জীবনানন্দ দাশ। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে
জনপ্রিয়তা যেমন বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানায় আবার জনপ্রিয়তাহীনতাও কবিখ্যাতিকে প্রান্তিক করে তোলে না, বরং জনবিমুখতায় সমীহ আদায় করার অবকাশ মেলে। সে দিক থেকে বিশ শতকে আধুনিক কবিকুলে নিন্দিত হয়ে নন্দিত কবি জীবনানন্দ দাশ (১৭/০২/১৮৯৯-২২/১০/১৯৫৪)।
রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় তাঁর অবিসংবাদিত পরিচিতি নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। যদিও কাজি নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রায় সমবয়সি জীবনানন্দ দাশের ভাগ্যে তৎকালীন সময়ে বিদ্রোহী কবির মতো জনপ্রিয়তার ছিটেফোঁটা জোটেনি। সেখানে সজনীকান্ত দাশের লেখনীর আঁচড়ে তাঁকে কাব্যজীবনের সূচনাপর্বেই শুধু মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়নি, দুর্বিষহ জীবনের শিকার হতে হয়েছিল। জীবনানন্দের প্রথম কাব্য ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭-এ (১৩৩৪-এর ১০ আশ্বিন)। প্রথম কাব্যেই কবির পদবির ‘দাশগুপ্ত’র ‘গুপ্ত’ লুপ্ত হয়। পরে দু-একটি কবিতায় তা প্রকাশ্যে এসেছিল বটে। অন্য দিকে, পরের বছরেই সজনীকান্ত তাঁর ‘শনিবারের চিঠি’র ‘সংবাদ সাহিত্য’ বিভাগে অশালীন ভাষায় জীবনানন্দের একের পর এক কবিতার উল্লেখ করে বিরূপ সমালোচনায় মেতে ওঠেন। সেখানেই শেষ নয়। সেই বছরেই ১৯২২ থেকে করে আসা সিটি কলেজের অধ্যাপনার চাকরিটিও চলে যায়। সেখানে সজনীকান্ত দাসের বিরূপ সমালোচনার সূত্রে কবির চাকরি থেকে বরখাস্তের কারণ হিসাবে তাঁর কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগটি এঁটে বসে। অথচ জীবনানন্দ দাশের চাকরি চলে যাওয়ার মূলে ছিল সিটি কলেজের ছাত্রসংখ্যার কমে যাওয়া জনিত আর্থিক সংকট।
অন্য দিকে, জীবনানন্দের যে-কবিতাটি সজনীকান্তের সমালোচনায় অশ্লীলতায় অভিযুক্ত হয় সেই কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আরও বছর তিনেক পরে (শ্রাবণ ১৩৩১)। কবিতা প্রকাশ নিয়ে ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর লেখকদের মধ্যেই বিতর্ক দেখা দেয়। জীবনানন্দের কাছে বিষ্ণু দে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য চেয়ে নিয়েছিলেন কবিতাটি।
কবিতা প্রকাশের পরে সেই ‘ক্যাম্পে’র বিরুদ্ধে সজনীকান্তের শনির দৃষ্টি পড়ে। ১৯৩১-এর সেপ্টেম্বরে ‘শনিবারের চিঠি’তে তাঁর সেই কলঙ্কিত সমালোচনা প্রকাশিত হয়। সেখানে তীব্র ব্যঙ্গবিদ্রূপে জর্জরিত করে সজনীকান্ত যে ভাবে কবিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। তা শুধু তাঁর কবিতাকেই বিমুখতার সামনে ঠেলে দেয়নি, কবি-পরিচিতিকেও ব্রাত্য করে তুলেছিল। জীবনানন্দকে ছকবন্দি মূল্যায়নে আবদ্ধ করার প্রয়াসের মধ্যে তাঁর পরিচয় অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে উঠেছিল।
আসলে সমালোচনায় ছকবন্দি প্রকৃতি অত্যন্ত সজীব এবং সবুজ। সেখানে ছকে ফেলে মূল্যায়নের প্রবণতা আপনাতেই প্রকাশমুখর। জীবনানন্দের কবি-পরিচিতিও সেই আবর্তে ছকবন্দি হয়ে পড়ে। তাঁর ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য থেকে দীপ্তি ত্রিপাঠী প্রমুখের মূল্যায়নে সেই ধারা লক্ষণীয়। সেখানে জীবনানন্দের কবি-পরিচিতিতে ‘প্রকৃতির কবি’, ‘নির্জনতার কবি’ থেকে রূপসী বাংলার কবি প্রভৃতি অভিধা আন্তরিক হয়ে উঠেছে।
দীপ্তি ত্রিপাঠী তাঁর বহুচর্চিত ‘আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৫৮)-এ কবি জীবনানন্দ দাশের আলোচনার সূচনাবাক্যেই জানানো হয়েছে, ‘এক বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দ।’ তাঁর ‘বিভ্রান্ত’ মনের পরিচয়ে কবিমানসের অস্তিত্ব-সঙ্কটের কথা উঠে এসেছে। জীবনানন্দের সমসাময়িক কবিগণ নানা ভাবে যেখানে কবিপ্রত্যয়কে খুঁজে পেয়েছিলেন, সেখানে তাঁর কবিসত্তায় কোনওরূপ প্রত্যয়হীন নীলকণ্ঠ প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সমালোচক। সে দিক থেকে যুগের অস্থিরতায় বিমূঢ়তার অবকাশ থাকলেও কবিমানসের বিভ্রান্তির পরিচয় নিয়ে বিতর্ক বর্তমান।
নানা ভাবে তাঁর কবিতায় কবিকে অভিহিত করার প্রবণতা বিষয়ে কবিও আত্মসচেতন ছিলেন এবং এ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব বক্তব্যও তিনি ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র (১৯৫৪) কবিকথায় প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, ‘প্রায় সবই আংশিক ভাবে সত্য---কোনো-কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো-কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসাবে নয়।’ লিখেছেন, ‘একটা সীমারেখা আছে এ-তারতম্যের; সেটা ছাড়িয়ে গেলে বড়ো সমালোচককে অবহিত হ’তে হয়।’ সে দিক থেকে সমালোচকদের ছকবন্দি জীবনানন্দ দাশই তাঁর পরিচয়ের অন্তরায় সৃষ্টি করেছে যা কবিকথার মধ্যেই প্রতীয়মান। তাঁকে ‘বিভ্রান্ত কবি’ বলে যে ভাবে তাঁর সংবেদী কবিচিত্তকে দিশাহীনতায় অচল করে তোলা হয়েছে, সেখানে কবি হিসাবে জীবনানন্দের দৃঢ়তা, আত্মিক সত্তায় আজীবন অবিচল থাকার বিষয়গুলিই উপেক্ষার অন্তরালে থেকে গিয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বহু নিন্দিত ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটিকে কবি কাব্যধারা থেকে বাতিল করেননি, তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’(১৯৩৬)তে শামিল করেছেন। শুধু তাই নয়, সেখানে অশ্লীলতার অভিযোগটিকেও আমল দেননি কবি। সজনীকান্তের অশ্লীল ব্যঙ্গবিদ্রুপে অতিষ্ঠ কবি লেখনীধারণও করেছিলেন।
জীবনানন্দের কবিপ্রসিদ্ধি আন্তরিক হয়ে ওঠে ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) কাব্য থেকে। বিশেষ করে কবির ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য। এটি আবার তাঁর পরের কাব্য ‘মহাপৃথিবী’র (১৯৪৪) সূচনা কবিতা। এরপর জীবনানন্দের জীবদ্দশায় একটিই কাব্য প্রকাশিত হয়, ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮)। তাঁর ইতিহাস সচেতন কবিসত্তায় পার্থিব জীবন উপভোগের সচেতন প্রত্যাশা জেগে উঠেছে সেই রিক্ততা বোধের মধ্যেও। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের বহু আলোচিত কবিতা ‘আট বছর আগের একদিন’-এর শেষ উক্তি, ‘আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।’ শুধু তাই নয়, জনগণের প্রতি যে জীবনানন্দের গভীর আস্থা ছিল, তাও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রবল ইতিহাসবোধেই। সেখানে ‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবু মানব/থেকে যায়’।
তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত কাব্য ‘বেলা অবেলা কালবেলা’(১৯৬১)-এর ‘হে হৃদয়ে’-কবির শুদ্ধ উচ্চারণ সেকথা প্রত্যয়সিদ্ধ করে তোলে: ‘ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি-রাশি দুঃখের খনি/ ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত-শত/ শত জলঝর্ণার ধ্বনি।’ সে ক্ষেত্রে জীবনানন্দের ‘বিভ্রান্ত কবি’-পরিচিতিই বিভ্রান্তির অবকাশ তৈরি করেছে। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর সবচেয়ে সাড়া জাগানো কাব্য ‘রূপসী বাংলা’র (১৯৫৭) সমাদরের পক্ষে-বিপক্ষে দু’টি মূল্যায়ন ধারা প্রকট হয়ে ওঠে। সেখানে অমলেন্দু বসু, প্রদ্যুম্ন মিত্র, আবদুল মান্নান সৈয়দ কাব্যের উৎকর্ষে মুগ্ধতা ব্যক্ত করলেও অরুণকুমার সরকার, আলোক সরকার ও অশোক মিত্র প্রমুখেরা তার বিরূপ সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত না হওয়ায় তাঁর নেতিবাচক কারণও উঠে এসেছে তাতে। অথচ সেগুলিও কবির অপত্য সৃষ্টি, অপার মহিমারই ফসল।
অর্থাৎ, জনপ্রিয়তাও জীবনানন্দের ছকবন্দি কবি-পরিচিতিকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। অথচ তাঁর কবিচেতনায় কোনোরকম বিভ্রান্তির পরশ ছিল না। সে জন্য সজনীকান্ত দাস তাঁকে ‘শনিবারের চিঠি’তে উড়িয়ে দিতে চাইলেও জীবনানন্দই রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় জুড়ে বসেছেন।
লেখক সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক