আমাদের নরেন্দ্রপুরের প্রাক্তন ছাত্র অনুজপ্রতিম অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় উত্তরপ্রদেশ সম্পর্কে আমার কয়েকটি প্রতিবেদন পড়ে বলেছে, তোমার লেখাগুলি থেকে এটা কিন্তু জানতে পারলাম না, উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলাফলে কে জিতছে আর কে হারছে?
অভিজিৎ জানতে চাইছে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি কি ক্ষমতায় এ বার আসবে উত্তরপ্রদেশে? না কি মায়াবতী? না কি অখিলেশ-কংগ্রেসের জুটির হাওয়ার দাপট আছে অন্তঃসলিলা?
সত্যি কথা বলছি, সংবাদপত্র জগতের বাইরের লোকেরা আমাদের ব্যাপারে একটু বেশিই উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। আমরা যেন সবাই বিধান রায়ের মতো নাড়ি টেপা ডাক্তার। উত্তরপ্রদেশে ৪০৩টি আসন। বিশাল এক রাজ্য। দু’-তিন দিনের জন্য গেলাম, ১০টা বিধানসভা কেন্দ্র ঘুরলাম আর গোটা রাজ্যে কোটি কোটি ভোটার কী ভাবছে তা বুঝে ফেললাম? ব্যাপারটা আমার কাছে অন্তত এতটা সহজ নয়।
আমি নিজে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। সার্ভে মেথডোলজি (Survey methodology) একটা বিষয় ছিল আমার। ঠিক কত জনকে ‘স্যাম্পল’ করা হচ্ছে, কত জন সত্য কথা বলছে, এ সব কিন্তু বোঝা অত সহজ কাজ নয়। যে কারণে আজকাল নাড়িটেপা ডাক্তারদের দিন শেষ। এখন তো আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, ইসিজি, ট্রেডমিল, অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি— শুধু হৃদয়ে ‘ব্লক’ আছে কি না, সেটা দেখার জন্যই কত পরীক্ষা করতে হয়!
আসলে নির্বাচনী প্রচার কে কী ভাবে করছে, ভোটের বৈশিষ্ট্য কী কী? আমরা সাংবাদিকরা এই সব ‘কভার’ করতে যাই। আমি যেমন অখিলেশ এবং রাহুলের ইলাহাবাদে রোড শো দেখতে গেলাম, ওই এলাকায় এই রোড শোয়ের প্রভাব কতখানি তা বোঝার জন্য। আমরা সাংবাদিকরা কিন্তু ভোট-সমীক্ষা করতে যাই না। সমীক্ষা করার জন্য অন্য অনেক সংস্থা আছে, তারাও বহু ক্ষেত্রে ঠিক ভাবে স্যাম্পলিং (sampling) বা ইন্ডাক্টিভ মেথড (Inductive method) প্রয়োগ না করার ফলে ভুলের শিকার হয়। হতে পারে আজও কিছু কিছু নাড়িটেপা ধন্বন্তরি আছেন, যাঁরা ভোটের কুরুক্ষেত্রে গিয়ে একটা গন্ধ পান, হাওয়া কোন দিকে!
উত্তরপ্রদেশ আজও বিশাল রাজ্য। ৪০৩টি বিধানসভা আসন। উত্তরাখণ্ড পৃথক রাজ্য হওয়ার আগে (২০০০ সালে) এক বার এ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন কভার করেছিলাম। ট্রেনে ও রাজ্য সরকারের পরিবহণ নিগমের বাসে করে, সে বার দিল্লির আইএসবিটি বাস আড্ডা থেকে যাত্রা শুরু করে প্রথমে বেরিলি যাই, সেখান থেকে পিলিভিট। তারপর কানপুর, লখনউ-অমেঠী রায়বরেলী, ইলাহাবাদ, বারাণসী— সে সব দিনের স্মৃতি এখনও সমুজ্জ্বল।
সেই উত্তরপ্রদেশ আজও ‘উল্টা প্রদেশ।’ হয়ত আমার পারিবারিক জীবনের শিকড় আছে এ রাজ্যে তাই আমাকে মধ্যপ্রদেশের চেয়েও উত্তরপ্রদেশ বেশি আকর্ষণ করে। মধ্যপ্রদেশ ছিমছাম পর্যটন কেন্দ্র, কিন্তু উত্তরপ্রদেশ জাতপাত, ধর্ম, কত স্তর, কত মজা। অভিজিৎ তবু বলবে, যাক বাজে কথা রাখো। মোদ্দা কথাটা বলো, জিতবে কে? তোমার লেখা পড়ে জানতে পারলাম না কে জিতবে?
৪০৩টি আসনের মধ্যে ইলাহাবাদে আছে ১২টি আসন। এর মধ্যে ইলাহাবাদ শহরের পূর্ব ও পশ্চিম দু’টি কেন্দ্র ঘুরলাম। রাহুল এবং অখিলেশের যুগ্ম রোড শো কভার করাটা ছিল লক্ষ্য। এ ছাড়া রাহুলকে অনুসরণ করে একটি তফসিলি জাতি-উপজাতি আসন ঘোরাও হল। এর পর ইলাহাবাদ থেকে এলাম অমেঠী। আসার পথে আর কয়েকটি বিধানসভা কেন্দ্র। অমেঠীতে আছে চারটি বিধানসভা কেন্দ্র। দু’দিন ওখানে থেকেও ঘুরলাম।
এ ছাড়া নানা স্থানের মানুষ, লখনউ বিমানবন্দর আসার সময় গাড়ির চালক রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় (নামেই বাঙালি) আর লখনউ বিমানবন্দরে অমিতাভ তালুকদার, বেরিলিতে তিন বছর একটানা আছেন। পঞ্জাব ও সিন্ধ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। বেহালায় বাড়ি। স্ত্রী পুত্র (আট বছর বয়স) এদের সঙ্গে কথা বলা। নানা কথা শোনা।
ত্রিশঙ্কু হবে না হবে না? কারণ আজকাল মানুষ ক্রমশ নিশ্চিত ভাবে ভোট দিচ্ছেন একটি দিকে। কিন্তু চোরাস্রোত থাকতে পারে। যা হোক, এটা কি বলতে পারি যে সর্বভারতীয় ফ্যাক্টর ও স্থানীয় কারণ মিলেমিশে আছে, কিন্তু দিল্লি থেকে শুধুমাত্র মোদী ফ্যাক্টর দিয়ে এ বার রাজ্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বরং, এ বার বিষয় উল্টো। উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলই বরং জাতীয় রাজনীতিতে বিপুল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক সেই রামমন্দির আন্দোলনের সময় থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। তখন লালকৃষ্ণ আডবাণী রামমন্দির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অথচ উত্তরপ্রদেশে প্রধান মুখ হল অটলবিহারী বাজপেয়ীর ব্রাহ্মণ মুখ।
জনসঙ্ঘের আমলেও কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জনসঙ্ঘের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু এ বার কি বিজেপির হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে অবক্ষয় হবে? সেটা হচ্ছে তো বটেই। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে জাঠ ভোটে ভাঙন এসেছে। নানা স্থানে বৈশ্য ভোটে ভাঙন এসেছে। নোট স্থগিতের সিদ্ধান্তের জন্য। বহু স্থানে আরএসএস খুশি নয়। তারা মোদী-অমিত শাহের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে প্রার্থী মনোনয়ন থেকে বহু মাইক্রো ইস্যুতে নিজেদের কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি, তাই তারা ক্ষিপ্ত।
তৃতীয় দফার ভোটের পর ইলাহাবাদ-বারাণসী এলাকায় কবরস্থান নিয়ে মোদীর বক্তব্য মেরুকরণের রাজনীতি। কিন্তু এই পুরনো কৌশল বিজেপির সাবেক ভোটব্যাঙ্কের অবক্ষয়কে থামাতে পারবে, এটা মনে করছেন বিজেপি নেতারা। আবার এই মেরুকরণের রাজনীতির ফলে মুসলমান ভোট মায়াবতীর দিকে অনেকটা চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমবে, মুসলিমরা অখিলেশ-রাহুলের দিকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে।
ওয়েসিকে প্রচার দেওয়াটাও বিজেপিরই রণকৌশল। আমার মনে হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ-রাহুল জোট এক নতুন ভবিষ্যতের প্রত্যাশাকামী জনগোষ্ঠী বা শ্রেণি তৈরি করছে। কংগ্রেসের অবস্থা খুব খারাপ উত্তরপ্রদেশে। তাই রাহুল যা করছেন, তা ঠিক কাজই করছেন। কিন্তু বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাঙ্ক মেরুকরণের রাজনীতির ফলে যে উজ্জীবিত নয়, তাও বলা যায় না। অখিলেশ যেমন তার দলের সাবেক মুসলিম ও যাদব ভোটব্যাঙ্কের ঊর্ধ্বে উঠতে চাইছেন। প্রসারিত করতে চাইছেন জনভিত্তিকে। সে ভাবে মায়াবতীও দলিত ভোটের সঙ্গে যোগ করতে চাইছেন উচ্চবর্ণের হিন্দুভোটকে। সবাই জানে, শুধু নিজেদের ভোট ব্যাঙ্কে জয় সুনিশ্চিত হবে না, তাই সকলেরই আরও আরও ভোট চাই। আরও আরও ভোট দাও নীতি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে? কে কতগুলি আসন পাবে তার ভবিষ্যৎবাণী করতে পারছি না। তবে এটুকু বলছি, এ বারও রাজ্যের মানুষ যদি উন্নয়নকেই প্রধান বিচার্য বিষয় না করে তবে কিন্তু দুর্ভোগ এ রাজ্যের মানুষেরই।
(এখন থেকে ‘শাহি সমাচার’ বুধবারের পরিবর্তে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।)