রাষ্ট্র এখন সমাজের একাংশকে ‘বিদেশি’ প্রমাণ করতে অতি ব্যস্ত

এই বিলে নাগরিকত্ব কোথায়

১৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করে, পাঁচ বছর সময়ে, দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে যে নাগরিক পঞ্জি তৈরি হল, তা এখন সরকারই গ্রহণ করতে রাজি নয়।

Advertisement

জয়দীপ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

গত বুধবার কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সভায় প্রত্যাশিত ভাবেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে নবরূপের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ, সোমবারই লোকসভায় পেশ করা হবে এই বিতর্কিত বিল। শাসক দলের সংখ্যাধিক্যের কারণে সংসদের নিম্নতর কক্ষে বিলটি অবশ্যই পাশ হবে। রাজ্যসভায় বিজেপি এবং সহযোগী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তবে সরকার আশাবাদী— ষোড়শ লোকসভার পুনরাবৃত্তি এ বার হবে না। এই বছরেই জানুয়ারি মাসে সংখ্যা নিয়ে সংশয়ী সরকার ২০১৬’র সংশোধনী বিলটিকে রাজ্যসভায় উত্থাপন করেনি। কিন্তু এ বার মোদী-শাহ চূড়ান্ত আশাবাদী যে, নাগরিকত্ব আইনে প্রস্তাবিত এই ‘যুগান্তকারী’ পরিবর্তন সংসদের উভয় সদনেরই সায় পাবে। প্রবল হিন্দু জাতীয়তাবাদী আবেগে এই বিল আইনে পরিণত হওয়া এখন হয়তো কেবল সংক্ষিপ্ত সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু এত ঢাকঢোল পিটিয়ে যে আইন আসছে তা কি সত্যিই দেশভাগের শিকার ছিন্নমূল অ-নাগরিক এবং তাঁদের সন্তানসন্ততি ও পরবর্তী প্রজন্মকে বহুকাঙ্ক্ষিত নাগরিকত্ব দিতে সক্ষম?

Advertisement

এই বিলে যা যা রয়েছে, তা খুব সহজ করে বললে এই দাঁড়ায় যে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর যাঁরা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় ভূখণ্ডে স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য প্রবেশ করেছেন, তাঁরা আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন না। ফলে, এই বিল আইনে পরিণত হলে এঁরা ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, বর্তমান আইনেও কিন্তু কোনও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করারই যোগ্য নন। এ ছাড়াও অন্য একটি পরিবর্তনের প্রস্তাবও বিলে রয়েছে। ন্যাচারাইলেজ়শন-এর, অর্থাৎ এই দেশে থাকতে থাকতে এক জন বিদেশি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ-দেশি হয়ে গিয়েছেন— এই নিয়মের সুযোগ নিয়ে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে এগারো বছর অপেক্ষা করতে হত। প্রস্তাবিত সংশোধনী বিলে এই অপেক্ষার প্রহর কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। ২০১৬’র ১৯ জুলাই প্রথম বারের মতো যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লোকসভায় পেশ করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, তাতেও উপরের কথাগুলি মোটামুটি একই রকম ছিল। কিন্তু বর্তমান বিলে বেশ কিছু বাড়তি প্রস্তাব রয়েছে, যা আমাদের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।

আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা বিভাজিত দেশের নাগরিকত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে খুব

Advertisement

বেশি বজ্রআঁটুনির আশ্রয় নেননি। সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৫ থেকে ১১— এই সাতটি অনুচ্ছেদেই নাগরিকত্ব নিরূপণ, প্রাপ্তি, গ্রহণ ও বর্জনের মতো জটিল বিষয়গুলির বর্ণনা সেরে ফেলা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইকে প্রাথমিক ভিত্তি-তারিখ হিসেবে রেখে, নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সব খুঁটিনাটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে পরবর্তী সরকার ও সংসদের হাতে। নাগরিকত্ব দেওয়া ও কেড়ে নেওয়া দুই-ই একাদশ অনুচ্ছেদ-মতে, সংসদের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। সেইমতো, ১৯৫৫ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রথম বারের মতো আমরা পেলাম নাগরিকত্ব আইন।

আইনের জটিল গলি-উপগলি-তস্যগলিতে না ঢুকেও একটি বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ে। তা হল, আমাদের দেশে প্রথম দর্শনে সবাইকে নাগরিক হিসেবেই গণ্য করা হয়। অর্থাৎ, জুরিসপ্রুডেন্স-এর মূল কথাটি নাগরিকত্ব আইন এবং এই সংক্রান্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থায় মেনে চলা হয়। অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সবাই নিরপরাধ। একই যুক্তি অনুসারে নাগরিকত্বের বেলায় কথাটা দাঁড়ায় এ রকম— যত ক্ষণ পর্যন্ত কাউকে বিদেশি হিসেবে কাঠগড়ায় তুলে প্রমাণ না করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তিনি নিশ্চিত ভাবে ভারতীয় নাগরিক।

সমস্যা দাঁড়ায়, যখন সরকার নিজের থেকে নাগরিকদের মধ্য থেকে একাংশকে অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করতে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে যে আইনটির আশ্রয় নেওয়া হয়, তা হল ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬। ব্রিটিশ ভারতে গৃহীত এই আইনের ধারা নাগরিকদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। ভারত রাষ্ট্র যদি কাউকে বিদেশি হিসেবে দেগে দেয়, তা হলে তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে, সে স্বদেশি। নিজেকে নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণ করার দায় যখন অভিযুক্তের উপর বর্তায়, তখন সেই আইন গণতান্ত্রিক চেহারা হারিয়ে ফেলে।

অসমে অনাগরিক তৈরি করার এই প্রক্রিয়াটিই আমরা বছর ছয়েক ধরে দেখছি। এনআরসি আসলে সেই আইনসঙ্গত ও রাষ্ট্র-নির্দেশিত ও বিচারালয়-বন্দিত পদ্ধতি, যার মাধ্যমে উনিশ লক্ষ মানুষকে অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে এক উদ্বেগ ও আশঙ্কার মাঝে রেখে দেওয়া হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশ হওয়ার তিন মাস পর এখনও রেজিস্ট্রার জেনারেল এই নাগরিক পঞ্জি অনুমোদন করেননি। যাদের উৎসাহের আতিশয্যে ও দাবিতে এনআরসি শুধুমাত্র অসম রাজ্যের জন্য তৈরি হল, অসমের সেই শাসক দল বিজেপিও কার্যত এই এনআরসি-কে প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৬০০ কোটি টাকা (সরকারি হিসেবে) ব্যয় করে পাঁচ বছর সময়ে দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে যে নাগরিক পঞ্জি তৈরি হল, তা এখন, বলা যায়, সরকারই গ্রহণ করতে রাজি নয়। এমন ঘটনা দেশে কস্মিন কালেও ঘটেনি।

কিন্তু এই ব্যর্থ প্রক্রিয়াটিকেই গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৎপর বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকার। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, দেশব্যাপী এনআরসি ও তার আগেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করানোর এই তৎপরতার পিছনে রাজনৈতিক হিসেবটি কী?

সঙ্ঘপরিবার আশ্রিত বিজেপির দীর্ঘমেয়াদি আজেন্ডায় রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা। তা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিতে সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। যুক্তি হচ্ছে এই— দেশ যে হেতু ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যে হেতু আজও ইসলামিক রাষ্ট্র, তবে ভারতের মুসলমানরা কেন রাজনীতিতে নিয়ামক শক্তি হয়ে এই দেশে থাকবেন! নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষকে ১৯৫১ সালে পিছিয়ে দেওয়ার দাবি আসলে ওই নীল নকশারই অঙ্গ। অসমের বেলা এনআরসি-তে নাগরিকত্ব নির্ধারণের তারিখটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ মাঝরাত। বিজেপি বিভিন্ন নেতারা খোলাখুলিই বলেছেন ও বলছেন, এর ফলেই এক কোটি মুসলমান এনআরসি-তে নাম তুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এই নাগরিক পঞ্জি তাই বাতিল করতে হবে। ভিত্তিবর্ষকে পিছিয়ে দিতে হবে ১৯৫১ পর্যন্ত। কিন্তু তাতে তো হিন্দু-মুসলমান সবার পক্ষেই নথি দিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা শক্ত হবে। এখানেই আসছে বিজেপির বিলের ‘প্রয়োজনীয়তা’। দাবি করা হচ্ছে, এই বিল হচ্ছে অ-মুসলমানদের রক্ষাকবচ। এনআরসি-তে নাম না উঠলেও পরোয়া কিসের! বিল তো আছে। ওখানে যে সেধে নাগরিকত্ব দিচ্ছে! আর মুসলমানদের এক বৃহৎ অংশেরই নাম সে ক্ষেত্রে এনআরসি-তে উঠবে না। এঁদের জন্য তো বিল নেই। এঁরাই হবেন অ-নাগরিক। এঁদের ভোটাধিকার কাটা যাবে। ভারতীয় রাজনীতি ও ক্ষমতাতন্ত্রে তা হলে আর মুসলমান কাঁটা রইল না। এ ছাড়াও সঙ্ঘপরিবারের কাছে ইজ়রায়েল মডেল তো রয়েছে। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের নির্যাতিত হিন্দুই ভারতের স্বাভাবিক নাগরিক।

(লেখক:অর্থনীতি বিভাগ, শিলচর কাছাড় কলেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement