কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত যমশেরপুর ভূপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। সেখানে আশির দশকে ছাত্র ছিলাম। এই পরিবারের দু’তিন জন আমার সহপাঠী হওয়ার সুবাদে মাঝেমধ্যেই প্রাসাদোপম জমিদার বাগচী বাড়ি ঘুরতে যেতাম। কবির জন্মভিটে, নাটমন্দির, আস্তাবল, হাতিশালা, সিংহদুয়ার, নাচমহল, কবির হাতির (কালীর) সমাধি, আমবাগান, পদ্মপুকুর, চন্দনাদিঘি, নতুন বাড়ি, পুরাতন বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতাম। আর মনের মধ্যে গুনগুন করে গাইতাম— ‘‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই— মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’’ কখনও কখনও মনের অজান্তেই বলে উঠতাম— ওই যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা ‘আইরি’ খেতের আড়ে...।
কবির অমর সৃষ্টি কবিতা ‘কাজলা দিদি’ (দিদিহারা) যা পরে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে প্রতিমা বন্ধ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি অতি জনপ্রিয় গান হয়ে বাঙালির মনের মণিকোঠায় চির উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গিয়েছে। তাঁর আরও দু’টি গান এক সময়ে খুবই খ্যাতি লাভ করেছিল। শচীন দেব বর্মনের কণ্ঠে— ‘ঝুলন ঝুলিছে শ্যামরাই’ আর ‘বাইবো না আর উজান ঘরে’। তবে ‘কাজলাদিদি’ এবং ‘জন্মভূমি’ কবিতা দু’টি কবিকে বাঙালির হৃদয়ে চিরভাস্বর করে রেখেছে।
ক্যালেন্ডারের অনেক অনেক পিছনের পাতা উল্টিয়ে সেই ইংরেজি ১৬২৪ -১৭১১ সালে সৃষ্টিধর বাগচী অবিভক্ত নদিয়ার যমশেরপুর গ্রামে কাঁচা ঘরের পরিবর্তন ঘটিয়ে যে পাকা গৃহের পত্তন করেন সেই বাড়িটিই ‘পুরাতন বাগচী বাড়ি’ বলে পরিচিতি লাভ করেছিল। কালক্রমে এই বাড়িটিই রাজপ্রাসাদের আকার ধারণ করে। সৃষ্টিধরের পরবর্তী বংশধর রামনৃসিংহ বাগচী (বাংলা ১১৬৮- ১২৩২), ইনিই যমশেরপুরের আধুনিক বর্ধনশীল বাগচী বংশের আদি পুরুষ বলে পরিচিত। এর পরবর্তীতে বাংলার ১২৪৪ সালে হরিমোহন বাগচী পুরাতন বাগচী বাড়ির অনতিদূরে পত্তন করেন আর এক সুবিশাল রাজপ্রাসাদ, যেটিকে নতুন বাড়ি বল হয়।
এই উচ্চবিত্তসম্পন্ন জমিদার বাগচী পরিবারে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী ২৭ নভেম্বর ১৮৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হরিমোহন বাগচী, মাতা গিরিশমোহিনী দেবী।
বিগত বাংলা ১২৪০ থেকে ১২৫০ সাল পর্যন্ত রামগঙ্গা বাগচী নসিপুরের মহারাজা কীর্তিচাঁদের আমলে দেওয়ানির রাজ করতেন। এর পর তিনি যুগিনদা, টেকা, মজলিশপুর, বিদাড়া, পরাশপুর, কুপিলা ও যমশেরপুরের জমিদারির পত্তনী নেন। ক্রমে ক্রমে ধনে-মানে-প্রতিপত্তিতে এই বাগচী জমিদারদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পুরাতন বাড়ির মালিক জমিদার নারায়ণ বাগচীর অকালপ্রয়াত কনিষ্ঠ পুত্র ভূপেন্দ্রনারায়ণের জমিদারির অংশ যমশেরপুর উচ্চ ইংরেজি স্কুলকে দান করেন। এবং স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ স্কুলটির নাম রাখেন ‘যমশেরপুর ভূপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়’। অপর দিকে, রামগঙ্গা বাগচীর প্রথম পুত্র কৃষ্ণনারায়ণের স্ত্রী ভবসুন্দরী দেবীর নামে স্কুল সংলগ্ন ‘ভবসুন্দরী হিন্দু হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই বাগচী পরিবার যমশেরপুর গ্রামকে আদর্শপল্লিতে উন্নীত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এই উদ্দেশ্যে উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, হরিমোহন দাতব্য চিকিৎসালয়, বড় ডাকঘর, ইট-বিছানো সদর রাস্তা, একাধিক পুকুর, পানীয় জলের জন্য বড় বড় কুয়ো, শিশুদের খেলাধুলো করার জন্য গ্রামের মধ্যে হিতসাধনী মাঠ ইত্যাদি স্থাপন করেন। বিগত ১৮৩২/৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই বাগচী পরিবারের পুরাতন বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করে সমগ্র গ্রামখানিকে আনন্দ-উচ্ছল, কোলাহলমুখর করে তুলেছিলেন। এখনও দুর্গাপুজো হয়। তবে সে প্রাণ আর নেই।
কিন্তু হায়! কালের করাল গ্রাসে এই স্বর্গপুরী বাগচী বাড়ি আজ শুধুই কঙ্কালসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবির বংশের উত্তরাধিকাররা দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন। জৌলুস হারিয়ে বড় অবহেলায় পড়ে আছে কবির জন্মভিটে। এখন পড়ে আছে জরাজীর্ণ, নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত, ধূলো-ধূসরিত প্রায় ভগ্নস্তূপ অট্টালিকা। এখন ভেঙে পড়ছে খিলান-সিংহদুয়ার। দুর্গাদালানে নোংরা ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে তিনশো বছরের পুরনো পালকিটি। সময় কবেই তার চলাচল থামিয়ে দিয়েছে। বাড়ির চারপাশে জমে উঠেছে আগাছা জঙ্গল। দিনের বেলাতেও সাপখোপ, বাদুড়, চামচিকে, পেঁচা, পায়রা, মাকড়সার জালে চারপাশ পরিপূর্ণ। বিশাল স্তম্ভের সুন্দর কারুকার্য খসে খসে পড়ছে, দেওয়ালের ফোকর দিয়ে বট-পাকুড় জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছে। কবি যতীন বাগচীর সাধের লাইব্রেরি কক্ষটির দীন দশা আজ অন্তিম পর্যায়ে। দর্শনার্থীরা কবির বাড়ি দেখতে এসে শুধুই হা-হুতাশ করেন। তাঁরা আর কী-ই বা করবেন?
বাংলা বা বাঙালি কবি যতীন্দ্রমোহনকে কতটা মনে রেখেছে— এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলা যায়, নদিয়া জেলার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী যমশেরপুর গ্রামের কবিকে নিয়ে বৃহত্তর এলাকার মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং পবিত্র শ্লাঘা। তাঁর এই সারস্বত সাধনার আহ্বানে যমশেরপুর গ্রামের মাটিকে এক দিন ধন্য করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। ১৯৭৮ সালে কবির জন্মশতবর্ষ পালিত হয় কবির জন্মভিটায়। তিন দিনের অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ ঘোষ, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সংবাদভাষ্যকার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী প্রমুখ নক্ষত্রের উপস্থিতিতে।
এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম কাব্যিক অভিজ্ঞান হলেন যতীন্দ্রমোহন। এই অঞ্চলের মানুষ যতীন্দ্রমোহনের কাব্যমালঞ্চের অপরাজিতা নাগকেশরের পরাগ মেখে এখনও কবির মহাভারতী পাঞ্চজন্যে শঙ্খধ্বনির জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকেন, থাকবেন। তাই যতীন্দ্রমোহন বাগচীর অনুষঙ্গে বিশ্বকবির গান যেন বুকের মধ্যে বাজে— ‘‘তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ, ও মোর ভালবাসার ধন।’’
১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কবি ইহলোক ত্যাগ করেন। রবীন্দ্র অনুরাগী নদিয়ার সুসন্তান পল্লীকবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যপূর্ণ বাগচীবাড়ির সলিল সমাধি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কবির জন্মভিটেকে ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ ঘোষণা করে সংরক্ষণ করা আশু প্রয়োজন। না হলে ভাবীকাল আমাদের ক্ষমা করবে না।
ঋণস্বীকার:
১। যতীন্দ্রমোহন রচনাবলী, পঃবঃ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।
২। কবি যতীন্দ্র বাগচী শ্রদ্ধাঞ্জলি সংখ্যা , ‘সবুজের কবিতা’।
৩। প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, প্রণব আচার্য, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়।
শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক