রমাবাই।
কলকাতা শহর সর্বদাই বিদ্বান ব্যক্তিদের কদর করেছে। না, এই শহর যে শুধুমাত্র লেখাপড়ায় মগ্ন থেকেছে, তা নয়। মূল ব্যাপারটি হল এই শহরের নতুন জিনিস গ্রহণ করার মানসিকতা। আমাদের দেশে এখনও যদি ঘোরা যায়, সর্বত্রই একটা স্থিতির ভাব দেখব। অর্থাৎ যা কিছু প্রচলিত তাকে আঁকড়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়া। কলকাতা তার ব্যতিক্রম। এখানে মার্ক্সীয় চেতনার প্রাদুর্ভাব বা পরীক্ষানিরীক্ষার স্তর দেখলেও বোঝা যায় যে, প্রতিস্পর্ধী ভাবনার পরিসরকে এই শহর কতটা প্রসারিত করতে পারে। সামাজিক জীবনেও তার ছাপ পড়েছে। কিছু অন্যায় আধিপত্য আছে ঠিকই, আছে সঙ্কীর্ণতাও, কিন্তু সার্বিক ভাবটি গ্রহণের, বর্জনের নয়। সারা দেশে যদিও নতুন করে পুরনো পন্থাগুলি কার্যকর হচ্ছে, কিন্তু কলকাতায় ততটা নয়। এই যেমন, জাতপাতের যে দাপট আমরা অন্যত্র দেখতে পাই, তা কলকাতা তথা বাংলায় কম।
এর একটি কারণ যদি হয় শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব, অন্যটি অবশ্যই নতুন ভাবনা গ্রহণের জন্য বাঙালির আগ্রহ। নতুন ভাবনার সঙ্গে নিশ্চয়ই সংযুক্ত নতুন মানুষের উপস্থিতি। আমাদের ঘরের সন্তানরা এমনিই আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি লাভ করেননি। এর একটি প্রগাঢ় প্রেক্ষিত ছিল দীর্ঘ দিন ধরেই। একটা সময় ছিল যখন সারা দেশ কাউকে নিয়ে অভিভূত হয়ে পড়লেও এই শহরের স্বীকৃতির মূল্য ছিল পৃথক তাৎপর্যমণ্ডিত।
সেই স্বীকৃতি অন্যকে যেমন মহিমান্বিত করেছে, তেমনই দিয়েছে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় রসদ। তা আর্থিক নয়। পারমার্থিক। আজ যেমন নতুন করে পুরনো আত্মপরিচয়ের উপকরণগুলি আমাদের গিলে ফেলতে চাইছে, আর আমরা তাই নিয়ে কী করব, সে বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, মনে রাখতে হবে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে যে ঔপনিবেশিক যুক্তিকাঠামো রচিত হয়েছিল, তা একান্তই আমাদের বঙ্গীয় জীবনের তার্কিক ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের এই অঞ্চলটি কখনওই আপন চিন্তার কষ্টিপাথরে যাচাই না করে কোনও ভাবনাকে ফেলে দেয়নি। মাদার টেরিজা কখন এই শহরের আপনজন হয়ে গেলেন তা বোঝাই গেল না! হলফ করে বলা যায়, শহরের বৌদ্ধিক পরম্পরায় এমন আত্তীকরণের সামাজিক ক্ষমতা রয়েছে। এক দিনে যেমন তা সৃষ্ট হয়নি, তেমনই কোনও ঝড়ে তা বিনষ্ট হবে না, এমন আশা করাই যায়। সমগ্র দেশ এক ভাবে পাল্টালেও আমরা অন্য ভাবে পাল্টাব। প্রশ্ন করতে করতেই হয়তো নতুন কোনও আধার খুঁজে পাব, পুরনোকে নতুনের আলোয় বিচার করব। শ্রীচৈতন্য থেকে মাদার টেরিজা পর্যন্ত যে পর্বান্তর, তা সামাজিক প্রেক্ষিতে অনেক প্রসারিত, কোনও দলীয় প্রাদুর্ভাব তাকে কলুষিত করতে পারবে না। কেননা প্রতিস্পর্ধা রয়েছে তার চয়নে, আপন বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা তার প্রারম্ভিক ভাষ্যে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার হিন্দু সমাজে সংস্কারের যে গতিমুখ স্থাপিত হয়েছিল, তাকে শুধুমাত্র সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে অন্বিত করে রাখা ভুল হবে। তার একটি অন্য মাত্রা ছিল— বিরুদ্ধ মতামতকে আশ্রয় দেওয়া। অন্যের কথা শোনা বা ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়ার যে অভ্যাস আমরা হারিয়েছি, তা কিন্তু এই বাংলায় একদা যথেষ্ট গুরুত্ব পেত। মরাঠি ব্রাহ্মণকন্যা রমাবাই অল্প বয়সে পিতামাতাকে হারিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন আত্মানুসন্ধানে। এই পর্বে তিনি ছিলেন ধর্মীয় পরিব্রাজক। শৈশব থেকেই শিখেছিলেন হিন্দু ধর্মশাস্ত্র। তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। বেদ-উপনিষদ স্পর্শ করেননি, তাতে নারীর ‘অধিকার’ ছিল না বলে। অর্থাৎ মৌলিক দর্শন তাঁর অধরা ছিল, কিন্তু লোকাচারকেন্দ্রিক ধর্মকে আশ্রয় করেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা ধর্মীয় প্রচারক। তখনও কুড়ি হয়নি, স্পষ্ট সংস্কৃত উচ্চারণে মুগ্ধ করে দিতেন মরাঠি কন্যা। শৈশব থেকে তাঁর পিতা ধর্মীয় শিক্ষার অঙ্গনেই তাঁকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। অন্য কিছু নয়, চেয়েছিলেন মেধাবী কন্যাটি হোক এক শ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারক। ব্রাহ্মণকন্যার নিয়মানুসারে বিয়েও দেননি তিনি। সেই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে কম প্রচেষ্টা করেননি রমাবাই। তবে মনের মধ্যে ছিল সংশয়। কলকাতার পণ্ডিতেরা কী বলবেন? গ্রহণ করবেন তো এই প্রব্রাজিকাকে?
কলকাতাতেই ঘটল তাঁর ‘জন্মান্তর’। এই শহরের বিদ্বানরা শুধু তাঁর অনবদ্য ভাষণই শুনলেন না, দিলেন ‘পণ্ডিতা’ উপাধি। কলকাতার হিন্দু সমাজের শ্রেষ্ঠ বিদ্বানরা যে সাদর অভ্যর্থনা তাঁকে দিয়েছিলেন সে কথা কখনও ভোলেননি এই মরাঠি কন্যা। ১৮৭৮ সালের কলকাতায় তখনও চলছে নতুন আর পুরনোর দ্বন্দ্ব। পত্রপত্রিকার সেই প্রসার তৈরি হয়নি, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিও ছিল সুপ্ত। কিন্তু বিদ্যার চর্চায়, বিতর্কের আবহ রচনায় এই শহর সারা দেশের মধ্যে অগ্রণী। হিন্দু গরিষ্ঠতাবাদীদের পাশাপাশি ছিলেন ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টীয় সমাজের নেতারা। তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং আন্তরিক সহযোগে কোনও বাধাও ছিল না। রমাবাই এক বছর কলকাতায় ছিলেন, আর তাতেই আমূল পাল্টে ফেললেন নিজেকে। নারীস্বাধীনতার প্রথম উচ্চারণ, সামাজিক সচলতার প্রারম্ভিক বয়ান কোনও রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের ফলে হয়নি, এসেছিল মুক্ত বিদ্যাচর্চার হাত ধরে। সেখানে কোনও ফাঁকি ছিল না।
কলকাতার হিন্দু পণ্ডিতরাই রমাবাইকে আরও গভীরে গিয়ে শাস্ত্রপাঠে উৎসাহিত করেন। বলেন, পর্দানশিন মহিলাদের জন্য জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। রমাবাই ডুবে যান শাস্ত্রপাঠে। নিছক লোকাচারনির্ভর ধর্ম নয়, পুরাণের ব্যাখ্যা নয়, বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেন ধর্মচর্চার মৌলিক আধারটিকে। আর ধাক্কা খেলেন সেখানেই। দেখলেন হিন্দুশাস্ত্র কোথাও একই কথা বলছে না। নানা ভাষ্য, ‘নানা মুনির নানা মত’। এই অপার বৈচিত্রের মাঝে কোথায় থামবেন তিনি? কেমন ভাবেই বা নরনারীর জীবনে সাম্যের বিধান নির্ণয় করবেন? প্রবল অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরল তাঁকে। মনোযোগ দিলেন পতিত নারীর অবস্থান নিয়ে শাস্ত্রীয় বিধানে। হতাশ হতে হল, পেলেন না মুক্তির কোনও সহজিয়া পথ। এই কঠিন বাস্তবে কেমন করে সমাজের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে একা নারী এগিয়ে যাবেন আপন প্রত্যয়ে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট দিশা তিনি খুঁজে পেলেন না। শূদ্র এবং সমাজের মূল স্রোতের বাইরে পড়ে থাকা নারীর মধ্যে সামঞ্জস্য দেখে তাঁর মতামত দ্রুত পাল্টাতে থাকল।
এই পর্বেও ছিলেন এক বাঙালি পণ্ডিত। তাঁর নাম কেশবচন্দ্র সেন। জীবনসায়াহ্নে এসেও যাঁর কথা ভুলতে পারেননি রমাবাই। শুধুমাত্র নিজের গৃহে সাদর আপ্যায়ন নয়, নিজের সংস্কারমুক্ত স্ত্রী ও কন্যাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন কেশবচন্দ্র। ব্রাহ্মসমাজের নেতা, কিন্তু কোনও বাহ্যিক অহঙ্কার নেই। অনাবিল সখ্য গড়ে উঠল এই মানুষটির সঙ্গে। হিন্দু সমাজ যখন তাঁকে নিষেধ করছে বেদ-উপনিষদ স্পর্শ করতে, কেশবচন্দ্র কিন্তু রমাবাইয়ের হাতে তুলে দিলেন আকরগ্রন্থগুলি। পড়ে দেখতে বললেন, হয়তো পথের সন্ধান পাবেন।
কেশবচন্দ্রের সংস্পর্শে রমাবাই হয়ে উঠলেন আরও সংস্কার মুক্ত। বিয়ে করলেন এক বাঙালিকে, জাতে শূদ্র। কোথাও কোনও আলোড়ন হল না তাতে। কলকাতা কেড়ে নিল না তাঁর পণ্ডিতা উপাধি।
স্বামীর সঙ্গে চলে গেলেন বাঙালির আর এক আশ্রয় শিলচরে। কন্যার জন্মের দুই বছরের মাথায় হারালেন স্বামীকে। এ বার অন্য লড়াই। চব্বিশ বছর বয়সি এক হিন্দু বিধবার, যিনি প্রায় আত্মীয়হীন বলাই চলে। ফিরে গেলেন পুণেয়। সেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে আশ্রয় দিলেন। গেলেন বিলেত। খ্রিস্টান ধর্মের নানা আঙ্গিক নয়, তাঁকে আকর্ষণ করল জিশুর জীবন। পতিতকে সম্মান দেওয়ার আকুতি। ধর্মান্তরিত হলেন তিনি। দেশে ফিরে বাকি জীবন উৎসর্গ করলেন পিছিয়ে পড়া, সমাজে একঘরে করে রাখা মেয়েদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মিশনে হিন্দু মেয়েরা ধর্মান্তরিত হতেন না। আপনাপন বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার এই শিক্ষা তাঁকে কোনও ধর্ম দেয়নি, দিয়েছিলেন কলকাতার বিদ্বানরা। সমাজতন্ত্র তখনও এ দেশে প্রচারিত হয়নি, কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে মেয়েদের জন্য কতটা জরুরি, সে কথা বলতে তিনি দ্বিধা করেননি। শ্রমজীবী মেয়েরা যে তথাকথিত উচ্চবর্ণের তুলনায় অনেক স্বাধীন, অত্যন্ত জোরের সঙ্গে সে কথা লিখে গিয়েছেন ভারতীয় উপমহাদেশের এই প্রথম নারীবাদী, যিনি তত্ত্বের মোড়কে নিজেকে বেঁধে না রেখে প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
তাঁকে প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছিলেন কলকাতার বিদ্বানরাই। সে কথা ভোলেননি পণ্ডিতা রমাবাই। বিদ্যাচর্চার এই পীঠস্থান কি সর্বগ্রাসী রাজনীতির কাছে পরাজিত হবে, না কি আপন ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে রাজনীতিকে বলবে, ‘আমাকে অনুসরণ করো’?