প্রগতি?: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অতি দ্রুত ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার রঙে ভাগ হয়ে যাচ্ছে
বঙ্গ রাজনীতি হঠাৎ কেমন ধর্মময়! যত দিন যাচ্ছে, রাজনীতির গতি যেন ততই বেশি করে ধর্মনির্ভর হয়ে পড়ছে। তথাকথিত ধর্মের হাওয়া-মোরগ ঠিক করে দিচ্ছে পালে বাতাস পেতে কার কী করণীয়। নেতানেত্রীদের অবিমৃশ্যকারিতায় এমন প্রবণতা যদি বাড়তে থাকে, অদূর ভবিষ্যতে তাতে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হতে বাধ্য। সেই আঁচে সবাইকেই পুড়তে হবে।
একটা কথা বার বার বলা হয়। আবারও বলা দরকার। তা হল, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মের দাপাদাপি কখনও ছিল না। এখানে অনেক হানাহানি হয়েছে, বিস্তর রাজনৈতিক খুন হয়েছে, পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িও কম হয়নি। কিন্তু এ সবের পিছনে ধর্ম বা সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি ছিল না। ছিল দলীয় প্রতিহিংসা। গত দু’তিন বছরে সেই বাতাবরণ বদলে গেল।
কেন, তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। তবে ফিরে দেখলে বোঝা যায়, বিজেপির উত্থান এ ক্ষেত্রে যত তাৎপর্যপূর্ণ, ততটাই লক্ষণীয় বিরোধী দল হিসেবে রাজ্যে বাম এবং কংগ্রেসের কার্যত বিলীয়মান চেহারা।
স্বাধীনতার কুড়ি বছর পরে এই রাজ্যে দু’বার অ-কংগ্রেসি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় এসেও টিকতে পারেনি। ’৬৭ এবং ’৬৯-এ ওই দুই যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পরে আবার কংগ্রেস। কিন্তু ১৯৭৭-এ সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার কায়েম হওয়ার পর থেকে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সাড়ে তিন দশকের ইতিহাস বস্তুত ব্যর্থতার। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে না-পারার মাশুল দিতে দিতেই দল ভেঙে তৃণমূলের জন্ম। তার পরে কী ভাবে সেই দল কংগ্রেসের মূল স্রোতকে টেনে নিল এবং শেষ পর্যন্ত বামেদের অচলায়তন ভেঙে ক্ষমতা দখল করল, সেই আলোচনা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়।
যা প্রাসঙ্গিক, তা হল তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতা দখলের পরে কংগ্রেস যেই সরকার থেকে বেরিয়ে গেল, আবার তাদের পায়ের তলার মাটি আলগা। বিরোধী দল হয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে ফের পিছিয়ে পড়ল তারা।
সিপিএমের অবস্থা আরও করুণ। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ধাক্কা সামলাতে একটি ‘বিপ্লবী’ দল কী ভাবে নিজেদের ফুরিয়ে ফেলে, আলিমুদ্দিন-ব্রিগেড তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সরকারে থাকাকালীন শাঁসে-জলে পুষ্ট দলটি ক্ষমতা হারানোর পরের দিন থেকে শীর্ণ হচ্ছে। বৈপরীত্যটা দেখার মতো!
কিন্তু বিরোধী পরিসর তো শূন্য থাকতে পারে না। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উঠে আসা ছিল সময়ের অপেক্ষা। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর বিপুল জয় সেই পথ প্রশস্ত করে দিল। সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনের ফলে তাদের ভোট-বৃদ্ধির লক্ষণ স্পষ্ট।
অনেকেই বলেন, বাম এবং কংগ্রেসের অর্থাৎ তৃণমূল-বিরোধী ভোটের একটি বড় ভাগ বিজেপির দিকে যাচ্ছে। সহজ অঙ্কে সেটা হয়তো ভুল কথা নয়। এটাও সবাই জানেন যে, বিজেপি উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজা ওড়ায়। এটাই তাদের রাজনীতির তাস। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিপিএম বা কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলের সমর্থকেরা যদি শিবির ভেঙে ‘হিন্দুত্বের’ পতাকার নীচে জায়গা খুঁজে নেয়, তা হলে মানতেই হবে, এত দিন ময়দান চষা দলগুলি আসলে নিজেদের ঘরটাই মজবুত করতে পারেনি। অল্প হাওয়াতেই তা টালমাটাল!
সে না হয় তাদের ব্যাপার। আসল বিপদটা অন্য জায়গায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার রমরমা যত বাড়ছে, ততই তার মোকাবিলায় একই রকম পথ নিচ্ছে শাসক দলও। বিজেপি এর ফলে উৎসাহিত হতেই পারে। ভাবতেই পারে, তাদের উদ্দেশ্য ‘সফল’। কিন্তু রাজনীতির মূল স্রোত এর ফলে বিপথগামী হবে। আগামী দিনের পক্ষে তাকে শুভ সংকেত বলতে পারি না।
অন্য অনেক রাজ্যের মতো এখানেও সংখ্যালঘু ভোট আছে, তফসিলি ভোট আছে, ওবিসি ভোট আছে। আগেও ছিল। দীর্ঘ দিন সেই ভোটের সিংহভাগ পেত বামেরা। সংখ্যালঘুদের একাংশ কংগ্রেসে ভোট দিলেও মূলত সব মিলিয়ে ওই সম্মিলিত ভোট-ব্যাংক ছিল প্রধানত বামেদের দখলে। বিরোধীরা সেখানেই আগাম পিছিয়ে থাকত!
ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বামেদের সেই ভোট-ব্যাংকেও ভাঙন ধরাতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর ধীরে ধীরে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে সংখ্যালঘু ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টায় কোনও ফাঁক রাখেননি তিনি। তবে সেটা ছিল কৌশলগত। বুক ফুলিয়ে সংখ্যালঘু তোষণের কথা বলার তাগিদ এত দিন ছিল না।
এখন সেই তাগিদটা এসেছে। শুধু তা-ই নয়, বিজেপির হিন্দু রাজনীতির পালটা হিসাবে শাসক দলকে একই কায়দায় হিন্দু তাসও খেলতে হচ্ছে। তারাও রামের মিছিল, হনুমানের মিছিল, পুরোহিত সম্মেলন থেকে শুরু করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিবিধ পালপার্বণ পালনের কর্মসূচি নিচ্ছে।
ফলে সাম্প্রতিক রাজনীতির বাতাবরণটাই হয়ে উঠছে ধর্ম-সম্প্রদায় দ্বারা ‘নিয়ন্ত্রিত’। রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের চরিত্রও বদলে গিয়েছে একই ভাবে। আগে প্রধানত জমির লড়াই হত। এখন রামের লড়াই, বিবেকানন্দের লড়াই! তা নিয়ে লাঠালাঠি, খুনোখুনি, মামলা মোকদ্দমাও দেখতে হচ্ছে! শাসক এবং বিরোধী, কেউই এই কানাগলি থেকে বেরোতে পারছে না। বরং ঢুকে পড়ছে আরও গভীরে। সেটাই ভয়ের কারণ।
গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধীদের উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া যেমন শাসকপক্ষের কর্তব্য, তেমনই গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে ‘দিশা’ দেখানো বিরোধীদের কাজ। কে আর কবে তা করে!
তবে এখন অবস্থাটা আরও অদ্ভুত। বিরোধী রাজনীতি কোনও বিকল্প দেখাতেও ব্যর্থ। সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতির বিকল্প হিসেবে তাদের কী কর্মসূচি? সরকারের শিল্পনীতি, আর্থিক কর্মসূচি, উন্নয়নের রোড ম্যাপ ইত্যাদির পালটা বিরোধীরা কী করতে চায়? কোথাও তার হদিশ কিন্তু মিলছে না। কেউ সে কথা বলে না। যা হচ্ছে তা হয় কিছু কুৎসা, কাদা ছোড়াছুড়ি। নয়তো ধর্ম-সম্প্রদায়ের নামে আগুন নিয়ে খেলার অপচেষ্টা। যে খেলায় সবাই শরিক।
কিন্তু আগুন দিয়ে কখনও আগুন নেভানো যায় না। রাজনীতিকদের এটা না বোঝার কথা নয়। শাসকদের দায় এ সব ক্ষেত্রে সর্বদাই অনেক বেশি। প্ররোচনার পাতা ফাঁদে পা দেওয়া সুবুদ্ধির পরিচয় হতে পারে না। বিপদঘণ্টা বাজছে। এখনই সচেতন হওয়া তাই জরুরি।