প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধার এক নিদর্শন। করম পুজো। নিজস্ব চিত্র
আমাজনের জঙ্গলে আগুন লেগেছে। বিশ্ব জুড়ে আশঙ্কার মেঘ। আমাজনের যে অংশে আগুন লেগেছে সেটি ব্রাজিলে। এই দেশটিতে রয়েছে বহু জনজাতি গোষ্ঠী। এমনকি জঙ্গলেও রয়েছে বহু গোষ্ঠী। যাঁরা প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতির সন্তান। তাঁরা জঙ্গল রক্ষা করতে জানেন। অবশ্য বহু আগে থেকেই পরিবেশ নিয়ে আশঙ্কার কালো মেঘ আমাজনের আগুনে সৃষ্টি ধোঁয়ার থেকে বেশি ঘন। কিন্তু পরিবেশ ভাবনা নতুন কিছু নয়। প্রকৃতির কোলে লালিত পৃথিবীর আদিম জনগোষ্ঠীগুলি যুগ যুগ ধরে বন, পাহাড়, নদীকে রক্ষা কথা ভেবেছে। তাদের সেই ভাবনাই রয়ে গিয়েছে পুরাণ, লোককথা, ব্রত, পার্বণ, উৎসবে।
এমনই এক জনজাতি কুড়মি। জঙ্গলমহলে যাঁদের বহু শতাব্দীর বাস। তাঁদের পরিবেশ ভাবনা চমক লাগার মতো। কুড়মিদের পুরাণের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। তাতেও রয়েছে দুনিয়ার অন্য সব পুরাণের মতো মহাপ্রলয় ও ধ্বংসের কথা। ঝড়বৃষ্টি, বজ্রপাত, ভূকম্পন এসবের ফলে ‘হড়’ অর্থাৎ গোটা মানব সমাজ এবং জীবকুল ধ্বংস হয়ে গেল। পুরাণে আছে, ‘জলককার উথাল পাথাল/লত পাতঅ বিরিখ বিথান/ ভীষণ জওরে বহত বাসাত/পাহাড় পাথর অদরল ধসকল/হড়কুল নিপাতে ঠেসল/হড় উতরনে ভীষণ বেঘাত।’ অর্থাৎ এক ভীষণ প্রলয়ে প্রকৃতি, জীবকুল ও মানবসমাজ নির্মূল হয়ে গেল।
সেই প্রলয়ের পরে বাঁচলেন এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। ক্রমে তাঁদের একাশি জন সন্তান হল। প্রাজ্ঞ দুই মানুষ সেই একাশি জনকে পাঠালেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং টিকে যাওয়া সমস্ত কিছুর নমুনা সংগ্রহ করে আনতে। কেন না তাঁরা বুঝেছিলেন, প্রকৃতি ছাড়া, অন্য জীবকুল ছাড়া এ বিপর্যয়ের প্রভাব থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করা যাবে না। অথচ খাদ্য-খাদক সম্পর্কও বজায় রাখতে হবে। তাই তাঁরা একাশি জনের সংগ্রহকে একাশিটি প্রতীক করে দিলেন। এক একটি গোষ্ঠীর এক একটি প্রতীক। সেই সঙ্গে ঠিক করে দেওয়া হল কিছু বিধিনিষেধও। নিষেধ অনুযায়ী, সকলে সব জিনিস নষ্ট করতে তো পারবেই না উপরন্তু সেগুলিকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বলা হল ‘নেগনেতা’ বা গোষ্ঠীর আচারের কথাও। একাশিটি প্রতীক লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রত্যেককে প্রতীক রক্ষার মাধ্যমে প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষার নিদান দেওয়া হয়েছে। কয়েকটির উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
যেমন কড়ুআর গোষ্ঠীর টোটেম, কাড়া (মোষ)। এঁদের নেগনেতা বা পালনীয় আচার হল ‘পূজা কেরহত’। অর্থাৎ কাড়াকে পুজো করতে হবে। ট্যাবু হলো কাড়াকে আঘাত করা যাবে না। কইরআর গোষ্ঠীর টোটেম বা প্রতীক, কলা। নেগনেতা, ‘গাছ নি কাটহ’। কুরকুআর গোষ্ঠীর টোটেম খাঁখরাবিছা বা কাঁকড়াবিছে। নেগনেতা, ‘নি মারহত’। অর্থাৎ মেরো না। এইভাবে দেখা যাবে কাইটুআর, কাদিমার খেসুআর, খেড়ুআর-সহ একাশিটি গোষ্ঠীকে গেঁড়িগুগলি, কখনও ঘাস, কখনও বাদুড়, কুমির, মাকড়সা, সাপ, ব্যাঙ, ধান, পাখি-সহ পরিবেশের প্রধান অপ্রধান নানা উদ্ভিদ ও জীবকুলকে ধ্বংস করতে নিষেধ করা হয়েছে। এবং সযত্নে রক্ষা করতে বলা হয়েছে। কত শত বছর আগে কুড়মি সম্প্রদায় বাস্তুতন্ত্র রক্ষার নিয়ম তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁদের পুরাণে জগৎ ও জীবন –বৃক্ষ, নদী, ঘাস, সামান্য পোকামাকড়ও রক্ষার নিদান যেভাবে দেওয়া হয়েছে তা আজকের বিজ্ঞানের সঙ্গে সহজেই মিলে যায়।
কুড়মালি ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করেন না। কোথাও পাথর, কোথাও গাছের ডাল তাঁদের ভক্তির প্রতিকৃতি। করম পুজোয় গাছের ডাল পুঁতেই পুজো করা হয়। পুরাণের আরেকটি গল্পে রয়েছে সেই প্রকৃতি পুজোর কথা। কাহিনি অনুযায়ী, প্রলয়ের পর তাঁদের বুড়হাবাবা বা শিব এলেন। একটি পাথর দেখিয়ে বললেন, এটা যখন মাটি ফুঁড়ে বেরোবে তখন তার (অর্থাৎ অঙ্কুরের) পুজো করবেন। পাথরের নয় শিবেরও নয়। পুজো হবে কেবল ‘ফঁড়ের’ অর্থাৎ কুঁড়ির বা অঙ্কুরের। বলা বাহুল্য এই অঙ্কুরই গাছ, অরণ্য, শস্য সব কিছুর উৎস। আর তার শক্তির উৎস সূর্য। এই সূর্য বা বুড়হাবাবা ছাড়া কুড়মালিদের কোনও দেবতা নেই। প্রকৃতিই তাঁদের আরাধ্য। অঙ্কুর বা ‘ফঁড়’ ই তাঁদের পুজো। তাঁকে রক্ষা করা, লালনপালন করাই কাজ। এই অঙ্কুরটির তাৎপর্য হল, বুড়হাবাবা, মাহারাই, মাড়োয়ারাই, ভাবসিংরাই, গরামরাই, সবই সূর্যের প্রতীক মাত্র। আর বুড়হাবাবার নির্দেশানুসারে ফঁড়ের পুজোই সকলের পুজো, একমাত্র পুজো।
কুড়মিদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল জাওয়া পরব। এতেও গুরুত্ব প্রায় ‘ফঁড়’ বা বীজের অঙ্কুর। এখানে মুগ, বিরহি, কুড়তি, ধান, গম- সব বীজ ও দানাশস্য জলে ভিজিয়ে অঙ্কুররোদ্গম করা হয়। হলুদ জলে শোধন করা হয়। যাতে পোকামাকড় না লাগে। ভাদ্র মাসের পাঁচদিনের চাঁদে বালিতে ‘বিহিন’ বা বীজ দেওয়া হয়। গানেও তাই আছে, ‘ইসহড় মাহারাই আঢ়ান দেলাঞ গউ/করম মাসে জাওয়া পাতাক লাগি/বিহিন গাল ফঁড় হেলা/হেকত বেরাঞ ফঁড় গউ/ বুড়হাবাবা দেলা দরশন/এই বিহিন ভঁড়া হেকেক/বুড়হাবাবাক মহড়া/ হামরা রিঝে রঙে করব যতন’। একাদশীর দিনে জল না খেয়ে ছেলেরা ফঁড় পুজো করে। আশ্বিন মাসে জিতুয়া পুজোও তাই। এখানেও বৃক্ষ শস্য প্রধান হয়ে ওঠে। পুজো করেন বিবাহিতারা। ধানে তখন দুধ দেখা দেয়। তাঁদের ফলবতী করার প্রার্থনা এটি।
‘ফঁড়ের’ই সংস্কৃতি কুড়মালি পরম্পরায় চলে আসছে। সেই যে বুড়হাবাবা পাথরটিকে নমুনা হিসেবে দেখিয়ে ‘ফঁড়’ বা অঙ্কুর বা ‘পঙ’ চিনিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পাথরের পুজো করার দরকার নেই, আমারও পুজো করার দরকার নেই তোমরা ‘পঙ’ বা অঙ্কুরের পুজো করো। সেই নির্দেশই এখনও মান্য। কুড়মালি পুরাণে উল্লেখ আছে, ‘যেকন গাছেক বিহিন বতর ভুয়ে নিরলে ফঁড় হেকয়। অহ ফঁড়ই হেকত ময়’। ‘অহ খাতির অকর সেবা সুসরান অকর যতন সতন অকর মুড়ে পানি টঘরান, অকর লালন পালন কেরিকে অকর গেড়ে বু (জল) ডাইরলেহে মহর শান্তি হেকেত’। ‘ইটাকেহি ময় সইত পূজা কহত।’
কবিতাতেও তাই আছে, থাইথিতি (চিরস্থায়ী), পরকিতিক ধঁচার ধরা চরাচরে/অকর জগৎ হেরি বরাবর/ তাক তদবির কেরহ অহিরা (সূর্য)/ তালে তাকে ফুরফর বরাবরই’। অর্থাৎ আমাদের সংসার সন্তান আমাদের সৃষ্টি, কে তাকে যত্ন দেয়? আমরা নয়, সকল শক্তির উৎস সূর্য। আর সেই সূর্য সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতিকে। ‘আলা বাসাত পানি, তালে তাঁকে সানি/ মাইভুঁই হেথি সভেকে জননী/পকা মাকড়লে পাখপাখাড় মেছি/সেঁস সিরজন নরা গুছাগুছি’। সূর্যের বন্দনায় বলা হয়েছে, তিনি জল বাতাস সৃষ্টি করেন। বৃক্ষ, ঘাস, ফঁড়—সূর্যই তার দেবতা।
বনাঞ্চল তাঁদেরই যাঁরা বনবাসী। এই নিয়ম কাগজে কলমে থাকলেও সেখানে প্রভাব ফেলেছে বহির্জগতের নানা অনধিকারীরা। যারা মুনাফা ছাড়া দ্বিতীয় ভাবনা ভাবে না। অন্যদিকে কুড়মালিদের মতো এক আদিম বনবাসী গোষ্ঠী উচ্চারণ করে, ‘পরকিতিক কিরতি ঢঁগে/সিরজন জিঁউক জিঁতা/মাহারাইক মাহান জগৎ/ ধরতি মাইঁ ধেরতা’। ‘গাছগাছড়া পাইখ পাখাড়/জতেক জিয়ন হেলা/জলে থলেক জতেক জিঁউ/দড়িহি চরা ভেলা’।
(কৃতজ্ঞতা: কবি মঙ্গল মাহাত)
লেখক মেদিনীপুর কলেজের বাংলার শিক্ষক