ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়

দেশের জন্য স্বার্থত্যাগ করো। সেই দেশের জন্য দূর থেকে যার জয়ধ্বনি দেন ক্ষমতাবানরা।   কিন্তু যার জন্য তাঁদের জীবনভর স্বার্থত্যাগ তার নিয়ামকরা এঁদের কী দেন?

Advertisement

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:১৯
Share:

আটটায় প্রথম খেয়া। এরই মধ্যে ভিড়, বিকেল চারটের মধ্যে ফিরতে হবে। হাতে, অতএব, মাত্র আট ঘণ্টা। এর মধ্যে আবার দুটো ঘণ্টা যায় যাতায়াতে, ঘাটে বসে থাকা বিএসএফ জওয়ানের কাছে জিনিসপত্র পরীক্ষা, নাম লেখানো, ভোটার কার্ড জমাফেরিতে উঠতেই আধ ঘণ্টা কাবার। আবার চরে পৌঁছে মাইলখানেক হেঁটে নিজের ভুঁই। সারা দিন হাজার কাজ, কিয়দ্দিন পর সে ভুঁই যে সবুজে ভরে যাবে, ফুল আসবে, ফসল শুরু হবে, সে সবই তো আসলে ফলন্ত মেহনত। যত খাটবে, যত যত্ন নেবে, খেত ততই উজাড় করে দেবেফসল থেকেই সংবৎসর সংসার চালানো। সে জন্যই জীবিকার কথা বললে তাঁরা বলেন, ‘চাষবাস’— চাষেই বাস। কৃষিক্ষেত্র তাঁদের ভুঁই, সেটাই তাঁদের দেশ, যা থাকা মানে তাঁদের জীবন থাকা। সেই দেশের পরিচর্যায় তাঁদের নিত্য ভাগীরথীর এই ধারা পেরিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের সীমানার ধারে, দুই রাষ্ট্রের মাঝখানে তাঁদের জমি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাছে অন্য সব গৌণ, তার জন্য মুর্শিদাবাদের মুরাদপুর, চর লবণগোলা, এবং দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় সীমান্তের অন্য জনপদগুলোতে লোকেদের একটু কষ্ট সইতেই হবে। নিরাপত্তার প্রশ্ন, অতএব তারকাঁটা, ফাটক। কিন্তু চাষের কাজের দাবিটা সরকারি রুটিন মেনে হয় না। যেমন, প্রখর গ্রীষ্মে ভোররাত্রি থেকে কাজে লাগা, দুপুরে বিরাম, আবার সন্ধ্যার অনেকটা পর পর্যন্ত কাজ করে যাওয়াটাই প্রকৃতি নির্দিষ্ট। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন ভিন্নতর, তার কড়াকড়ির কাছে প্রকৃতিকে হার মানতে হয়।

Advertisement

দাবি, দেশের জন্য স্বার্থত্যাগ করো। সেই দেশের জন্য দূর থেকে যার জয়ধ্বনি দেন ক্ষমতাবানরা। কিন্তু যার জন্য তাঁদের জীবনভর স্বার্থত্যাগ তার নিয়ামকরা এঁদের কী দেন? প্রকৃতি বিরূপ হলে অজন্মা। স্বদেশে কাজ নেই, বাণিজ্য-ব্যাপার যেটুকু আছে, ভারত রাষ্ট্রের ফরমানে তা বেআইনি। তাও তাঁদের করতে হয়, প্রহরীকে উৎকোচ দেওয়ার পরও প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই পাচারে-চালানে যোগ দিতে হয়। তার পরও অনির্বাণ ক্ষুধা। পেটের টানে বেরিয়ে পড়তে হয় ‘ভারতমাতা’র নানা প্রান্তে, যা তাঁদের কাছে বিদেশ।

তাঁরা বহু অর্থে প্রান্তবাসী— ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক। অর্থগুলো একে অন্যের থেকে অবিচ্ছেদ্য। তাঁরা প্রধানত দলিত অথবা মুসলমান, গরিব। রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁদের খুঁটি নেই, তার ওপর মুসলমান হলে তো কথাই নেই, ক্ষমতার সহস্রচক্ষুতে নিরন্তর সন্দেহ বিচ্ছুরণবিদেশি অনুপ্রবেশকারী, দেশদ্রোহী, নিদেন রাষ্ট্রদ্রোহীদের চর! যে বাঙালি মুসলমানরা অসম প্রদেশের বিস্তীর্ণ চর এলাকায় জলাজমির চাষের প্রবর্তন করলেন, নির্বাচনী তালিকায় তাঁদের নামের পাশে লেখা হয়ে যাচ্ছে, ‘ডি’— ডাউটফুল, সন্দেহভাজন। মালদহের কর্মসন্ধানে দেশান্তরী মুসলমান মুম্বইতে হয়ে যান বিদেশি বাংলাদেশি। (যদি বাংলাদেশি হনও, তা হলেও কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয় সে প্রশ্ন না হয় মুলতুবি রাখা গেল।)

Advertisement

অন্যপক্ষে, কল্যাণরাষ্ট্রের হাত কেড়ে নেওয়াতে যত ব্যগ্রতা, ঘোষিত কর্তব্য পালনে ততটাই কুণ্ঠা। রাস্তাঘাট, পরিপার্শ্ব, ঘরবাড়ি— সর্বত্র অবমাননা ও দারিদ্রের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। শিক্ষা স্বপ্নেও ধরা দেয় না: মূল ভূখণ্ডেই যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা জরাজীর্ণ, সেখানে এই প্রান্তদেশে অবস্থাটা কী, কল্পনা করতেও সাহসে কুলোয় না। ইশকুল আছে তো মাস্টার নেই, থাকলেও তাঁর আগমন ঘটে ‘বিদেশ’ থেকে, যাঁর সঙ্গে এঁদের শিশুদের আত্মীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠাটা অসম্ভব না হলেও এ মুহূর্তে অলৌকিকের কাছাকাছি। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিরাকার। দক্ষিণ দিনাজপুরের হাড়িপুকুরে যদি রাতবিরেতে কারও প্রসবযন্ত্রণা ওঠে, তাকে ভারত রাষ্ট্রের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, ফাটক খোলা পর্যন্ত শিশুজন্ম আটকে রাখার মতো কৌশল লোকেরা শেখেননি। রাষ্ট্রকল্প ভারতমাতার কল্যাণস্পর্শ নয়, লোকেদের জন্য উঁচানো থাকে বেয়নেট। একটাই গ্রাম, সেটাই তাঁদের দেশ, কিন্তু দুই রাষ্ট্রের অধিকারে, দুই রাষ্ট্রের সেনাপ্রহরায়। তাঁদের শুধু প্রাণে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে যেন দেখা দেন আমাদের পূর্ব-আধুনিক জনকজননী। তফাত এই, আদিকালে সকলকেই দুর্ভাগ্যপীড়িত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য লড়তে হত, আর আজ সেই ধারা বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে একাংশের উত্তরপ্রজন্মকে।

একমাত্রিক নির্বাচনী গণতন্ত্রে অভ্যস্ত ভারতের কাছে সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অন্যায্যতার শিকার কত লোক, তা-ই দিয়ে ঠিক হয় তার গুরুত্ব। অতএব, সংখ্যাগণিতে পটু ভারতরাষ্ট্রের বিধাতারা বলবেন, সীমানার কিছু লোককে তো কষ্ট ভোগ করতেই হবে। এক জন মানুষও কেন ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত থাকবেন, সেই মৌলিক প্রশ্নটা যদি সরিয়েও রাখি, সংখ্যার বিচারেও ভৌগোলিক প্রান্তবাসীদের অবজ্ঞা করা কঠিন। ৪১৫৬ কিলোমিটার জুড়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমানা, যার অর্ধেকের বেশি (৫৩ শতাংশ) পশ্চিমবঙ্গে। ঘনবসতিপূর্ণ এই অঞ্চলে, অতএব, বাসিন্দার সংখ্যা নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। কিন্তু, ক্ষমতা-রাষ্ট্র দাবি আদায় করতে জানে।

মুক্তবুদ্ধির চোখে, লোকেদের দাবি সামান্যরাষ্ট্রীয় নিয়মে ঈষৎ শৈথিল্য, যাতে তাঁদের জীবনে কঠোরতার মাত্রাটা একটু কম হয়; নিজের দেশে, স্বভূমিতে যাতে তাঁরা একটুখানি স্বাধীন ভাবে বিচরণ করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে, ‘ওরা’ মূর্খ, অজ্ঞান, রাষ্ট্রের বৃহত্ত্ব ও বৃহৎ চাহিদা বোঝে না। ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement