন তাঁর ভাবনার জগৎ। তাঁর অগ্রন্থিত লেখা সংগ্রহের কাজ দ্রুত করতে না পারলে অপঠিত থেকে যাবে তাঁর বহু মূল্যবান রচনা। সেগুলিকে সঙ্কলিত করাই হবে অধ্যাপক ত্রিপাঠীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের যথার্থ উপায়।
শৈবাল মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-২৬
স্থিতধী শিক্ষক
অমলেশ ত্রিপাঠী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ইতিহাস বিভাগে আমারও মাস্টারমশাই ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য বা ক্ষুরধার যুক্তিনির্ভর পড়ানো মনে গেঁথে আছে। ক্লাসঘরে অমলেশবাবুর সঙ্গে নানান বিষয়ে তর্ক বেঁধেছে। কখনও ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা, কখনও গান্ধীবাদী রাজনীতির স্বরূপ নিয়ে আমাদের বিতর্ক হত। স্যর ধৈর্য হারাতেন না। বরং, নতুন নতুন প্রাসঙ্গিক বইয়ের সন্ধান দিতেন, যাতে আমরা যুক্তিতে শাণ দিতে পারি। নিজের শিক্ষকতা জীবনে অমলেশবাবুর এই স্থিতধী অবস্থান মেনে চলার চেষ্টা করেছি। শেষে, একটা আক্ষেপের কথা। ভাল লাগেনি যখন দেখেছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের কোনও এক অধিবেশনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে, রবীন্দ্রসদনের পাঁচ কিংবা ছয় নম্বর সারিতে বসে আছেন তিনি। বিতর্ক, মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের বোধ হয় আর একটু সমাদর প্রাপ্য ছিল।
শুভাশিস ঘোষ
কলকাতা-১০৭
বিরল মেধাচারী
উমা দাশগুপ্তের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। তপন রায়চৌধুরী তাঁর বাঙালনামা গ্রন্থে বলেছেন, “অনেকেই ওঁর (নীরদচন্দ্র চৌধুরীর) পাণ্ডিত্য আর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কথা বলে। ওঁর চেয়ে বেশি পাণ্ডিত্য আমি বাঙালিদের মধ্যে সুখময় চক্রবর্তী, রবি দাশগুপ্ত এবং অমলেশ ত্রিপাঠীর মধ্যে দেখেছি।” পরম প্রাজ্ঞ তপনবাবুর এই উক্তিই ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠীর মূল্যায়নে যথেষ্ট বলে মনে করি। অমলেশ ত্রিপাঠী সেই বিরল মেধাচারীদের এক জন, যিনি যখন যে বিষয়ে কথা বলতেন, মনে হত সেই বিষয়েই তিনি বিশেষজ্ঞ। দি এক্সট্রিমিস্ট চ্যালেঞ্জ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, প্রবন্ধে সে-কথা উল্লিখিত হয়েছে। এরই বঙ্গানুবাদ, ভারতের মুক্তিসংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব। অসামান্য বিশ্লেষণঋদ্ধ এই গ্ৰন্থে লেখক পাশ্চাত্যের কিছু তথাকথিত পণ্ডিত (এঁদের অনেকেই কেমব্রিজ-গোষ্ঠীর সদস্য) ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে যে কিম্ভূত ধারণা পোষণ করতেন (এবং এখনও করেন), তার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ভারতীয় উপনিবেশের রাজনীতি কেবল সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছাড়া কিছু নয়, কোনও আদর্শবাদ সেখানে নেই— পশ্চিমা-পণ্ডিতদের এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছিল বইটি। গ্রন্থটিতে লেখকের পাণ্ডিত্যের ব্যাপ্তি, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, অসামান্য বিশ্লেষণ-ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।
তিনি ছিলেন ইতিহাসবিদ, কিন্তু তাঁর ভাষা ছিল সাহিত্যগন্ধী। এ বিষয়ে তাঁর ইতিহাস ও ঐতিহাসিক গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন, “ঐতিহাসিকের নেই কবির মতো কল্পনার স্বাধীনতা, দার্শনিকের মতো বিশ্বজনীন তত্ত্ব নির্মাণের অধিকার, শিল্পীর মতো অরূপকে মূর্ত বা বিমূর্ত রূপ দেবার আকুতি, বৈজ্ঞানিকের মতো প্রাকৃতিক বিধান আবিষ্কার ও প্রয়োগের অভীপ্সা।... তবু বলতে হবে ইতিহাস স্বতন্ত্র। সামাজিক মানুষের বিপুল কর্মশালার একটা দিকের যবনিকা সরিয়ে একটুখানি কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেন ঐতিহাসিক।...অতীত নিয়ে ইতিহাসের কারবার, কিন্তু ঐতিহাসিকের ‘বর্তমান’ তাঁর ‘অতীত’-এর ব্যাখ্যা প্রভাবিত করে। তা না হলে ফরাসি বিপ্লবের বা নেপোলিয়নের এত রকমের ব্যাখ্যা হত না।” গভীর জীবনদর্শনের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর এই কথাগুলিতে— “আসলে মানুষ একই সঙ্গে মুক্ত ও বন্দী। বন্দী, কারণ ইচ্ছাশক্তিকে নিরঙ্কুশভাবে সে প্রয়োগ করতে পারে না। মুক্ত, কারণ তাকে এগোতেই হবে— পথে হোক বা বিপথে হোক। অতীতের শেকল এক হাতে সে খুলছে, পর মুহূর্তে জড়িয়ে পড়ছে আর এক শেকলে।” অমলেশবাবুর গবেষণাগ্রন্থগুলি পড়লে বোঝা যায়, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যেমন উদার তেমনই যুক্তিযুক্ত। একপেশে মনোভাবের সর্বতো বিরোধী ছিলেন তিনি।
সুগত ত্রিপাঠী
মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
চর্চার ইতিহাস
উমা দাশগুপ্তের প্রবন্ধে কয়েকটি তথ্যগত ভুল চোখে পড়ল। লেখিকা বলেছেন, ট্রেড অ্যান্ড ফাইনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ১৭৯৩-১৮৩৩ বইটি অধ্যাপক ত্রিপাঠী রচিত প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ। কিন্তু তার আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ইভলিউশন অব হিস্টোরিয়োগ্রাফি ইন আমেরিকা, ১৮৭০-১৯১০, যা কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি-র প্রখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ রিচার্ড হফস্টেটার-এর তত্ত্বাবধানে করা তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ। ইতিহাসচর্চার ইতিহাস বিষয়ে তাঁর আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস গ্রন্থের ভূমিকায়, এবং আরও বিশদ ভাবে তাঁর ইতিহাস ও ঐতিহাসিক গ্রন্থে। লেখিকা বলেছেন ১৯৫৬ সালে রমেশচন্দ্র দত্তের ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আন্ডার ব্রিটিশ রুল প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই বইটি দু’টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড চিহ্নিত হয় ‘আর্লি ব্রিটিশ রুল’ (১৭৭৫-১৮৩৭) এবং দ্বিতীয়টি ‘দ্য ভিক্টোরিয়ান এজ’ (১৮৩৭-১৯০০) নামে। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার এই দু’খণ্ডকে পুনঃপ্রকাশ করে হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আন্ডার ব্রিটিশ রুল নামে ১৯৫৯ সালে। ট্রেড অ্যান্ড ফাইনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ১৭৯৩-১৮৩৩ অধ্যাপক ত্রিপাঠীর দ্বিতীয় ইতিহাস গ্রন্থ। লেখিকা বলেছেন বইটি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বেরিয়েছিল। আসলে এর প্রথম সংস্করণ ছেপেছিল ওরিয়েন্ট লংম্যান।
অধ্যাপক ত্রিপাঠীর ছাত্ররা তাঁর জন্মশতবর্ষে স্মরণ করেননি, এমন বলাও উচিত নয়। কোভিডের মধ্যেই ২০২০-র সেপ্টেম্বর মাসে এশিয়াটিক সোসাইটির ‘মান্থলি বুলেটিন’-এ তাঁকে এক রচনায় শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি এক সময়ে তাঁর ছাত্র ছিলেন।
নিখিলেশ গুহ
কলকাতা-৪৭