Social Media

ঘৃণার বেসাতি

ইন্টারনেটে যাহারা প্রত্যহ বর্বরতা করিয়া চলিয়াছে, তাহারা আইটি সেলের অর্থানুকূল্যে পুষ্ট হইলে, তাহা এক অর্থে স্বস্তিকর হইত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ০৩:২১
Share:

এই বিজ্ঞাপন ঘিরেই বিতর্ক। ছবি: ভিডিয়ো গ্র্যাব।

দেশ কী ভাবে চলিবে, তাহা স্থির করিবার অধিকারটি এখন বোধ হয় ইন্টারনেট-জঙ্গিদের হাতেই। শোনা যায়, সেই জঙ্গিদের একটি বৃহদংশ বিজেপির ‘আইটি সেল’-এর অর্থে প্রতিপালিত। একটি গহনা বিক্রেতা সংস্থা সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিয়াছিল— এক মুসলমান পরিবার তাহার হিন্দু ঘর হইতে আগত পুত্রবধূর প্রতি স্নেহ প্রকাশ করিতেছে। ইন্টারনেট-জঙ্গিরা ‘লাভ জেহাদ’-এর ধুয়া তুলিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িল— বিজ্ঞাপনটি নাকি হিন্দু মেয়েদের ফুসলাইয়া বিবাহ, ও তৎসূত্রে ধর্মান্তরিত করিবার ‘ইসলামি চক্রান্ত’-কে প্রশ্রয় দিতেছে। ভালবাসা, সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে এই বিদ্বেষবিষের কারবারিদের সহিত তর্ক করা বৃথা। কিন্তু, রাষ্ট্র কী ভাবে এই বেয়াদবিকে বরদাস্ত করিতে পারে, কী ভাবে মানিয়া লইতে পারে যে, নাগরিক জীবন পরিচালিত হইবে কিছু উগ্রবাদীর অঙ্গুলিহেলনে, সেই প্রশ্নগুলি অপরিহার্য। বস্তুত, সুশান্ত সিংহ রাজপুত মামলায় অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীর সহিত কোনটির পর কোন ঘটনাটি ঘটিবে, কার্যত তাহা স্থির করিয়া দিতেছিল এই ‘ট্রোল’বাহিনী। আইটি সেল-এর ইতিবৃত্ত এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা করিয়া কেহ বলিতেই পারেন, রাষ্ট্র শুধু এই বেয়াদবির প্রতি ক্ষমাশীলই নহে, তাহার সমর্থন অনতিপ্রচ্ছন্ন। পরিস্থিতি এমনই যে, সংস্থাটি পত্রপাঠ বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছে। জানাইয়াছে, বিপণি ও কর্মীদের সম্ভাব্য ক্ষতি ঠেকাইতেই এই পদক্ষেপ। রাষ্ট্রের নিকট মতামত বা মতাদর্শ-নির্বিশেষে নাগরিকের বা প্রতিষ্ঠানের যে নিরাপত্তা প্রাপ্য, এই ভারতে তাহার আশা নিতান্তই অলীক।

Advertisement

ইন্টারনেটে যাহারা প্রত্যহ বর্বরতা করিয়া চলিয়াছে, তাহারা আইটি সেলের অর্থানুকূল্যে পুষ্ট হইলে, তাহা এক অর্থে স্বস্তিকর হইত। দুর্ভাগ্যক্রমে, ঘটনা তাহা নহে। ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের পাশাপাশি, নেটের উগ্রবাদীদের একটি বড় অংশ স্বেচ্ছা-কর্মী। সংগঠিত ভাবে যে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ছড়ানো হয়, তাহারা স্বেচ্ছায় তাহার বাহক হইয়া উঠে। বস্তুত, উগ্রতাবাদী রাষ্ট্র যাহা ভাবে, এই ট্রোল-বাহিনী তাহারই মূর্ত প্রতীক। ভিন্ন মত, ভিন্ন রুচি, ভিন্ন আদর্শের সহিত যে বৈরী ব্যতীতও সম্পর্ক হইতে পারে, নেট-জঙ্গিরা তাহা জানেও না, মানেও না। বিপরীত মতের সহিত আলোচনাসূত্রে আবদ্ধ হওয়া, পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে বিপ্রতীপ অবস্থানটিকে বুঝিতে চেষ্টা করা এবং নিজের অবস্থানটিকে বোঝানো, সবই শিক্ষাসাধ্য কাজ। তাহার জন্য মন খুলিতে হয়, শিখিতে হয়, ভাবিতে হয়। ঘৃণা ছড়াইয়া দেওয়া অনেক সহজ কাজ। তাহার জন্য শুধু আদিম প্রবৃত্তিগুলিকে বেলাগাম করিলেই চলে। ঘটনা হইল, অসহিষ্ণু রাষ্ট্রশক্তি এই বর্বরতাকে নিজের অতি সঙ্কীর্ণ স্বার্থে প্রশ্রয় দিয়া চলিতেছে।

প্রশ্রয় দিতেছে, কারণ এই অসহিষ্ণু জনতাই উদ্দিষ্ট হিন্দুরাষ্ট্রের নাগরিক। তাহারাই অণু-পরমাণু হইয়া গড়িতেছে সেই সঙ্কীর্ণমনা রাষ্ট্রের অবয়ব। অথবা, যে ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী ভারতকে আমরা পাইয়াছিলাম পূর্বসূরি রাষ্ট্রনায়কদের ভিন্নতর সাধনার ফল হিসাবে, তাহার অন্তরে এমন গভীর রূপান্তর ঘটাইতেছে, যেন তাহা নিজেরও অজ্ঞাত, অপরিচিত হইয়া যায়। আবার অন্য দিকে, সেই রাষ্ট্র নিজের গতিতে গড়িয়া লইতেছে তাহার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের। যে কোনও প্রক্রিয়ার ন্যায় এই প্রক্রিয়াটিও উভমুখী। এবং, তাহা স্বয়ম্ভু নহে। প্রক্রিয়াটির সূত্র নিহিত আছে অতীতে, এবং সেই অতীতের সূত্র আছে আরও অতীতে। দেশবাসীর এক বড় অংশ যখন এই অসহিষ্ণু বিদ্বেষের রাজনীতিকেই জয়যুক্ত করিয়াছিল, তাহাতেই কি নিহিত ছিল না ঘৃণাকে এই ভাবে সামাজিক স্বীকৃতি দিবার বীজ? এই ট্রোল-বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে না দেখিয়া বৃহত্তর সামাজিক রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলেই হয়তো এই বিষের স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement