নাগরিক অধিকার রক্ষায় আইনের অভাব নাই। নাগরিকের কর্তব্য মনে করাইতে আইনের সংখ্যা সামান্য। এ বার তেমন একটি আইন আনিতেছে পশ্চিমবঙ্গ। কাহারও ঘরে ডেঙ্গি মশার কীট মিলিলে তাহার জরিমানা করা হইবে। অবশ্য গৃহস্থের ঘরে ঢুকিয়া মশক-কীট অনুসন্ধানের বিধি ইতিপূর্বেই ছিল। কিন্তু সেই ব্রিটিশ আমল হইতেই বিষয়টি লইয়া গৃহস্থের সহিত স্বাস্থ্যকর্মী এবং পুরকর্মীদের সংঘাত হইয়া আসিতেছে। গৃহস্থের ঘর তাহার ব্যক্তিগত পরিসর, সেখানে সরকারি প্রতিনিধিকে ঢুকিতে না দিবার অধিকার তাহার আছে। ব্যক্তির অধিকারকে রক্ষা করিবার কর্তব্য গণতান্ত্রিক প্রশাসনের কেন্দ্রে, অনস্বীকার্য। জনপ্রতিনিধিরাও জনরোষের ভয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের বিপরীতেই অবস্থান লইতেন। তাই ঘরে ঘরে নজরদারির বিধি স্বাস্থ্যকর্মীরা কার্যক্ষেত্রে পালন করিতে পারে নাই। কিন্তু রাজ্যে ডেঙ্গি করাল রূপ ধারণ করিয়াছে, নানা গৃহের জলাধার হইতে মশার কীটও মিলিয়াছে। মহামারির সম্মুখে দাঁড়াইয়া ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তা রক্ষার তুলনায় জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিয়াছে রাজ্য। এই অবস্থান অযৌক্তিক নহে। মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নাই। নিয়মিত সচেতনতা অভিযান চালাইয়াও একশো শতাংশ মানুষকে সতর্ক ও সক্রিয় করা এক প্রকার অসম্ভব। নজরদারি ও জরিমানার প্রয়োজন আছে।
একই কারণে আবর্জনা যত্রতত্র ফেলিবার অভ্যাস আটকাইতে বিধানসভা পুরএলাকার একটি ওয়ার্ডে সিসিটিভি লাগাইবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায়। আবর্জনা সংগ্রহ করিবার গাড়ি দাঁড় করাইয়া রাখা সত্ত্বেও রাস্তার ধারে কিংবা খালে আবর্জনা ফেলিবার অভ্যাসটি যেন গৃহস্থের মজ্জাগত। ইহাতে দৃশ্যদূষণ, জলের দূষণ, দুর্গন্ধ যেমন হয়, তেমনই মশা-মাছি বংশবৃদ্ধির সুযোগ পায়। কলিকাতা ও বিধানসভায় গৃহস্থের আবর্জনা সংগ্রহের রীতি পূর্বের তুলনায় কার্যকর হইয়াছে। তবু রাস্তা ও জলাশয়গুলিতে নিত্য আবর্জনা পড়িতেছে। উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে, বনেদি পাড়াতেও ঘরের জঞ্জাল রাস্তায় ফেলিয়া গৃহস্থের কর্তব্য শেষ হয়। তাঁহারা ইহার অপকারিতা বুঝেন না, এমন নহে। কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস।
অভ্যাসের চক্রপথ ভাঙিতেই জরিমানার মতো আঘাতের প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলি সৌন্দর্য হইতে স্বাস্থ্য, সকল বিষয়েই বিধি বলবৎ করিয়াছে। বাগানের ঘাস না ছাঁটিলে, ঘরের বাহিরে কাপড় মেলিলে, ঘরের সামনের ফুটপাত হইতে বরফ পরিষ্কার না করিলে, আবর্জনা ঠিক সময়ে ঠিক স্থানে পৌঁছাইয়া না দিলে জরিমানা হইবে। পাশ্চাত্যের নানা দেশে পরিচ্ছন্ন, সুদৃশ্য শহর দেখিয়া আমরা মুগ্ধ হই, তাহার কারণ অলক্ষ্যে কাজ করিতেছে কঠোর নিয়ম। নিয়ত নজরদারি ও নিশ্চিত শাস্তির বিধি সক্রিয়। অতএব আইনের প্রয়োজনীয়তা লইয়া প্রশ্ন নাই। প্রশ্ন দুইটি। এক, কলিকাতায় ঘরে ঘরে নিয়মিত নজরদারি চালাইবার মতো কর্মী কি আছে? দুই, সরকারি হাসপাতাল, দফতর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে মশার কীট মিলিলে একই নিয়মে শাস্তি হইবে কি? মশাপালক মন্ত্রী-নেতাদেরও জরিমানা করিবে তো পুরসভা? যদি সুবিধা বুঝিয়া বিধির প্রয়োগ হয়, বেগতিক বুঝিলে চক্ষু বুজিয়া থাকেন পুরকর্তারা, অবিচার হইবে।