সিলিন্ডার পৌঁছে গিয়েছে বাড়িতে, কিন্তু ব্যবহারের উপায় নেই

এখনও কাঠকুটোই ভরসা

এসডিজি-র হিসেব অনুসারে, ২০১৮ সালের শেষ অবধি মাত্র ৪৩ শতাংশ বাড়িতে স্বচ্ছ জ্বালানি পৌঁছেছিল।

Advertisement

শাশ্বত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৯ ০০:০৯
Share:

বাড়িতে বাড়িতে এলপিজি পৌঁছে যে মহিলাদের সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে, বিজ্ঞাপন আর ভাষণের মাহাত্ম্যে এই কথাটি জানতে কারও বাকি নেই। রাজনৈতিক বয়ানে ‘উজ্জ্বলা যোজনা’ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাসটেনেব্‌ল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বা সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব বাড়িতে সস্তা, ভরসাযোগ্য, পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, এমন আধুনিক জ্বালানি পৌঁছে দিতে সরকার দায়বদ্ধ। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে কাজটা অনেক দূর হয়েছে— অন্তত খাতায় কলমে দেশের ৯৯.৯৯ শতাংশ বাড়িতে এখন বিদ্যুৎ সংযোগ আছে।

Advertisement

রান্নার জ্বালানির ক্ষেত্রে ছবিটা এতখানি উজ্জ্বল নয়। এসডিজি-র হিসেব অনুসারে, ২০১৮ সালের শেষ অবধি মাত্র ৪৩ শতাংশ বাড়িতে স্বচ্ছ জ্বালানি পৌঁছেছিল। ২০১১ সালের জনশুমারি জানিয়েছিল, মাত্র ১১ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এলপিজি। অর্থাৎ, ভারতের গ্রামাঞ্চলে এখনও রান্না হয় মূলত কাঠকুটো, ঘুঁটে বা খড় জ্বালিয়েই। তাতে দূষণ প্রচুর। এই পরিবারগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র, অতি দরিদ্র।

কাঠকুটো বা ঘুঁটেতে রান্নার বিপদ প্রচুর। পরিবেশের ক্ষতি তো হয়ই, তার চেয়েও প্রত্যক্ষ হল স্বাস্থ্যের ক্ষতি। ভারতে মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হল বাড়ির অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ (এক নম্বর ঘাতক কারণটি হল উচ্চ রক্তচাপ)। এলপিজি-র মতো স্বচ্ছ জ্বালানিই বিশেষত মেয়েদের এই স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে পারে। কাজেই, নরেন্দ্র মোদী যখন উজ্জ্বলা যোজনার সঙ্গে মেয়েদের সম্মানের প্রশ্নটি জুড়ে দেন, সেটা অকারণে নয়।

Advertisement

কিন্তু প্রশ্ন হল, মেয়েদের সম্মানরক্ষায় ক’পা হাঁটতে পারল উজ্জ্বলা? ২০১৬ সালের মে মাসে প্রকল্পটির সূচনা। সরকার স্থির করে, ২০১৯ সালের মধ্যে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পাঁচ কোটি পরিবারে এলপিজি সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হবে। তার পর স্থির হয়, ২০২০ সালের মধ্যে আট কোটি সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হল লক্ষ্য। এই যোজনায় দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারের কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা সদস্যের নামে এলপিজির সংযোগ পাওয়া যায় নিখরচায়। সংযোগ নেওয়ার খরচ ৩২০০ টাকা। তার অর্ধেকটা দেয় সরকার। বাকি ১৬০০ টাকাও যদি কোনও পরিবারের পক্ষে দেওয়া মুশকিল হয়, তবে পেট্রোপণ্য বিপণন সংস্থাগুলি সেই টাকাও দেয় ঋণ হিসেবে। অর্থাৎ, সিলিন্ডার পেতে

খরচ নেই। কিন্তু, তার পরের সিলিন্ডার থেকে কিনতে হয় পরিবারকে।

এখানেই সমস্যার সূত্রপাত। একটা ১৪.২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এখন ৭০০ টাকার বেশি। তার মধ্যে ২১৫ টাকা ভর্তুকি হিসেবে ফিরে আসে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। অবশ্য, তার থেকে আবার কাটা যায় পেট্রো বিপণন সংস্থা থেকে নেওয়া ১৬০০ টাকা সুদবিহীন ঋণের কিস্তি। প্রতি বার সিলিন্ডার কেনার জন্য সাতশোর বেশি টাকা পকেট থেকে বার করতে পারেন ক’জন গরিব মানুষ? ফলে, তাঁরা এলপিজি সংযোগ পেয়েও ব্যবহার করেন না সেই গ্যাস। জমিয়ে রাখেন কোনও জরুরি পরিস্থিতির জন্য। রান্না চলে কাঠকুটোর মতো জ্বালানিতেই, কারণ গ্রামাঞ্চলে এই জ্বালানি পাওয়া যায় কার্যত না চাইতেই। বিনা পয়সায়।

কেউ যদি নিয়মিত এলপিজিই ব্যবহার করতে চান, সেটাও কি সম্ভব? একটা হিসেব দিই। ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি অবধি নিয়মিত এলপিজি ব্যবহার করেন, এমন গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে ৩১ শতাংশ। আর, এলপিজি বিপণন কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র নয় শতাংশ। কাজেই, চাইলেই যে আপনার বাড়িতে এলপিজি পৌঁছে যাবে, সে ভরসা নেই। অতএব, উজ্জ্বলা প্রকল্পে এলপিজি সংযোগ পেয়েছে, এমন ৯০ শতাংশ পরিবার এখনও বাড়িতে কাঠকুটোর মতো জ্বালানি মজুত রাখে।

উজ্জ্বলা যোজনায় যে বেশ ভাল পরিমাণে নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ২০২০ সালের মধ্যে যে আট কোটি নতুন সংযোগ দেওয়ার কথা ছিল, তার ৮৬ শতাংশ (৭.২৫ কোটি) দেওয়া হয়ে গিয়েছে এই বছর জুনের মধ্যে। শুধু ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষেই এই যোজনায় ৩.৬২ কোটি নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আগের বছর দেওয়া হয়েছিল ১.৫৬ কোটি। উত্তরপ্রদেশে দেওয়া হয়েছে ১.৩১ কোটি নতুন সংযোগ, পশ্চিমবঙ্গে ৮০ লক্ষ, বিহারে ৬৪ লক্ষ। ২০২০ সালের মে মাসের জন্য যে লক্ষ্য ধার্য করা হয়েছিল, এই অগস্টেই তা পূরণ করবে বলে জানিয়েছে সরকার।

একটি সমীক্ষার হিসেব বলছে, ২০১৬ সালে দেশের ৫৬ শতাংশ পরিবারে এলপিজি সংযোগ ছিল। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ শতাংশে। কিন্তু, ছ’টি রাজ্যে সমীক্ষা চালিয়ে ‘কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার’ জানিয়েছে, ২০১৫ সালে যেখানে ১৪ শতাংশ পরিবার প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করত, ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৭ শতাংশে। এবং, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দেখা গিয়েছে, এলপিজি সংযোগ আছে, কিন্তু সেই জ্বালানি কার্যত অব্যবহৃত, এমন সংযোগের সংখ্যা ৩.৮২ কোটি। প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনায় যত সংযোগ দেওয়া হয়েছিল, সংখ্যাটা কিন্তু তার খুব কাছাকাছি। অর্থাৎ বাড়িতে সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া আর বাড়িতে সেটাকেই প্রাথমিক জ্বালানি করে তোলা যে আসলে এক কথা নয়, সেটা এই তথ্য থেকে স্পষ্ট।

দেশে প্রতিটি এলপিজি সংযোগপিছু বছরে গড়ে সাতটি নতুন সিলিন্ডার লাগে। কিন্তু, উজ্জ্বলা যোজনার ক্ষেত্রে লাগে মাত্র তিনটি। অর্থাৎ, উজ্জ্বলায় যাঁরা গ্যাস পেয়েছেন, তাঁদের এলপিজি-র ব্যবহার অন্যদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। এই সমস্যার একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা হয়েছে সিলিন্ডারের আয়তন কমিয়ে। প্রচলিত ১৪.২ কেজির সিলিন্ডারের বদলে পাঁচ কেজির সিলিন্ডার চালু করে। তাতে সিলিন্ডারপ্রতি খরচ ২৬০ টাকা, তার মধ্যে আবার ৮০ টাকা ভর্তুকি হিসেবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। তা ছাড়াও, সরকার পেট্রোপণ্য বিপণন সংস্থাগুলিকে পরিষেবার মান উন্নত করতে বলেছে, আরও দ্রুত সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছে।

স্পষ্টতই, কতগুলো নতুন বাড়িতে এলপিজি সংযোগ পৌঁছল, সেই হিসেবের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। বিদ্যুৎ বা এলপিজি সংযোগ পৌঁছে দিলেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। গরিব মানুষ সত্যিই এলপিজি ব্যবহার করতে পারছেন কি না, তার সুবিধা নিতে পারছেন কি না, পারার মতো পরিস্থিতি সরকার তৈরি করছে কি না, এগুলোই আসল প্রশ্ন।

নয়াদিল্লির দি এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটে কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement