সম্পাদকীয় ১

‘সাংবিধানিক মুহূর্ত’

আপাত-রসোক্তি বলা ছাড়া গত্যন্তর নাই, কেননা ইহার দক্ষ বুননের মধ্যেই ধরা আছে ‘আজ’ অথবা ‘বর্তমান সময়’ সম্পর্কে মাননীয় বিচারপতির তীক্ষ্ণ সমালোচনা। সেই বর্তমান কী ভাবে বিচারবিভাগের উপর প্রভাব ফেলিতে পারে, তাহারও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়াছেন তিনি। বিচারবিভাগ যদি অন্য দুই বিভাগের কোনও একটির সহিতও সংযোগ রাখিয়া চলিতে চাহে, তাহা ভয়ানক বিপজ্জনক— এই সতর্কবাণীর মধ্যে ধরা আছে সেই ইঙ্গিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৮ ০১:৩১
Share:

অধুনা বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা লইয়া বহু কথাবার্তা শোনা যাইতেছে। গত শীতকালে রাজধানীর চার বরিষ্ঠ বিচারপতির সেই ঐতিহাসিক সাংবাদিক বৈঠক হইতে শুরু। তাহার পর নানা অবকাশে বিচারপতিরাই এমন নানা আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করিয়া দিয়াছেন। আরও এক বার তেমন একটি সুযোগ তৈরি হইল, গত বৃহস্পতিবার মাননীয় বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর একটি বক্তৃতার সৌজন্যে। গণতন্ত্রের তিন স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভটিকে অবশ্যই স্বাধীন ভাবে কাজ করিতে হইবে— এই কথাটিকে কেন্দ্র করিয়া বিচারবিভাগের দায়িত্বের উপর নূতন করিয়া জোর দিলেন তিনি। বলিলেন, ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’ তৈরি করিবার দায় বোধ করিবার মতো মুহূর্ত সব সময় আসে না, কিন্তু বর্তমান সময়টি নিশ্চিত ভাবে তেমনই এক মুহূর্ত। ‘সাংবিধানিক মুহূর্ত’টি আনিতে অনেক দেরি হইয়াছে, কিন্তু আর নহে, এখনই বিচারপতিদের কাজ— যত শীঘ্র সম্ভব সেই মুহূর্তটিকে লইয়া আসা। প্রায়-বৈপ্লবিক আত্মসংশোধনের আহ্বানটির মধ্যে প্রধান ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বলিতে হইবে শ্রীগগৈয়ের আপাত-রসোক্তিটিকে: নিরপেক্ষ বিচারপতি ও সরব সাংবাদিকরা তো গণতন্ত্রের পক্ষে জরুরি বটেই, নিরপেক্ষ সাংবাদিক ও সরব বিচারপতিদের প্রয়োজনও আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের সুস্থতার পক্ষে অতীব গুরুতর হইয়া উঠিতেছে!

Advertisement

আপাত-রসোক্তি বলা ছাড়া গত্যন্তর নাই, কেননা ইহার দক্ষ বুননের মধ্যেই ধরা আছে ‘আজ’ অথবা ‘বর্তমান সময়’ সম্পর্কে মাননীয় বিচারপতির তীক্ষ্ণ সমালোচনা। সেই বর্তমান কী ভাবে বিচারবিভাগের উপর প্রভাব ফেলিতে পারে, তাহারও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়াছেন তিনি। বিচারবিভাগ যদি অন্য দুই বিভাগের কোনও একটির সহিতও সংযোগ রাখিয়া চলিতে চাহে, তাহা ভয়ানক বিপজ্জনক— এই সতর্কবাণীর মধ্যে ধরা আছে সেই ইঙ্গিত। কোনও নূতন আত্মসমালোচনা নহে, ইতিপূর্বে অন্য বিচারপতিদের মুখেও ইহা ধ্বনিত হইয়াছে। কিন্তু গগৈয়ের কথার স্পষ্টতা ও ঋজুতা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। গণতন্ত্রের খাতিরে প্রতি মুহূর্তে সাংবিধানিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করিয়া যাইবার অঙ্গীকারের মধ্যে অনেকখানি ভর্ৎসনা মিশিয়া আছে, আর আছে প্রচ্ছন্ন আক্ষেপ। স্বাধীন দেশে গত কয়েক দশকের ‘অর্জন’টিকে নানা কারণে দুর্বল করিয়া ফেলিবার কারণে আক্ষেপ। বাস্তবিক, বিচারবিভাগকে তিনি এক ধরনের সক্রিয় ভূমিকা লইতে বলিয়াছেন। কিন্তু তাহা পরিচিত ‘বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা’ নহে। বরং নূতন ভাবে আত্মনির্মাণের লক্ষ্যে তৎপর হইবার সক্রিয়তা। সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে মৌলিক মূল্যবোধগুলিকে আবার সামনে লইয়া আসিবার দায়িত্বপালন।

প্রসঙ্গত, তাঁহার কথায় সাংবাদিক জগতের প্রসঙ্গও যে আসিয়া পড়িল, তাহাকে আকস্মিক বলা চলে না। সত্যই তো, গণতন্ত্রকে চালু রাখিবার জন্য বিচারবিভাগ যেমন, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাটিও তো তেমনই গুরুতর। মুক্ত নির্ভীক স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের খুঁটি। তাহা নড়িয়া গেলে গণতন্ত্রের ভিত টলমল করে। গগৈ সাংবাদিকদের বিশেষণ হিসাবে ‘সরব’-এর জায়গায় ‘স্বাধীন’ শব্দটি ঘুরাইয়া আনিয়াছেন, নিশ্চিত ভাবেই সুচিন্তিত এই প্রয়োগ। গোটা দেশে, বিশেষত রাজধানী অঞ্চলে, আজ সংবাদ-জগতের যে ভীরু রাজনীতি-মুখাপেক্ষিতা, যে নিয়মিত প্রসাদভিক্ষার অভ্যাস, তাহা একই সঙ্গে পীড়াদায়ক ও বিপজ্জনক। দ্রুত এই রোগের নিরাময় দরকার। নতুবা এই এক রোগেই গণতন্ত্রের সমাধি ঘটিতে পারে। চিত্তকে ভয়শূন্য ও শিরকে মু্ক্ত রাখিবার কাজটি কঠিন হইলেও ইহাই একমাত্র পথ। বিচারপতিকে ধন্যবাদ, সোজা কথাটি তিনি সোজা ভাবে বলিয়াছেন। যাঁহাদের শুনিবার, তাঁহারা শুনিবেন কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement