ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি সংসদে লেবার কোড বা শ্রমবিধি পেশ করল কেন্দ্রীয় সরকার। শিল্পক্ষেত্রে এত দিন যত আইন ছিল, জাতীয় শ্রম কমিশন ২০০২ সালে সেগুলিকে কয়েকটি বৃহত্তর গুচ্ছে বেঁধে ফেলার কথা বলেছিল। এই নতুন শ্রমবিধি এক অর্থে সেই প্রক্রিয়ারই চূড়ান্ত রূপ।
প্রথম, অর্থাৎ বেতন সংক্রান্ত বিধিটি দেশের সব শ্রমিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানের কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করবে। বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন হারে ন্যূনতম বেতনের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। এই হার স্থির করার আগে কেন্দ্রীয় সরকার সেন্ট্রাল অ্যাডভাইজ়রি বোর্ড এবং রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। কোনও নিয়োগকর্তা এই বিধি ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ তিন মাস জেল এবং এক লক্ষ টাকা অবধি জরিমানা।
দ্বিতীয়, অর্থাৎ শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধিটি প্রযোজ্য হবে তেমন সংস্থার ক্ষেত্রে, যেখানে শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত দশ জন। তা ছাড়াও খনিতে ও ডকে কর্মরত শ্রমিকেরাও এর আওতায় আসবেন। আঘাত বা রোগের কারণ হতে পারে, কর্মস্থলকে এমন বিপজ্জনক জিনিস থেকে মুক্ত রাখা, নোটিফায়েড প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের জন্য বার্ষিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার ব্যবস্থা করা, কর্মীদের নিয়োগপত্র দেওয়া, কর্মস্থলে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো ইত্যাদির কথা এই বিধিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও নির্দিষ্ট হয়েছে যে সরকারের অনুমতি থাকলে কোনও মহিলাকর্মীর সম্মতি নিয়ে তাঁকে সন্ধে সাতটার পর বা সকাল ছ’টার আগে কর্মক্ষেত্রে রাখা যেতে পারে। ইনস্পেক্টর-কাম-ফেসিলিটেটর নামে একটি নতুন পদ তৈরি করার কথা বলা হয়েছে, যাঁর দায়িত্ব হবে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তদন্ত করা। এই বিধি অমান্য করলে সর্বোচ্চ দু’বছর জেল, এবং পাঁচ লক্ষ টাকা অবধি জরিমানা হতে পারে। এবং, এই বিধি অনুসারে মামলা হলে দেওয়ানি আদালতে তার শুনানি হবে না।
তৃতীয় বিধিটি শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত। কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিকের কল্যাণে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প ঘোষণা করতে পারে। তার মধ্যে প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প যেমন আছে, পেনশন স্কিম আছে, এমপ্লয়িজ় ডিপোজ়িট লিঙ্কড ইনশিয়োর্যান্স স্কিম আছে। তা ছাড়াও সরকার শ্রমিকের অসুস্থতা, গর্ভধারণ, এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা দিতে এমপ্লয়িজ় স্টেট ইনশিয়োর্যান্স স্কিম ঘোষণা করতে পারে, পাঁচ বছর বা তার বেশি চাকরি করলে গ্র্যাচুইটি দিতে পারে, মহিলা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন বিশেষ সুবিধা দিতে পারে ইত্যাদি। গিগ ওয়ার্কার (অর্থাৎ, যাঁরা সাময়িক ভাবে কোনও একটি খুচরো চাকরি করছেন), প্ল্যাটফর্মের হকার, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্যও বিশেষ সুবিধা, যেমন জীবনবিমা ও পঙ্গুত্ববিমার ব্যবস্থা হতে পারে। এই বিধির ক্ষেত্রেও ইনস্পেক্টর-কাম-ফেলিসিটেটর পদ তৈরি করার সুযোগ রয়েছে। বিধিতে জানানো হয়েছে, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আদালত এই বিধির অধীনে মামলার শুনানি করতে পারে।
এত দিন নিয়ম ছিল, কোনও প্রতিষ্ঠানের সাত জন বা তার বেশি কর্মী ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার আবেদন করতে পারবেন, এবং তাঁদের সেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। নতুন শ্রমবিধির চতুর্থ, অর্থাৎ শিল্প-সম্পর্ক বিষয়ক বিধিতে বলা হয়েছে, সাত জন একত্রে হলেই ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা যাবে, তবে সংস্থার মোট শ্রমিকের অন্তত ১০ শতাংশ বা ১০০ জন শ্রমিক (যে সংখ্যাটি কম হবে) একত্রে ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে নথিভুক্ত করার আবেদন করলে তাঁদের সেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এবং, ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে স্বীকৃতি বজায় রাখার জন্য তাতে সব সময় অন্তত সাত জন এমন সদস্য থাকতেই হবে, যাঁরা সংশ্লিষ্ট সংস্থায় বা সংশ্লিষ্ট শিল্পে কর্মরত। নতুন বিধিতে নেগোশিয়েটিং ইউনিয়ন-এর কথা বলা হয়েছে। যদি কোনও সংস্থায় একটিই ইউনিয়ন থাকে, তবে কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা করবে। যদি ইউনিয়নের সংখ্যা একাধিক হয়, তবে সংস্থার অন্তত ৭৫ শতাংশ শ্রমিক যে সংগঠনের সদস্য, সেটি নেগোশিয়েটিং ইউনিয়নের মর্যাদা পাবে।
আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত হল, যে শিল্প প্রতিষ্ঠানে বা বাগানে শ্রমিকের সংখ্যা একশো বা তার বেশি, সেখানে ছাঁটাই বা লক-আউট করার আগে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সরকার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এই ন্যূনতম শ্রমিক সংখ্যা বদলাতে পারে। এই বিধি অমান্য করলে এক থেকে দশ লক্ষ টাকা জরিমানা।
শিল্প-সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধির আওতায় কাগজ-কলমে সব শ্রমিকেরই আসার কথা। কিন্তু দেশের বিস্তৃত অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কোথায়? এমনকি, সংগঠিত ক্ষেত্রেও সব শ্রমিককে এই চিঠি দেওয়া হয় না, মাস্টার রোলেও সবার নাম থাকে না। ফলে, সেই শ্রমিকেরা এই আইনের সুবিধা পাবেন না। সে কারণেই দ্বিতীয় বিধিতে সব শ্রমিককে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
যে কোনও সংস্কার, বিশেষত শ্রম আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে শ্রমিক এবং মালিকপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই বিশ্বাস তৈরি হয় কিসে? আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের মৌলিক নীতিগুলির একটা হল, শ্রমক্ষেত্রে যে কোনও আলোচনা এবং আইন প্রণয়নের জন্য ত্রিপাক্ষিক উপস্থিতি প্রয়োজন। মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ এবং সরকার। শ্রম সংগঠনের সদস্য দেশগুলি এই ত্রিপাক্ষিক আলোচনা করার জন্য চুক্তিবদ্ধ। ভারতও। শ্রমক্ষেত্রে কোন নীতি গৃহীত হবে, সংস্কারের কোন পথে হাঁটা হবে, তা স্থির করার জন্য এই ত্রিপাক্ষিক আলোচনা হওয়ার কথা।
তেমন ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের বিবিধ পরিসর ভারতে আছে। ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্স যেমন। এই সম্মেলন শেষ আয়োজিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, নির্দিষ্ট কোনও বিষয় আলোচনা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার মাঝেমধ্যেই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন করে থাকে বটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই বৈঠক ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে না। শ্রমবিধি তৈরি করার ক্ষেত্রেও বৈঠকগুলির একই পরিণতি হয়। ফলে, শ্রমবিধি স্থির করার সময় শ্রমক্ষেত্রের পরিসরে সামাজিক অংশীদারদের মধ্যে একটা বিশ্বাসের আবহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার সফল হয়েছে, তেমন কথা বলা মুশকিল।
ভারতে শ্রম প্রশাসনের চিরকালীন সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বেশি সংখ্যক শ্রমিককে শ্রম আইনের আওতায় আনতে পারা। নতুন শ্রমবিধির ক্ষেত্রেও সেই একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে বলে আশঙ্কা। ভারতে অকৃষি শ্রমিকদের মাত্র দুই শতাংশ শ্রম আইনের আওতায় আসেন। খনি ও পাথরখাদানের কর্মীদের মাত্র দশ শতাংশ; দশ বা ততোধিক শ্রমিক নিয়োগ করে, এমন নির্মাণক্ষেত্রের মাত্র দুই শতাংশ শ্রমিক আসেন শ্রম আইনের আওতায়। দশ জন শ্রমিকের সংখ্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অধিকাংশ শ্রম আইনই প্রযোজ্য এমন সংগঠিত সংস্থার ক্ষেত্রে, যেখানে শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত দশ জন। ভারতে মোট যত প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়, তার মাত্র এক শতাংশে শ্রমিকের সংখ্যা একশো বা তার বেশি। অর্থাৎ, মোট শ্রমিকের ৯৯ শতাংশই থেকে যাচ্ছেন যখন-তখন ছাঁটাইয়ের ঝুঁকিতে।
পরের প্রশ্ন হল, কারখানাগুলোর কী অবস্থা? ২০১৬-১৭ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশে মোট যত রেজিস্টার্ড বা নথিভুক্ত কারখানা রয়েছে, তার ৮২ শতাংশেই শ্রমিকের সংখ্যা ১০০ জনের কম। তবে, কারখানায় কর্মরত মোট শ্রমশক্তির মাত্র ২৩ শতাংশ কাজ করেন সেখানে। ফলে, কারখানার শ্রমিকের অধিকাংশ শ্রমবিধির সব সুবিধা পাবেন। কিন্তু, দেশে অ-কৃষি ক্ষেত্রে মূল কর্মসংস্থান যেখানে পরিষেবাক্ষেত্রে হচ্ছে, সেখানে এই পরিসংখ্যান থেকে খুব ভরসা পাওয়ার কারণ নেই। বেতন বিধি এবং সামাজিক নিরাপত্তার বিধি দেশের সব ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা, কিন্তু বাকি দু’টি বিধির ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর্মিসংখ্যার গণ্ডি পেরোনোর শর্ত রয়েছে। কাজেই, শ্রমবিধি কত জন শ্রমিককে নিরাপত্তা দেবে, বলা মুশকিল।
নতুন শ্রমবিধির ফলে ন্যূনতম মজুরি স্থির করার প্রশ্নে স্বচ্ছতা আসবে। আবার এটাও ঠিক যে এই শ্রমবিধি শাসনবিভাগের— অর্থাৎ, প্রশাসনের হাতে বিপুল ক্ষমতা দিচ্ছে। শ্রমিকের উন্নয়নের প্রশ্নে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যে, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের ক্ষেত্রে বহু সিদ্ধান্তের অধিকারী হচ্ছে প্রশাসন। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রেও অনেক কড়াকড়ি হচ্ছে। শ্রমবিধির প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে, তা হল— নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বদলে প্রশাসনের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা চলে যাওয়া কি গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ?
ভূতপূর্ব প্রধান উপদেষ্টা, কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক